
সূর্য ওঠার অনেক আগেই পেখমের ঘুম ভেঙে যায়। তার কপালে হালকা ঘাম, সাথে শরীর এতো নরম লাগছে যেন মনে হচ্ছে কবছর জ্বরে হুশ ছিলো না অনায়াসে; এদিকে বুকটাও কেমন ধকধক কর কাপছে। চারপাশ অন্ধকার না, কিন্তু তার ভেতরটা যেন তীব্র আলোয় পোড়ানো কিছু একটার মত, বিরক্তিকর, জ্বালাময়ী, সারা শরীরে মনে হচ্ছে কেউ আ গুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। পেখম খুব কষ্ট করে উঠে বসে। তার মাথাটা মাথা ধরেছে। ঘাড়ের পেছনে নরম একটা শীতল কাপড় রাখা, আর কোলের পাশে পানির বোতল। ঠিক যেমনটা গাড়িতে রাখা ছিলো। পেখম কপাল কুঁচকে ভাবল, এসব কে রেখেছে?
তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে, গত রাতের সকল দৃশ্য, তারা বনফায়ারে গেছিলো, আড্ডা দিয়েছে। গল্প, গান, হৈ হুল্লোড়, আর শেষে সেই কাপের পাহাড়ি পানীয়। তারপর…
তারপর? তারপর কি হয়েছে? পেখম সব মনে করার চেষ্টা করল পারল না। তাই চোখ বুজে ফেলে আবারো স্থীর করার চেষ্টা করে ভাবল তাহলে তাকে রুমে নিয়ে এসেছে কে? নওশির ভাই? তাহলে সে অবশ্যই নওশিরকে উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলোছে। কিন্তু সে কী বলেছিলো নওশিরকে? কী দাবিতে বুক তুলেছিলো?
কি সে আবদার? ঢোক গিলল, পেখমের গলা থেকে কাঁপা শ্বাস বেরিয়ে আসে। তারপর পেখম মুখে চাপা দিয়ে বিরবির করে তৎক্ষনাৎ বলল, “হায় আল্লাহ!”
পেখমের হাত তরতর করে কাঁপছে। তারপর লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলাতে চাইল, হলো না একবিন্দুও, বিছানার পাশেই জানলা ছিলো তাই পেখম জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকায়। পাহাড়ে হালকা কুয়াশা, ঝিম ধরা প্রকৃতি, যেন সব কিছু স্বাভাবিক। কেবল তার নিজেকে ছাড়া। সে কি করেছে? ঠিক কতটা পাগলামি করেছে? কতটা বিব্রত করতে হয়েছে নওশিরকে?
ঠিক তখনই রুমের দরজায় টোকা পড়ে। সে ধক করে ওঠে চমকে উঠল। সাথে তখনই শুনতে পেলো,।
“পেখম? উঠেছেন? আপনার ওষুধটা টেবিলে রাখা, খেয়ে নিন।”
ঢোক গিলল পেখম। নওশির এতো স্বাভাবিক কিভাবে কথা বলছে? কিন্তু পেখম দরজা খোলে না, আর কোনো সাড়া দেয় না। শুধু চুপচাপ বিছানায় ঝিমিয়ে পড়া শরীরটা নিয়ো সবটা শোনে, তারপর নওশিরের পায়ের শব্দ মিলিয়ে যায়।
বেলা একটু বাড়লে পেখম দরজা খুলে ধীরে ধীরে বাইরে বের হয়। গায়ে একটি নরম উলের সোয়েটার জড়ানো, চোখে ঘুমের ধোঁয়া, কিন্তু চেহারায় তীব্র অনুশোচনার ছাপ। রিসেপশনের দিকে যাওয়ার সময় হঠাৎ চোখ আটকালো এক কোনায়, যেখানে নওশির দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। মাঝেমধ্যে দিকে সেদিক তাকিয়ে নিচ্ছে, সামনে পাহাড় ছুঁয়ে যাওয়া কুয়াশার দিকে। পেখম একটু দ্বিধায় পড়ে। সে কি যাবে? নওশিরের সাথে কথা বলবেন? বলবে তো কি বলবে?
একটা শ্বাস ফেলে অবশেষে সে সাহস করে কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ও যেয়ে দাঁড়াতেই নওশির ফোন কেটে তাকায় পেখমের দিকে। তবে মুখে কিছুই বলল না।
পেখম মাথা নিচু করল তারপর খানিক চুপ থেকে বলল,
‘আমি… আমি গতকাল… আমি ঠিক ছিলাম না।’
নওশির শান্ত গলায় জবাব করল,
‘জানি। আপনার দোষ নয়। তবে আমি ছিলাম বলেই কিছু হয়নি, আমি সামলে নিয়েছি।’
পেখম মাথা তুলে তাকায়। তার চোখে পানির কণা। তবুও কণ্ঠ নরম গলায় জানতে চায়,
‘তবে আপনি রাগ করেননি?’
