নবোঢ়া [পর্ব ৫০ প্রথম অংশ]

রাতের চাদরটা তখনও পুরোপুরি গুটিয়ে নেয়নি আকাশ। দিগন্তের কিনারায় সূর্যটা তার প্রথম আলোর আঁচল মেলে ধরেছে। সিদ্দিক সবজি বাগানে হেঁটে হেঁটে হাতের জল-ছিটানো সেচনির সরু মুখ দিয়ে জলের মুক্তো ছড়িয়ে দিচ্ছে ফুলের ডালে আর কচি পাতার গায়ে। গ্রীষ্মের দাবানলে ভোরবেলার এই ঠাণ্ডা-মিষ্টি মুহূর্তটা তার হৃদয়ে আনন্দ জোগায়। গাছপালাগুলোও এই সময়টাতেই তৃষ্ণার্ত কণ্ঠে তৃপ্তি নিয়ে জল গ্রহণ করে তাদের শিকড়ের গভীরে। কেন যে ভোরটা এত অল্প সময়ের জন্য আসে কে জানে! হঠাৎ মনোযোগে ছেদ পড়ে কারো পায়ের শব্দে। ফজিলা মাটির পথ বেয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে হাতে সবজির ঝুড়ি নিয়ে। তাকে দেখলেই সিদ্দিকের বুকের ভেতর শব্দ জেগে ওঠে ঘণ্টার মতো; শোনা যায় না, ভোলাও যায় না। মেয়েটার কালো মুখে এমন জাদুকরী উজ্জ্বলতা যে, দেখলেই তার হৃদয় মোমের মতো গলে পড়ে! সে সেচের কাজ ফেলে রেখে এগিয়ে যায় সবজি তোলার কাজে হাত লাগাতে। চাল কুমড়ার ঝোপঝাড়ে হাত বাড়াতে গিয়ে চোখ পড়ে দূরে, ঘোড়ার আস্তাবলের পেছনের ঝোপঝাড়ে। কিছু একটা পড়ে আছে মাটিতে। ভোরের ধূসর আলোয় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না, তবে একটা অমঙ্গলের আভাস বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়। ফজিলা চলে যেতেই ভয় আর অস্থিরতা নিয়ে এগিয়ে যায় আস্তাবলের দিকে। কাছে যেতেই তার মাথায় বজ্রপাত হয়। মাটিতে নিথর হয়ে শুয়ে আছে বাড়ির বিশাল কালো কুকুরটা। জিভ বেরিয়ে আছে, গলায় দাগ। ভয় আর হতভম্বতায় শ্বাস আটকে আসে সিদ্দিকের। বুকের ভেতরে কিছু একটা থরথর করে ভেঙে খানখান হয়ে যায়। দৌড়ে ছুটে যায় মহলের দিকে।

ভেতরে, এই মোরগ-ডাকা ভোরে সুফিয়ান ভূঁইয়া, শব্দর আর নাভেদকে ডেকে এনে ব্যবসার দায়িত্ব ও বিয়ের আয়োজন নিয়ে আলাপ করছেন। দুটো কাজই যাতে নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়। বিয়ের ঝামেলায় যেন ব্যবসার সামান্যতম ক্ষতিও না হয়। নাভেদ ব্যবসার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। আর শব্দর নিয়েছে জাওয়াদের জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের সব আয়োজন। দুজনেই বারবার আশ্বাস দিচ্ছে। কিন্তু সুফিয়ানের মন থেকে উদ্বেগ যাচ্ছে না। সবকিছু ঠিকঠাক হবে তো? এই চিন্তায় তার ঘুম হারাম। সিদ্দিক সেখানে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলে, ‘হুজুর, ঘোড়ার আস্তাবলের পেছনে কালো কুকুরটা মরে পড়ে আছে।’

সবার চোখে বিস্ময়ের বিদ্যুৎ চমকে ওঠে। তারা সবাই একসাথে ছুটে যায় জায়গাটায়। আস্তাবলের পেছনে পৌঁছে থমকে দাঁড়ায়। সিদ্দিক ফিসফিস করে বলে, ‘কেউ ইচ্ছে করেই মেরেছে হুজুর… দেখুন গলায় দাগ৷ কেউ শ্বাসরোধ করে মেরেছে হুজুর।’

সুফিয়ানের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে৷ তিনি ভালোবেসে কুকুরটাকে রাজা বলে ডাকতেন। চারদিকে নজর বোলান। একটু দূরে পড়ে থাকা খাবারের বাটিতে চোখ পড়তেই মনে তিতা সন্দেহ জন্মায়, রাজাকে কেউ ভালোবাসার ছলে খাইয়েছে। খাবারে নিশ্চয়ই কোনো মরণঔষধ মেশানো ছিল। তারপর রাজা যখন অবশ হয়ে পড়েছে, ঠিক তখনই হত্যাকারী তার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। নয়তো রাজার মতো দুর্দান্ত, হিংস্র জন্তুকে জেগে থাকা অবস্থায় মারা অসম্ভব। ভয়ানক দৃশ্যটা কল্পনা করতেই সুফিয়ানের চোখে ভিজে ওঠে। কুকুরটি অনেক বছর ধরে এই বাড়ির পাহারাদার। তাকে মেরে ফেলার মানে, বাড়ির নিরাপত্তার দেয়ালে ফাটল ধরেছে।

বড়ভাইকে ভেঙে পড়তে দেখে শব্দর দ্রুত বলে, ‘ভাইজান, আমি খোঁজ নেব কে এই নোংরা কাজটা করেছে।’

