
বাবার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সাহস হয় না। জানি, মায়ের সামনে দাঁড়ালে প্রশ্নের পাহাড় নিয়ে বসবে,
-‘কোথায় ছিলি তুই?’
-‘এভাবে কেউ বাড়ি ছেড়ে যায়?’
-‘সংসারে তো ঠোকাঠুকি হয়ই, তাই বলে চলে যাবি।’
যেগুলো আমার মনখোঁড়ানো ক্ষতের ওপর নুনের ছিটার মতো জ্বালা ধরাবে।
তিনি এখন নিজের বড় দুই ভাইয়ের অকৃত্রিম স্নেহের ছায়ায় বেশ নিরাপদেই আছেন। তাকে নিয়ে চিন্তা করার কোনো অবকাশ নেই। বয়স হয়েছে, তবুও তাদের আদরে কোনো ঘাটতি নেই। একমাত্র বোন বলেই হয়তো এই অটল মমতা। জন্মানোর পর থেকেই মামাদের ভালোবাসার বলয় প্রতিরক্ষার আবরণ হয়ে ঘিরে রেখেছে মায়ের সমগ্র অস্তিত্ব। এতো আদরের বোন হয়েও সংসারের নামে নীরবে সহ্য করে গেছেন স্বামীর নির্যাতন। মুখ বুজে, নিঃশব্দে অশ্রু গিলে গিলে কাটিয়েছেন যৌবনের স্বর্ণালী দিনগুলো। নারীর জীবন এতটা সহনশীল কেন? কেন এই অসীম সহ্যক্ষমতা, কেন এই আত্মহুতি? আদর, স্নেহ, ভালোবাসা প্রাচুর্য থাকার পরেও কেন একজন নারী দিনের পর দিন মুখ বুজে মেনে নেয় অন্যায়? কী রহস্যময় নারীর জীবন! সংসারই তাদের কাছে পরম সত্য। আমিও কি এই সংসারের টানে গত পাঁচটি মাস পুড়িনি?
ক্লান্ত, ঝিমিয়ে পড়া হৃদয়টা নিয়ে পৌঁছে গেলাম শহরের সীমানা ঘেঁষে থাকা এক বিলাসবহুল রিসোর্টে। যেখানে কেউ নেই, নেই চিনে ফেলার ভয়, নেই কোনো চেনা মুখের উপচানো প্রশ্ন। শরীর তখন নিজেরই ভার সইতে পারছিল না। একরকম নিজেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে ঢুকলাম নির্দিষ্ট ভিলায়। ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়াতেই থমকে গেলাম। ভীষণ চমকে উঠলাম নিজেকে দেখে। কেমন বিবর্ণ, ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চোখের নিচে লম্বা জলের দাগ। আমি কাঁদছিলাম? কখন? কেন? তৈমুরকে ছেড়ে দ্বিতীয়বারের মতো চলে আসার কষ্টে? এ কী করে হয়!
বাইরে তখন গোধূলির আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। জানালার পর্দাটা একটু সরিয়ে তাকালাম। কাচের ওপারে দেখা গেল কৃত্রিম জলপ্রপাত, সাদা জলধারা গড়িয়ে পড়ছে পাথরের গায়ে। তার পাশেই ছোট ছোট নুড়ি পাথর, বুনো ঘাসের পাতায় লেগে থাকা হলদে আলো। সবুজে মোড়া বাগানে কিছু অচেনা ফুল মাথা নাড়িয়ে যেন অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। বাতাসে মৃদু সৌরভ।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এলো জানালার ফাঁক গলে। সেইসাথে কোথাও থেকে ভেসে আসছিল মৃদু গানের সুর।দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালাম। তৃষ্ণার্ত শরীর, ক্লান্ত মনের ভার ধুয়ে ফেলতে ঢুকে পড়লাম গোসলখানায়। জলের ছোঁয়ায় যদি কিছুটা হালকা হয় হৃদয়ের বিষাদ।
গোসল সেরে একরাশ জলভেজা ক্লান্তি নিয়ে বের হয়েছি মাত্র, এমন সময় দরজায় হালকা শব্দ হলো। কৌতূহলে দরজার ছিটকিনি খুলে দিলাম। পর মুহূর্তেই বুকের ভেতর কেমন ছ্যাৎ করে উঠল। তৈমুর! শরীর মুহূর্তেই শীতল হয়ে গেল, পেছনে ঘুরে ঘরের ভেতর পালানোর মতো সরে আসি অজান্তেই।
তৈমুর পেছন থেকে জাপটে ধরে ফেলল। নিঃশ্বাসটা আটকে এলো। স্নায়ুকোষগুলো যেন একসাথে থেমে গেল। বুকের ভেতর হঠাৎই যেন একের পর এক শব্দহীন গুলির শব্দ; তীব্র, কাঁপানো, বেপরোয়া। এতো মধুর কি কখনো লেগেছিল ওর স্পর্শ?
কতদিন ধরে এই স্পর্শ পাইনি! পাঁচ মাস- আক্ষরিকভাবে প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত আমি বয়ে বেড়িয়েছি অভিমান, রাগ আর ক্ষোভের বিস্ফোরণ। তবু যখন ওর হাত আমার গায়ে এলো, মনে হলো পুরো পৃথিবী কেঁপে উঠল। মাথা ঝিমঝিম করছিল। এই সেই মানুষ, যে আমাকে কষ্ট দিয়েছে, ভেঙে দিয়েছে, পুড়িয়ে দিয়েছে। তবু কেন এত তীব্র অনুভব? কেন?