নওশির চেয়ে থাকে। তার চোখে কোনো তিরস্কার নেই, বরং এক রকম অতল সহানুভূতি। তারপর সেও নরম বিভেদ গলায় বলল,
‘না। কারণ আপনি ড্রাংক ছিলেন আর তাই তখন আপনি নিজের মাঝে ছিলেন না। তাই আপনাকে খেয়াল রেখেছি যাতে আপনার কোনো ক্ষতি না হয়।”
নওশিরের সহজসরল স্বীকারোক্তি। তবে এমন কথায় পেখম ভীষণ আবেগে ভরে ওঠে। তবু পেখম চোখের জল মুছে হেসে বলে,
‘ ইস আপনি না থাকলে গতরাতে কি যে হতো! ভাবতেই কেমন লাগছে।’
নওশির উত্তর দেয় না। শুধু গলায় ঝিম ধরা কণ্ঠে বলে,
‘পাহাড়ে চা খেতে যাবেন পেখম? আজ ভালো রোদ উঠেছে।’
পেখম কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে… তারপর নওশিরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। নওশির একবার এক পা এগিয়ে এসে চুপচাপ পেখমের হাতের দিকে তাকায়। ধরেনি, কিন্তু তার দিকেই চোখ ছিল। পেখম দেখে, নওশির চাইলেই তার হাত ধরতে পারে। কিন্তু সে ধরে না। এই অধরার সীমারেখা যেন সেই নওশিরের চোখে সবচেয়ে বড় দ্যুতি হয়ে ধরা দিচ্ছিলো পেখমের নিকটে।
পাহাড়ের রাস্তা বেয়ে দু’জন মানুষ হাঁটছে পাশাপাশি। একজনের চোখে নীরবতা, অন্যজনের চোখে অনুসন্ধান। কি একটা যেন খুঁজছে। আজ সারাদিন বাহিরে নওশির আর পেখম। সেই সকালে বেড়িয়েছে আর ফেরা হয়নি কারোই। পাহাড় চষে বেড়ালো যেন। এখন বেলাশেষলর রোদটা একদম ঝিম ধরে বসে আছে পাইন গাছের পাতায়। তাদের পেছন পেছন ধোঁয়া উঠছে কোনো রান্নাঘর থেকে, দূরে কোথাও বাজছে বাঁশির মতন হালকা সুর। হয়তো কোথাও অনুষ্ঠান। পেখম ধীরে হেঁটে যাচ্ছে। তার কাঁধে একটা বেগুনি শাল। এখানকার বাজার থেকেই আশার সময় কিনেছে। পেখমের লালচে চুলগুলো আজ হাওয়ায় ঘেঁটে গেছে, তবু মুখে আজ এক চুপচাপ মুক্তির ছাপ, যেন সে নিজেকে খুব করে খুঁজছে। একটু একটু করে। গতকালের সমস্ত পাগলামি, অনুশোচনা; সব যেন একটুখানি থিতু হয়ে এসেছে আজ।
নওশির পাশাপাশি হেঁটে চলেছে সে একটি শব্দও বলছে না। কিন্তু মাঝে মাঝে তার চোখ পড়ে যাচ্ছে পেখমের দিকে, যেন সে বোঝার চেষ্টা করছে, এই মেয়ে এখনো আগের মতোই ছেলেমানুষ, নাকি সত্যিই ভেঙে গড়ে উঠেছে নতুন করে।
পেখম হঠাৎ থমকে থেমে দাঁড়াল। তারপর অদূরে একটা উচুঁ জায়গায় তাকায়। সেখান থেকে দেখা গেলো, পাহাড় কেটে তৈরি করা একটা ছোট্ট ঢাল। নিচে সবুজ চা-বাগান, পাশে কুয়াশার পর্দা। পেখম দৌড়ে গেলো সেখানে। পেখমের সাথে নওশিরও লম্বা কদম ফেলে তার পিছনে গেলো। সেখানে দাঁড়িয়ে পেখম হঠাৎ বলে উঠল,
‘আপনি যদি না থাকতেন… তাহলে আমি হয়তো…’
কথাটা শেষ করল না। নওশির তাকাল। নওশিরের চোখে কোনো মায়া ছিলো না তবুও ছিল এক প্রকার অনুচ্চারিত দায়িত্ব। একটা শ্বাস ফেলল নওশির তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘নিজের ওপর এতটা কঠোর হওয়া উচিত নয় পেখম যে অন্য কেউও আপনায় নিয়ে চিন্তিত থাকে। আমরা অনেকেই নিজের ক্ষতগুলো না বুঝি, না বোঝাতে পারে।
কিন্তু ক্ষত থাকলেই মানুষ খারাপ হয় না।’
পেখম চুপ করে নীরবে শোনে সে কথা। তারপর ধীরে পায়ের নিচের শুকনো পাতা ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তারপর ধীরে নিজেই বলল,
‘আমি এখন ভাবি, আমি আসলে কী চাই?’