সুফিয়ান শান্ত কণ্ঠে উত্তর দেন, ‘না, এখন নয়। বাড়ি ভর্তি অতিথি। এই খবর ছড়িয়ে গেলে, আমাদের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। মর্যাদা খর্ব হবে।’ ঘাড় ঘুরিয়ে সিদ্দিকের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘রাজাকে উত্তর পাশে, আম গাছের নিচে মাটিচাপা দিয়ে দে কেউ দেখার আগেই।’

সিদ্দিক মাথা নামিয়ে সম্মতি জানায়। একবার চোখ মেলে তাকায় রাজার দিকে। সারাদিন ছায়ার মতো পিছু নেওয়া বিশ্বস্ত সাথীটিকে আর দেখতে পাবে না, এই ভাবনায় বুকের ভেতরে জলরঙের মতো শোক ভেসে ওঠে সারা বুকজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সে শিশুর মতো দুই হাতের তালু দিয়ে চোখের জল মুছে ঝুঁকে পড়ে রাজা নামের কুকুরটির উপর।

ভোরের মিঠে আলোয় রাইহা ঘুমকাতুরে চোখে টলমল করতে করতে এসে দাঁড়ায় বাগানের নরম, শিশিরভেজা ঘাসের উপর। তার গায়ে কমলা রঙের পাতলা সুতির শাড়ি, নীল ব্লাউজের গলা আর হাতায় কমলা কাপড়ের সুন্দর কুচি। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে, দূরে কৃষ্ণচূড়া গাছের মাথায় দিনের প্রথম সোনালি রোদ ঝিলমিল করছে। ঘাড় ঘোরাতেই চোখে পড়ে, দূরের আস্তাবল থেকে বেরিয়ে আসছে সুফিয়ান, শব্দর আর নাভেদ। এই ভোরবেলায় ওরা ওখানে কী করে? কৌতূহলে তার চোখের পাতা কাঁপে। তিনজন মহলে ঢুকতেই দুই হাতে পাটের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসে আসাদ আর মনির। দুজন বাজারের দিকে রওনা হয়েছে। আসাদের দিকে তাকালে কেন যেন রাইহার বুক দুরুদুরু করে ওঠে। লোকটা সবসময় নিজের সাথে একটা নীরব জগৎ নিয়ে ঘোরে। তার মনে হয়, ‘মৌনতা’ শব্দটাই বুঝি আসাদের জন্য বানানো। যে যা বলে, সে শুধু মাথা নিচু করে সায় দেয়। রাইহা গলা উঁচিয়ে ডাকে, ‘এই যে মৌনমহারাজ!’

আসাদের পা থমকে যায়। এই নামে রাইহা ছাড়া আর কেউ ডাকে না তাকে। মনির ততক্ষণে গেট পেরিয়ে গেছে। পিছনে ঘুরে দেখে, সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়েছে রাইহার গায়ে। তার চোখ দুটো পরিষ্কার আকাশের মতো নীল। তাকালে মনে হয়, স্বর্গের কোনো পরী নেমে এসেছে এই গ্রামের উঠানে। আসাদ লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে। নিচু জাতের, গরিব মানুষের চোখে এত সৌন্দর্য দেখাও যেন পাপ। রাইহা দু-পা এগিয়ে এসে বলে, ‘তোমার হবু বউ তো জাওয়াদের প্রেমের ট্রেন ধরে পালিয়েছে! এখন কী করবে ভেবেছ? সন্ন্যাস নিবে, নাকি কাঁথা মুড়ি দিয়ে কাঁদবে?’ বলেই সে খিলখিল করে হেসে ওঠে। সে দারুণ খুশি হয়েছে আসাদের বিয়ে ভেঙে যাওয়ায়। আসাদ কোনো কথা না বলে হাঁটতে শুরু করে। রাইহাও তাল মিলিয়ে হাঁটে আর বলে, ‘বাজারে যাচ্ছ? আমাকেও নিয়ে চলো।’

আসাদ থামে না, হাঁটতেই থাকে। পরনে তার ঢোলা ফতুয়া, ধুলোমাখা পায়জামা। রাইহা জেদ করে বলে, ‘আমাকে না নিয়ে গেলে কিন্তু ফুফুজানকে সব বলে দেব!’

আসাদ এক মুহূর্ত থেমে দাঁড়ায়, চোখে অস্থিরতা দেখা দেয়। কী এমন বলবে মেয়েটা? রাইহা মিটমিট করে হেসে বলে, ‘নিয়ে চলো, নইলে সব ফাঁস করে দেব।’

গত এক সপ্তাহ ধরে এভাবেই বলে যাচ্ছে। রোজ একই জেদ, সে হাটবাজার দেখতে চায়। এমন একগুঁয়েমি! ওদিকে সুফিয়ান ও কোহিনূর দুজনেরই নিষেধাজ্ঞা, এই পরিবারের কোনো মেয়ে-বউ কিংবা দাসী বাজারে যেতে পারবে না। বাজার পুরুষদের জন্য। আসাদেরও সাহস হয় না সেই নিষেধাজ্ঞা ভাঙার, ভূঁইয়া পরিবারে যে মেয়েটা এখন কন্যা হিসেবে পরিচিত, তাকে নিয়ে বাইরে বেরোনো তার মতো গাড়োয়ানের পক্ষে অসম্ভব। তবু প্রতিদিন রাইহার অনুরোধ শুনে তার মনের ভেতর প্রবল ইচ্ছা জাগে- যদি পারত, কাঁধে তুলে এই রূপকথার মতো সুন্দর রাজকুমারীকে নিয়ে শুধু হাটবাজার নয়, গোটা কান্তারপুর ঘুরে বেড়াত! ভাবতে ভাবতে সে বাড়ির গণ্ডি পেরিয়ে দূরে চলে যায়।

রাইহা সেদিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। তাকে কেউ আমলে নেয় না। এমনকি একজন সাধারণ গাড়োয়ানও না। চোখ দুটো অজান্তেই ভিজে ওঠে। ধীরে ধীরে সূর্য উঠে পড়ে মাথার উপর। রাইহা সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বাড়িজুড়ে শুরু হয় জাওয়াদ-গুলনূরের বিয়ের ধুম। আগামী দুইদিন ঢাকঢোল বাজবে, গান চলবে। সবার নজর থাকবে

বরকনের দিকে। ইদানীং তার ইচ্ছা হয়, বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে, সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকতে।

কোহিনূর শুয়ে আছেন সাজানো-গোছানো ঘরের রাজকীয় পালঙ্কে। একজন দাসী পায়ের পাতায় তেল মালিশ করছে। আরেক দাসী কাঁসার থালায় সাজানো সুপারি যাঁতির ধারালো ফলায় কেটে পান পাতায় মুড়ে কোহিনূরের সামনে এগিয়ে দিচ্ছে নত মাথায়। তিনি হাত বাড়িয়ে পানটি হাতে নেন। চিবোতে চিবোতে জানালার বাইরে দৃষ্টি মেলে ধরেন। গোটা জমিদারবাড়ি উৎসবের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। বিস্তীর্ণ আঙিনায় বাওল দল মাদল আর একতারার সুরের জালে বেঁধে রেখেছে সবার মন। কাঠের মঞ্চে পুতুলনাচের তাল লেগেছে, শিশু-কিশোররা আনন্দের হাততালিতে মুখরিত করে তুলেছে পুরো পরিবেশ। অতিথিশালার বারান্দা মেহমানদের আগমনে জমজমাট, সকাল হতেই রান্নাঘরে শুরু হুলস্থূল কাণ্ড; ধোঁয়া, গরম, হাঁড়িপাতিলের শব্দ, দৌড়াদৌড়ি আর হাঁকডাক। পুরো জমিদারবাড়ির রগে রগে বয়ে যাচ্ছে বিয়ের আমেজ। এই সব কিছুর মাঝেও কোহিনূরের মন অন্য ভাবনায় মগ্ন। গুলনূরের বিদায়ের দিন আজ। আগামীকাল দুপুরেই আবার পালকিতে করে তাকে ফিরিয়ে আনা হবে। আজ যাবে ভূঁইয়াদের বাংলো বাড়িতে, বিয়ে পড়ানোর ঠিক আগ পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করবে।

দরজায় মৃদু করাঘাতের শব্দে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায়।

কোহিনূর গলা উঁচু করে বলেন, ‘এসো।’

গুলনূর নতশির হয়ে ঘরে ঢুকে। কোহিনূর ইশারায় দাসীদের বিদায় হতে বললে তারা চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে কবরস্থানের নীরবতা নেমে আসে। তিনি মেরুদণ্ড সোজা রেখে ধীর গতিতে উঠে বসেন। ইশারায় গুলনূরকে বসতে বললে গুলনূর কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বিছানার এক প্রান্তে বসে।

‘দুপুরে খেয়েছ?’ জিজ্ঞাসা করেন কোহিনূর।

গুলনূর মাথা নাড়ায়। কোহিনূর মুহূর্তকাল নীরব থেকে বলেন, ‘বিয়ের আগে তোমার সাথে আলাদা করে আর কথা বলার সুযোগ পাব না, তাই এখনই ডেকে নিলাম। কিছু কথা না বললে মনের ভেতর বোঝা হয়ে থেকে যাবে।’

তিনি উঠে গিয়ে আলমারি থেকে পুরনো মেহগনি কাঠের বাক্স নিয়ে আসেন। বাক্স খুলতেই সূর্যালোক-ছায়ার মতো ঝিকিমিকি করে ওঠে একটি রুবির আংটি। রত্নটির দীপ্তি গুলনূরের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। তিনি নিজ হাতে গুলনূরের বাঁ হাতের অনামিকায় আংটিটি পরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এই আংটির মতোই ভালোবাসার বাঁধনে জড়িয়ে রাখবে স্বামীকে। কোনোদিন ওকে কষ্ট দিবে না। জাওয়াদ বাইরে থেকে যতই কঠিন দেখাক, ভিতরে ও ছেলেবেলার মতোই কোমল, অবুঝ। কোনো যন্ত্রণা মেনে নিতে পারে না। যতটুকু ধৈর্য ছিল সেটাও দুই বছর আগে হারিয়ে ফেলেছে …’ কথা অসম্পূর্ণ রেখেই থেমে যান।

গুলনূর চোখ তুলে তাকায়। কোহিনূর নিঃশ্বাস ফেলে বলতে থাকেন, ‘তুমি তো দেখেছ তোমার জন্য কী না করেছে। কত উন্মাদনা করেছে! এসব কোনো পুরুষ হঠাৎ করে করে না। যদি না হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসতে পারে। মানুষ বলে, পুরুষেরা কাঁদতে পারে না, এই কথাটা আমি মানি না। আকাশ ভেঙে পড়লে, বুক ফেটে গেলে তারাও কাঁদে। জাওয়াদ কাঁদে। অঝোরে কাঁদে। পুরুষ মানুষ কাঁদে না, কাঁদলে দুর্বল লাগে – এই কথা আমাদের সময়েও শুনেছি। অথচ আমি কত পুরুষকে কাঁদতে দেখেছি! তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেদনা নিয়ে কাঁদতে দেখেছি জাওয়াদকে। ও কাঁদলে পাথরও যেন গলে যায়। তুমি কখনো সেই কান্নার কারণ হয়ো না। একজোড়া চোখ, একজোড়া হাতই পারে একজন পুরুষকে আবার দাঁড় করাতে। সেই চোখ, সেই হাত যেন হয় তোমার। তুমি আমার জাওয়াদের ভরসা, শান্তি হয়ে থেকো।’