তারপর ফের বলল,
‘পাঁচ বছর আগেও তো আমি জানতাম না আমি একটা ম্যারিটাল রেপ সারভাইভার হবো, একটা জমজ সন্তানের মা হয়েও মা হতে পারব না। তখন শুধু চাইতাম, ভালোবাসি বললে সে আমায় ভালোবাসে, আর আমাকেও ভালোবাসতে হবে। তাই তো বিয়ের পর সৌজন্যের জন্য সব জলাঞ্জলি দিলাম।’
এতোটুকু বলেই পাগলের মতো নিজের ওপর নিজেই তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে ফেলল পেখম। নওশির শোনে। তারপর খুব নিচু স্বরে বলল,
‘সব চাওয়া পূরণ হয় না। কিন্তু সব চাইতে শেখা যায়।’
পেখম ফিরে তাকায় নওশিরের পানে। এতো ভারী কথা কেনো বলে এই লোক। আজকের এই পেখম আর গতকাল রাতের পেখম এক না। তবুও হাসি ফুটালো পেখম। ওর চোখে এক টুকরো দ্যুতি, ঠোঁটে এক তিক্ত অভিজ্ঞতা কাটিয়ে ওঠার স্পর্ধা। তারপর হঠাৎ হেসে বলল,
‘একটা জিনিস সত্যি… আপনাকে মনে হলেই এখন আর শুধু ছোটবেলার ছাঁদ, বৃষ্টি বা ইস্তাম্বুলের পায়রা মনে পড়ে না। মনে পড়ে, আপনি সেই মানুষ… যার নীরবতাও এখন অনেক, যেন আমায় চিৎকার করে বলে দিচ্ছে, আমি আছি পেখম। আপনি সামনে বাড়ুন, আপানকে উৎসাহ দিতে আমি আছি।’
নওশির কিছু বলে না। ঠোঁট কোন বাকালো। সাথে তার চোখে খুব ক্ষণিকের জন্য যে আলো ফুটে ওঠে, তাতে বোঝা যায়, এই এক লাইনের কথায়, কিছু অজানা গলি সে পেরিয়ে এসেছে। তারপর তারা পাশাপাশি হেঁটে যেতে থাকে। আর দূরে, শেষ বিকেলের আকাশে সোনালি একটা রেখা নামে সেখানে। আর পেখম ভাবে, ঠিক এমনভাবেই তো কোনো মানুষ কারো জীবনে নেমে আসে, আলো হয়ে নয়, একরাশ উষ্ণতা হয়ে, ভরসা হয়ে। অথচ কোনো মালিকানার দাবি নেই সেখানে।
পাহাড়ে তাদের কটেজে ফেরার পথটা একদম নীরব, তবে ভারী নয়। পেখম ও নওশির পাশাপাশি হাঁটছিল, দু’জনের মাঝখানে শান্ত একটা দূরত্ব বজায় রেখেছে তারা। আকাশে তখন কালোর মাঝে নীল আর সোনালি রঙের স্নান। হঠাৎ কি একটা শুনতে পেয়ে তারা দুজনই থেমে গেল। তাই একটু এগিয়ে একটা ঢাল বেয়ে নামতেই চোখে পড়ে, নীচে পাহাড়ি একটা খোলা ময়দান। সেখানে হালকা আলো, চৌকোনা পাথরের বেদী, বাঁশের বাঁকা ঝোলানো তোরণ, আর নানা বর্ণিল পোশাকে স্থানীয় পাহাড়ি কিছু মানুষ গান আর ঢোল বাজাচ্ছে। পেখমের চোখ আনন্দে চকচক করে উঠল আর ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
“ওরা কি উৎসব করছে?”