গুলনূর এক হাত দিয়ে আরেক হাত আঁকড়ে ধরে। কোহিনূর আরও বলেন, ‘একটা কথা মনে রাখবে, নারীর রূপলাবণ্য নয়, তার দেয়া সম্মান, ভালোবাসাই একজন পুরুষকে বশ করে রাখে। তুমি যদি জাওয়াদের মনের ভাষা উপলব্ধি করতে পারো, ও তোমাকে চোখে হারাবে। আমার শ্বশুরবাড়িতে আমি যা কিছু অর্জন করেছি, সব পেয়েছি তোমার দাদাশ্বশুরের স্নেহের কারণে। আমি সবসময় বিনয়ের মুকুট মাথায় রেখেছি, বিনিময়ে উনি আমার জন্য ওই বাড়িটাকেই রাজ্য বানিয়ে রেখেছিলেন। আমি কখনো উনার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করিনি। স্বামী নারীর অহংকার। তার পরিচয়ের মূলে যে নাম, সে তো তার পুরুষেরই নাম।’

তিনি জানালার বাইরে তাকিয়ে আরও গম্ভীর হয়ে বলেন, ‘জাওয়াদকে শ্রদ্ধা করবে, কিন্তু ভয় পাবে না। ভয় পেলে ভালোবাসা মরে যায়। কোনোদিন যদি কোনো কারণে তোমার রাগ হয়, অভিমান জাগে, শালীনতার সীমার মধ্যে থেকেই রাগ করবে। স্বামীকে হেয় করলে সংসারের আশীর্বাদকে উপেক্ষা করা হয়। বিশেষ করে অন্যদের সামনে। স্বামীর যতই দোষ থাকুক, বাইরের মানুষের সামনে তার পক্ষেই থাকবে। ঘরে এসে যা বলার বলবে। সংসার তখনই ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায় যখন স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে যায়। স্বামী হচ্ছে সংসার নামক রথের চালক। আর স্ত্রী হচ্ছে সেই রথের ছন্দ। ছন্দ যদি তাল হারায়, রথও পথে ভেঙে পড়ে।’

কোহিনূর থামেন, এগিয়ে এসে গুলনূরের কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘তোমার হাতে জাওয়াদকে সঁপে দিলাম, আমার মান রেখো। এখন যাও, সাজসজ্জা করো। কিছুক্ষণ পরেই তোমার যাত্রা।’

গুলনূর ধীর গতিতে উঠে দাঁড়ায় চলে যেতে। কী ভেবে আবার পেছনে ফিরে তাকায়। ধীরে ধীরে চোখ তুলে প্রথমবারের মতো কোহিনূরের চোখে চোখ রাখে। তারপর এগিয়ে এসে গভীর শ্রদ্ধায় পা স্পর্শ করে সালাম জানিয়ে প্রস্থান করে সেখান থেকে। কোহিনূর কিছুটা বিহ্বলতায় পড়ে যান। এইমাত্র…এই মুহূর্তে যে গুলনূরকে প্রত্যক্ষ করলেন, সে যেন কোথাও অপরিচিত! দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা, চোখের দৃষ্টিভঙ্গি হঠাৎই অন্যরকম লাগল!

সোনালি বিকেলের মধুরিমা আলোয় স্নাত হয়ে আছে গুলনূরের পুরো অস্তিত্ব। নারকেল তেলের মাদকতা মাখানো চুলের সুবাস ঘরের বাতাসকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে। জানালার ওপারে প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে চারচাকার ছাউনি-ঢাকা পালকি-গাড়ি, যার গাঢ় রক্তাভ মখমলের আবরণ রোদের আলোয় ঝিকমিক করছে। জোড়া দুধসাদা ঘোড়ার কণ্ঠে বাঁধা রুপালি ঘুঙুর। আর তার দেহে জড়ানো জ্যোৎস্নারঙা বেগুনি শাড়ি। খোঁপায় গাঁথা সাদা বেলি ফুলের মালা। গলায় চিকন সোনার হার, ঠোঁটে লালিমা, হাতে কাচের চুড়ি। তাকে দেখাচ্ছে রাজদরবারের মহারানীর মতো। যেই একবার তাকায়, তার চোখ আটকে যায়। কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না, এই মেয়ে কান্তারপুরের জমিদার বাড়ির দাসী ছিল! তার বর্তমান অবয়ব দেখে মনে হচ্ছে, রাজ্যপাটের উত্তরাধিকারিণী সে, জন্ম থেকেই রাজরক্ত বইছে তার শিরায়। অনেক দাসী-বাঁদির অন্তরে ঈর্ষার বিষাক্ত সাপ ফণা তুলে দুলছে। যে এতদিন ছায়ার মতো অবহেলিত ছিল, আজ হয়ে উঠেছে সবার নয়নমণি। কী অভাবনীয় ভাগ্য!

গুলনূর যখন ঘোড়াগাড়িতে পা রাখে, তখন গ্রামবাসী আর অতিথিদের চোখেমুখে স্তম্ভিত বিস্ময়। কিছুদিন আগেও যেসব কুৎসিত কানাঘুষা ছিল জমিদারপুত্র আর দাসীর নিষিদ্ধ প্রেম নিয়ে, আজ সেই কলঙ্কের গুজবকে ছাপিয়ে গেছে তার মোহনীয় আভা। এ যদি যোগ্য পাত্রী না হয় তবে আর কে হবে? গুলনূরের রূপ-মাধুর্যের চেয়েও বেশি মনোমুগ্ধকর তার মুখের ধারালো অভিব্যক্তি; কত দৃঢ়, কত আত্মবিশ্বাসী! যে সংকোচ আর ভীতি এতদিন তার চেহারায় লেগে থাকত সেসব আজ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এখন তার দৃষ্টিতে এমন আধিপত্যের ভাব যেন সে এই প্রাসাদের চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারিণী! এমনকি কোহিনূরও হতবিহ্বল হয়ে দেখছেন গুলনূরের পরিবর্তন।

ঘোড়াগাড়িটি মৃদু গতিতে মাটির সড়ক বেয়ে এগিয়ে চলতে শুরু করে। গুলনূর শানিত পিঠে বসে থাকে। এই পথ তাকে চিরতরে কান্তারপুর থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে যাচ্ছে। মহলের প্রতিটি বারান্দার স্মৃতি, প্রাঙ্গণের হর্ষ-বিষাদের গল্প, ভোরের শিশিরসিক্ত ঘাসের মাতাল গন্ধ- সবকিছু ছেড়ে আজ বিদায় নিচ্ছে সে। এত আড়ম্বর, এত দৃষ্টি, এত জাঁকজমকের মধ্যেও তার চোখ দুটি অবিরাম খুঁজে ফিরছে জাওয়াদকে। শেষবারের মতো একটু দেখা কি মিলবে না? কানে এসেছে, ভোরবেলাই নাকি সে নদী পার হয়ে গেছে শব্দরের সঙ্গে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্বজনকে নিয়ে আসতে। গুলনূর দীর্ঘশ্বাস ফেলে হৃদয়ের গহনে চাপা পড়া স্মৃতির ঢেউগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা করে।

দোতলা কাঠের বাংলো বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে রূপকথার রাজপ্রাসাদের মতো। চারিদিকে বিস্তৃত বাগানের হৃদয় থেকে হাওয়ায় মিশে আসছে মৌচাকের অমৃত সুবাস, লীন হয়ে গেছে ফুলের মাদকতা-মাখা সুগন্ধের সাথে। চাঁদের রুপালি কিরণধারা বাগানের ঘাসের উপর বিছিয়ে দিয়েছে মুক্তোর গুঁড়ার মতো শোভা। এই স্বর্গীয় পরিবেশের কেন্দ্রস্থলে, দোতলার সর্বাপেক্ষা মনোহর ঘরে বসে আছে গুলনূর। তার চারপাশে সুসজ্জিত বিয়ের সমস্ত আয়োজন। হাঁটুর উপর চিবুক রেখে গহন দুঃখ নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে জানালার দিকে। তার চোখ দুটি হারিয়ে গেছে হয়তো ফেলে আসা অথচ গভীর ক্ষত করে রাখা কোনো নিষ্ঠুর অতীতের গহ্বরে, অথবা অজ্ঞাত ভবিষ্যতের অন্ধকার প্রান্তরে, যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। পাশে সাজিয়ে রাখা টকটকে লাল বেনারসি শাড়ি, সোনালি সুতার কারুকাজ চিকচিক করছে হারিকেনের আলোয়। গহনার বাক্স খোলা পড়ে আছে। সোনার অলংকার, মুক্তোর মালা, চুনির কানের দুল, নীলকান্তের আংটি – সবকিছুই ঝলমল করছে আলোর নাচনে। কাল সকালে এসব পরেই সজ্জিতা হবে সে নতুন বধূ হয়ে, জমিদারপুত্র জাওয়াদের স্ত্রী হয়ে। ভাবতেই বুক থেকে বেরিয়ে আসে গভীর দীর্ঘশ্বাস। বুকের উপর যেন কোনো ভারী পাথর চেপে বসে আছে। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে চোখ মেলে সে। চাঁদ এখন আকাশের মাঝামাঝি। তার চারিদিকে ছোট ছোট তারারা টিমটিম করছে। আস্তে আস্তে বাতাস এসে পর্দার সাথে খেলা করছে, তারপর তার মুখ ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। সেই সাথে ধীরে ধীরে খালি হয়ে আসছে বুকের ভেতরটা। একটা শূন্যতা আস্তে আস্তে গিলে নিচ্ছে তার সমস্ত অস্তিত্বকে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে জাওয়াদের মুখ। মানুষটিকে আর কখনো দেখা হবে না, এই নির্মম বাস্তবতা বিষবাণের মতো বিদ্ধ করছে হৃদয়কে। জাওয়াদ… তার শত্রুর উত্তরাধিকারী। তবুও অন্তরের নিগূঢ় কোণে কেন এমন আকর্ষণ অনুভূত হয়! কেন তার স্মৃতিতে এত মধুর অনুভূতির সঞ্চার হয়!

‘কেন তুমি দৈত্যকুলে জন্মগ্রহণ করলে, রাজকুমার?’