নওশির তাকিয়ে ফোন বের করল। তারপর এদিক সেদিক তা তাক করে নেটওয়ার্ক খুঁজল তারপর ফোনে কিছু একটা দেখে পেখমের দিকে তাকায় আর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ… এই সময়ে স্থানীয় ‘জুম ধান কাটার’ উৎসব হয়। খুব অন্তরঙ্গ, নিজেদের ভেতরের লোকজনকে নিয়েই উদযাপন করে ওরা।”
পেখম একটু নরম স্বরে বলল,
“আমরা যেতে পারি? শুধু একটু দেখে আসি? চলুন না?”
নওশির ইতস্তত করে। সে বলার আগেই নিচ থেকে একজন পাহাড়ি লোক তাদের দেখে হাত নাড়ে। তার চোখ জুড়ে আছে সোজাসুজি হাসি।তারপর চেঁচিয়ে বলল,
“আসেন! অতিথি মাফিক আপনেরা আমন্ত্রণ! খালি দেখে চইলা যাইবেন না, এই উৎসব ভাগ করে নিতে হইব!”
পেখম বিস্ময়ে হেসে ওঠে আর বলল,
“এরা তো আমন্ত্রণই জানিয়ে ফেলল, আপনি যাবেন না?”
নওশির সামান্য হাসে। মেয়েটা এতো পাগলামি করে, যেন তার জেদ এ হাড়তেই হয়। আর প্রকৃতিও যেন চাইছে তারা কাছে আসুক।
পেখম নিজেই নিচের দিকে দৌড়াতে থাকে, মনে হচ্ছে তার শরূরে থাকা শালটা উড়ে যেতে চায় বাতাসে। নওশির তাকিয়ে থাকে তার পেছনে অনেকটা সময়, দৃঢ় দৃষ্টিতে… তারপর ধীরে ধীরে নেমে আসে।
নিচে পৌঁছে পেখম দেখল, স্থানীয় ছেলে – মেয়েরা তাদের ঐতিহ্যবাহি জামা কাপড় পড়ে গোল হয়ে নাচছে। মাঝে একটি আগুন জ্বলছে, চারপাশে বেতের ঝাঁপি, মাটির হাঁড়ি। হাতের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে পাশে। এক পাহাড়ি নারী এসে পেখমের হাতে রঙিন একটি চাদর তুলে দেয়। আর বলল,
“আপু, আপনার মতো সুন্দরীর জন্য রঙ চাই!”
পেখম চমকে যায়। তারপর অদ্ভুত গলায় প্রশ্ন করল,
“তুমি বাংলা জানো?”
“একটু একটু, স্কুলে পড়ি। আপনি আসছেন বইলা ভালো লাগছে!”
পেখম হেসে চাদরটা গায়ে জড়ায়। তারপর পিছনে তাকিয়ে দেখে, নওশির চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু চোখ তার সরল প্রশ্রয়ের মতো। তাকে এমনভাবে চেয়ে থাকতে দেখে পেখমের কণ্ঠে খুশির ঢেউ নামে,
“আপনিও আসুন না! এখানে কেউ কাউকে চিনে না, বিচার করে না। শুধু সাদামাটা আনন্দ!”
নওশির এগিয়ে আসে। চাদর পেচানোর পর পাহাড়ি মেয়েটা ওকে একটু সাজুয়ে দেয় এবার এই চাদরের আড়ালে থাকা পেখমকে আজ যেন সত্যিই একটু বেশি অন্যরকম লাগছে। কপালে বেণির ফাঁকে দুলতে থাকা ছোট্ট পাথরের টিপটা পাহাড়ি মেয়েটাই পরিয়ে দিয়েছে। নাচ, সঙ্গীত আর আগুনের আলোয় চারপাশে যেন এক প্রাচীন কাহিনির ব্যাখ্যা চলছে। পেখম ধীরে নওশিরকে ফিসফিস করে বলল,
“কখনো মনে হয়, আমরা মানুষ না। শুধু গল্পের চরিত্র। যার শুরু আছে, কিন্তু শেষ হয় না কোনোদিন।”
নওশির পাশে বসে ফিসফিস করে বলল,
“আপনি শুধু গল্পের চরিত্র নন, আপনি নিজেই একটা গল্প পেখম। আর এটা আপনি আপনার হয়ে ওঠার গল্প। এই গল্পে আপনাকেই জিততে হবে। মনে রাখবেন, গল্প যেই বলুক না কেনো; হিরো কিংবা ভিলেন, ‘ভিলেন সব সময় ভিলেনই হয়’!”
পেখম থেমে তাকায় তার দিকে। নওশির মুখ ফিরিয়ে নেয়। পেখমের চোখে অদ্ভুত একটা দ্বিধা ও প্রশ্ন। কি ছিলো নওশিরের শেষ কথার আড়ালে…?
চলবে,..