তার অজান্তেই আর্তনাদ করে ওঠে ভেতরের সত্তা। প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় আকাশপানে। সেই প্রশ্নেই চমকিত হয় সে স্বয়ং। ক্রোধে, দুঃখে, হতাশায় অস্থির হয়ে পড়ে। তার কি এই ভয়াবহ ষড়যন্ত্র থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত? না! নিজেকেই তীব্র ভর্ত্সনা করে সে। নিজের সাথেই তর্কে লিপ্ত হয়, ‘সন্তানেরা যদি পিতা-মাতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়, তাহলে তাদের কৃত পাপেরও দায়ভার বহন করতে হবে। একজনের প্রতি ক্ষণিকের কৃতজ্ঞতার আবরণে আমি আমার সকল ক্ষত ভুলে যেতে পারি না।’

নিজে সাথে চলতে থাকে তার তীব্র সংগ্রাম। এক অদৃশ্য শক্তি যেন সমস্ত টানাপড়েন ছিন্নভিন্ন করতে চাইছে অন্তর থেকে। সে উঠে পড়ে পালঙ্ক থেকে। অস্থিরতায় পায়চারি শুরু করে ঘরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তার পদধ্বনি কাঠের মেঝেতে বাজতে থাকে গুমগুম শব্দে। কতক্ষণ এভাবে হাঁটাহাঁটি করেছে জানে না। শেষে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে নরম বালিশে মাথা রাখতেই সারাদিনের ক্লান্তি এসে ভর করে চোখের পাতায়। বিষণ্ণতায় ভরা চিন্তাভাবনা নিয়েই ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে। যেখানে নেই কোনো উদ্বেগ, নেই কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত। হঠাৎ দরজায় তীব্র শব্দ, সাথে দাসীর কণ্ঠস্বর, ‘বেগম সাহেবা! ছোট হুজুর এসেছেন! বেগম, শুনতে পাচ্ছেন?’

শব্দগুলো গুলনূরের স্বপ্নমগ্ন অন্তরে বিকট ঝড়ের মতো আছড়ে পড়ে। চোখের পাতা কম্পিত হয়ে ওঠে, হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত তালে নাচতে থাকে। এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে, দ্রুততায় ছুটে যায় বারান্দার দিকে। জানালার পাল্লা সরাতেই দৃষ্টিতে ধরা পড়ে, বাগানের নিভৃত কোণে দাঁড়িয়ে আছে জাওয়াদ। মুখ অন্যদিকে ফেরানো। ক্ষণিকে গুলনূরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জুড়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে যায়। জাওয়াদ এসেছে! হৃদকম্পন পতাকার মতো পত্পত্ করে উড়তে থাকে তার সত্তার সীমানা জুড়ে। আর এক নিমেষও দেরি না করে দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। দিনের বেলা যে শাড়িটি পরে গ্রামবাসীদের মুগ্ধ করেছিল, সেই শাড়ির আঁচল মেঝেতে ঝাঁকুনি খাচ্ছে, আর পায়ের তালে তালে কাঠের সিঁড়ি কড়কড় করে বাজছে। শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সমস্ত দাসীর। গুলনূরের ঘোর কেটে যায় আকস্মিক, দরজার কাছে পৌঁছেই তার অনুভূতি হয়, সে প্রেমে মত্ত নারীর মতো আচরণ করছে! বিস্ময়ে তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংযত করে। আঁচল টেনে আনে মাথার উপর, ঘোমটা নামিয়ে রাখে কপাল পর্যন্ত। তারপর পা বাড়ায় বাগানের দিকে।

পদশব্দ না হলেও জাওয়াদ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন করে গুলনূর এসেছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। পরনে তার চিরপরিচিত ইউরোপীয় সাহেবদের মতো শার্ট-প্যান্ট। গুলনূরকে দেখেই মুহূর্তের জন্য প্রস্তরবৎ হয়ে যায়। কথা বলার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে। মেয়েটার চোখে কাজলের রেখা, ঠোঁটে এখনও লালিমা লেগে আছে, গলার ঝলমলে চিকন হার, গায়ে জড়ানো মায়াবী কোমল রঙের হালকা বেগুনি শাড়ি! কী অলৌকিক সৌন্দর্য! তার হৃদয় ঢোলের মতো বাজতে শুরু করে। গুলনূর কুর্নিশ করে সম্মানপ্রদর্শন করে। জাওয়াদ এগিয়ে এসে তার একটি আঙুল দিয়ে গুলনূরের চিবুক স্পর্শ করে তুলে ধরে উপরে। চোখযুগল মিলিত হতেই কোমল কণ্ঠে বলে, ‘অপূর্ব।’

গুলনূরের গালদুটো গোলাপ দলের মতো রক্তিম হয়ে ওঠে। দৃষ্টিগোচর হয় জাওয়াদের এক হাতে একটি স্বচ্ছ কাঁচের পাত্র, যার ভেতরে জোনাকি পোকারা নৃত্য করছে। কৌতূহল জেগে ওঠে তার অন্তরে। প্রশ্নময় দৃষ্টিতে জাওয়াদের দিকে তাকায়। জাওয়াদ তার চোখের ভাষা বুঝে মৃদু হেসে বলে, ‘নতুন রানীর নিরাপত্তার জন্য আলোর ক্ষুদ্র সৈনিকদের সাথে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু এসে দেখি রানীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তার চেয়েও অধিক আলোর প্রহরী এই সমগ্র বাড়িটাই পাহারা দিয়ে রেখেছে।’ কথা বলার সময় সে চারিদিকে ইঙ্গিত করে। গুলনূর বিস্ময়ে লক্ষ্য করে, বাগান জুড়ে অগণিত জোনাকি পতঙ্গ ঝিকমিক করছে। কী হৃদয়হরণকারী দৃশ্য!

জাওয়াদ অনেকক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরেছিল। যাকে আনতে গিয়েছিল নদীর ওপারে, সেখানে পৌঁছে শুনতে পায়, ভদ্রলোকের স্ত্রী ভোরে মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যু সংবাদ শুনে সে এবং শব্দর কিছুক্ষণ স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর সেই শোক-ভেজা পরিবেশে সারাদিন কাটিয়ে রাতে ফেরে। বাড়ি ফিরে যখন জানতে পারে, গুলনূরকে পাঠানো হয়েছে বাংলোবাড়িতে, তখনই তার হৃদয়ে গুলনূরকে এক পলক দেখার আকুলতা দানা বাঁধতে শুরু করে। সে যেতে চায় তখনই…এক মুহূর্তও দেরি না করে। কিন্তু পরিবারের প্রবীণদের অনুরোধে সেই ইচ্ছেকে সাময়িক বিরতিতে রাখতে বাধ্য হয়।

বাড়িতে তখন চলছে বিয়ের আগের রাতের প্রথাগত উৎসব। প্রাঙ্গণ মুখরিত গানের সুরে, অতিথি আপ্যায়নের রমরমা, সুস্বাদু খাদ্যের সুবাসে ভরে উঠেছে বাতাস। বিশেষ অতিথিদের জন্য ছিল মদের আসর, কুসুমভরা কোলাহলের পেছনে গোপন ঐশ্বর্য! এসব আয়োজনে বাড়ির প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের উপস্থিতি অপরিহার্য বলে ধরে নেওয়া হয়।

‘কাল তো দেখা হবেই,’ এই ভেবে নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। কিন্তু রাত গভীর হলে একাকীত্বে সে অস্থির হয়ে ওঠে। মনে হতে থাকে, কেউ হৃদয়ের গহীনে বাঁধা সূতোয় ধরে অবিরাম টেনে চলেছে, কষ্টার্জিত সংযম ভেঙে যেতে থাকে একে একে। শেষমেশ সবার নিষেধ ঝেড়ে ফেলে ছুটে আসে বাংলোবাড়ির দিকে…গুলনূরের কাছে।

সে কাঁচের পাত্রটি এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘ধরো, এদের মুক্ত করে দিই।’

গুলনূর পাত্রটি ধরে, আর জাওয়াদ আলতো করে ঢাকনাটা খুলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য জোনাকি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, অন্ধকার বাগানজুড়ে আলো ছড়ায় ক্ষীণ…কিন্তু মায়াময়। ফুলের গন্ধ, পাতার স্পর্শ আর জোনাকিদের আলো মিলিয়ে স্বপ্নিল পরিবেশ সৃষ্টি করে। যেন তারা স্বপ্ন আর জাগরণের মাঝামাঝি কোথাও আছে এখন। জাওয়াদ স্বপ্নালু চোখে বলে, ‘ওদের মতোই উড়ো সারাজীবন, আলো জ্বেলে। আমি সেই আলোতে জীবন দেখব।’

গুলনূর পথভোলা বালিকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সেই দৃষ্টির গভীরে যে নির্ভেজাল কোমলতা, তা জাওয়াদকে এক মুহূর্তের জন্যও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে দেয় না। আজ গুলনূরকে অন্যরকম লাগছে! ঠিক যেন আকাশ থেকে নেমে আসা পরী। তার কানের পাশে যদি একটি গোলাপ থাকত, তবে সে সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা পেত। এই ভাবনা মাথায় আসতেই সে চোখ বুলিয়ে খুঁজে পায় কাছেই একটি গোলাপগাছ। তাড়াহুড়ো করে ফুল তুলতে গিয়ে তার আঙুলে কাঁটা ফুটে যায়। চট করে সে হাতটা সরিয়ে নেয়। গুলনূর আতঙ্কিত হয়ে ছুটে এসে জাওয়াদের হাত নিজের হাতে তুলে নেয়। অনামিকার ডগায় ফুটে ওঠা ক্ষুদ্র ক্ষত থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্তবিন্দু। উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে সে ক্ষতস্থানে চেয়ে থাকে, ভ্রু কুঁচকে যায় চিন্তায়। জাওয়াদ বলে, ‘খুবই সামান্য। কোনো গাছই চায় না তার ফুল জোর করে কেউ ছিঁড়ে নিক। তাই হয়তো একটু শাস্তি দিয়েছে।’

গুলনূর ঝোপঝাড়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে কী যেন খুঁজতে থাকে। কৌতূহল নিয়ে জাওয়াদ জিজ্ঞাসা করে, ‘কী খুঁজছো?’

মুহূর্তেই গুলনূর কয়েকটি নিরাময়ী পাতা পেয়ে যায়। যত্ন করে পাতাগুলো তুলে নিয়ে আঙুলের মাঝে নিয়ে চটকাতে থাকে। চোখের পলকে পাতাগুলো সবুজ রসে ভিজে ওঠে। সবুজ রস লেগে থাকা পাতাটা জাওয়াদের ক্ষতের উপর আলতো করে চেপে ধরে।

পুরুষ এহেন সামান্য আঘাতে ব্যথিত হয় না! ভেবে মস্তিষ্ক ক্লান্ত করে না৷ কিন্তু গুলনূরের যত্ন, প্রেমঘন উদ্বেগে মনে হচ্ছে, সে সত্যি ভীষণ আহত। বুকের গভীরে আনন্দের ঝরনা বয়ে যাচ্ছে। যদি ক্ষতটা আরেকটু বড় হতো! সে মুগ্ধতায় চেয়ে থাকে হবুস্ত্রীর দিকে। গুলনূর নরম পাতাটা ক্ষতের ওপর আলগোছে চেপে ধরে রাখে। জাওয়াদের ভাবে, এই স্বর্গীয় মুহূর্তটি যদি অনন্তকালের জন্য থেমে যেত, অনন্তকাল ধরে গুলনূর এভাবেই তার শরীর ছুঁয়ে থাকত! অনুভব করে, সাধারণ অনুভূতির চেয়ে গভীর কিছু, অদেখা আগুনের হল্কা তার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। গুলনূরকে কাছে টেনে নেওয়ার তীব্র আকুলতা, বুকে জড়িয়ে রাখার পাগলপারা বাসনা, নিঃশব্দে আরও কাছে গিয়ে তার নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার তৃষ্ণা; এসব তো আগে কখনো জেগে ওঠেনি তার হৃদয়ে! অজান্তেই মনের গোপন কোণে প্রেমের দেবতা জেগে উঠেছে, শরীরের প্রতিটি রোমকূপ থেকে গুলনূরকে আরও কাছে পাওয়ার আকুতি উঠছে! এমনকি গুলনূর যখন নিরাময়ী পাতা খুঁজছিল, সেই সুযোগে তার প্রেমাতুর দৃষ্টি গুলনূরের দেহের সুন্দর বাঁক, শাড়ির ভাঁজে লুকানো কোমরের মোহনীয় রেখা দেখে নিয়েছে। এতদিন তো এমন প্রেমময় চোখ ছিল না তার। আজ কেন এই জাদু? জাওয়াদ চমকে ওঠে নিজের পরিবর্তন টের পেয়ে। হাত সরিয়ে নিয়ে একটু দূরত্ব বজায় রেখে বলে, ‘এইটুকুর জন্য এত যত্নআত্তির দরকার নেই। যাও, ঘুমিয়ে পড়। একা একা ভয় লাগলে কোনো দাসীকে ডেকে নিও। কাল থেকে তোমার আর কোনো ভয়ের কারণ থাকবে না। আমরা একসাথে থাকব…সারাজীবন।’ বলেই হাসে জাওয়াদ। চোখ দুটিতে আলো জ্বলে ওঠে। আদুরে গলায় বলে, ‘এখন যাও, ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে অনেক ব্যস্ততা।’

গুলনূর স্বভাবের নরম বশ্যতায় কুর্নিশ করে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর ফিরে আসে সেই চিনচিনে যন্ত্রণা আর হৃদয় খালি হওয়া শূন্যতা। সে পেছনে ফিরে তাকায়। জাওয়াদ চলে যাচ্ছে…চিরতরে। ভেজা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে, ‘পৃথিবীর কারো সাধ্যি নেই তোমার-আমার মঞ্জিল এক করার।’

জাওয়াদও ফিরে যেতে গিয়ে একবার ঘুরে দাঁড়ায়। কিছুটা এগিয়ে এসেই মনে পড়ে যায়, সেদিন রাতের রহস্যময় ঘটনার পর সবাই ভেবেছিল তার মা অসুস্থতার কারণে দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছিলেন। কিন্তু সে জানত, কেউ একজন সত্যিই ছিল সাদা শাড়ি পরে! এই দুই দিন ধরে সবার ওপর নজর রেখেছে সে। সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়েনি। এমনকি সেই সাদা শাড়িটা, যেটা ওই ঘরে পড়ে ছিল, সেই কাপড়ে যে মাদক সুগন্ধ মাখানো ছিল সেটাও আর কোথাও পায়নি। কিন্তু এইমাত্র সেই একই মাদকতা ভরা সুবাস ভেসে এসেছিল গুলনূরের দেহ থেকে। জাওয়াদ দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। ততক্ষণে গুলনূর বাড়ির ভেতর মিলিয়ে গেছে রাতের অন্ধকারে।

চলবে,..

নোট: বলতে মনে নেই। ‘পৃথিবীর কারো সাধ্যি নেই তোমার-আমার মঞ্জিল এক করার।’ সংলাপটি আমি কারো মুখে শুনেছি নাকি পড়েছি ঠিক মনে করতে পারছি না। গুলনূরের অনুভূতির সঙ্গে সংলাপটি খুব মানিয়ে যাচ্ছিল। তাই দেয়া।

  • ইলমা বেহরোজ
  • Related Posts

    সেদিন ও সে [পর্ব-০২]

    পেখম? এই পলক? এই মেয়ে, তাকা আমার দিকে, কি হয়েছে তোর? কথা বল।”জবাব এলো না! ভয়ে হাত পা কেঁপে উঠল সৌজন্যের। গলা শুকিয়ে আসছে সাথে। এলোমেলো মস্তিষ্ক নিয়ে পেখমের হাত…

     প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব- ০১ ] 

    চৈত্র মাস।আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার।তবে গরম পড়েছে খুব।তিতলি ঘেমে একাকার।উড়নার এক পাশ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে কলিং বেল চাপে।টুকি দরজা খুলে। তিতলিকে দেখে সালাম দেয়।তিতলি সালামের জবাব দিয়ে দরজা বন্ধ করে…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You Missed

    সেদিন ও সে [পর্ব-০২]

    সেদিন ও সে [পর্ব-০২]

     প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব- ০১ ] 

     প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব- ০১ ] 

    প্রণয় প্রহেলিকা [পর্ব- ৩১]

    প্রণয় প্রহেলিকা [পর্ব- ৩১]

    সেদিন ও সে [পর্ব-০১]  

    সেদিন ও সে [পর্ব-০১]  

    বাহারি স্বপ্ন [পর্ব-৩০]

    বাহারি স্বপ্ন [পর্ব-৩০]

    প্রণয় প্রহেলিকা [পর্ব-৩০]

    প্রণয় প্রহেলিকা [পর্ব-৩০]