ও আমার ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে বলছিল, ‘আর পালাতে দেব না তোমায়… আর না…’
এই কণ্ঠটাই তো আমি গত পাঁচ মাস ধরে শুনতে চেয়েছি! প্রতিটা দিন, প্রতিটা রাত ওর গলা শুনব বলে কী ভয়াবহ রকমের হাঁসফাঁস করেছি! আমার ঘোর লেগে গেল। আমি নিজেকে সেই ঘোর থেকে বের করে আনতে চাই। প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করি সেই বিষাক্ত দিনগুলো, যেদিন আমি ভেঙে পড়েছিলাম। শরীরের সব শক্তি একত্র করে ওকে ঠেলে সরিয়ে দিলাম। কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, কিন্তু কথাগুলো ছুরির মতো বেরিয়ে এলো, ‘দূরে থাকো, কাছে আসবে না।’
তৈমুর নাছোড়বান্দা। আবার এগিয়ে এলো। আমাকে জড়িয়ে ধরল। চোখে, গালে, কাঁধে, গলায় নামিয়ে আনল বৃষ্টির মতো চুম্বন। আর কানে কানে বলছিল, ‘জানতাম তুমি আসবে…
আমাকে ছেড়ে বেশিদিন থাকতে পারবে না…’
ওর স্পর্শ, ওর কথা শিমুল তুলার মতো নরম অথচ আমার দেহে জ্বলন্ত স্পর্শ হয়ে লাগছিল৷ আমি বোঝাতে পারব না, কী ভয়ানক দুর্বল করে দিচ্ছিল আমাকে ওর পাগলামি। কিন্তু আমি হেরে যেতে চাই না। শুধু স্পর্শের কাছে, অনুভূতির কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে চাই না। আমি ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘গায়ের জোর দেখাবে না, প্লিজ! আল্লাহর দোহাই, দূরে থাকো! আমি কিছুই ভুলে যাইনি। কেন পিছু পিছু এলে? আমি এখুনি চলে যাব!’
রাগে, কষ্টে, অভিমানে আমার হাত-পা কাঁপছিল। আমি তড়িঘড়ি করে স্যুটকেস গুছাতে শুরু করলাম। মনে প্রশ্ন জাগল, রিসোর্টের মত প্রাইভেট জায়গায় ও কীভাবে ঢুকে পড়ল?
পরে জেনেছিলাম, ও আমার পিছু পিছু এসেছিল। রাস্তায় সিনক্রিয়েট হতে পারে সেই আশঙ্কায় দূর থেকে অনুসরণ করেছে। এই সিনক্রিয়েটই তো আমাকে ওর কাছ থেকে ছিটকে দিয়েছিল একদিন! তাই এবার রাস্তায় কিছু না বলে, সোজা পাশের ভিলায় উঠেছে।
চাইলেই আমি চেঁচাতে পারতাম। তাহলেই নিরাপত্তা কর্মীরা এসে ওকে এই ভিলা থেকে বের করে দিত।
কিন্তু আমি চেঁচালাম না। হয়তো অবচেতনে আমি চেয়েছিলাম ওর সম্মানটুকু বাঁচুক। অথবা হয়তো আমি এখনও ওর একটুখানি কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলাম, অস্বীকার করলেও সত্যটা এই! আমার মন, আমার আত্মরক্ষার দেয়ালের পেছনে কোনো এক অনুভব নিঃশব্দে ঢুকে ছিল। তৈমুর এগিয়ে এসে স্যুটকেসটা সরিয়ে অনুনয়-বিনয় করতে লাগল, ‘তুমি কোথাও যেতে পারবে না। আমি আর তোমাকে যেতে দেব না। প্লিজ থামো… আর না।’
আমি কঠিন গলায় বললাম,
‘হাত ছাড়ো, নয়তো আমি চেঁচাব।’
ও থামল না। শুধু কণ্ঠটা আরও নরম করে বলল, ‘এভাবে হারিয়ে যেও না। সরি বলছি আমি। আমাকে একবার… আরেকটিবার বলার সুযোগ দাও অন্তত…’
আমার ঠোঁটে তিক্ত হাসির রেখা ফুটে উঠল। ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম, ‘সরি? তোমার সেই বিখ্যাত সরি? যার উঠতে-বসতে কোনো কমতি নেই! তুমি নিজেও জানো, তুমি আবারও একই ভুল করবে! তোমার সরি মানেই নতুন ভুলের ছাড়পত্র।’
বুড়ো আঙুল তুলে, ওর চোখে চোখ রেখে ঠাণ্ডা গলায় বললাম, ‘এই সরির এক বিন্দু মূল্য নেই তৈমুর। এক বিন্দুও না।’
তৈমুরের চোখে জল টলমল করছে, তবুও আমার কথায় দমে গেল না। আবার জড়িয়ে ধরল, আরও ব্যাকুল হয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘তুমি যা বলবে তাই করব…
যা করলে তুমি ফিরে আসবে, যা বললে তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না, আমি তাই করব… আমি বদলে যাব… শুধু আমাকে আর একটিবার সুযোগ দাও…’
ও এমনই! মাফ চাইবে এমনভাবে যে ক্ষমা না করে উপায় নেই। আমি সেই ফাঁদে বহুবার হেঁটেছি, ভেবেছি হয়তো এবার সত্যিই পাল্টে যাবে। কিন্তু না, এবার আর নয়। আমি ঠেলে সরিয়ে দিতে দিতে বললাম, ‘নাটক করবে না, প্লিজ। সরে যাও।’
তৈমুর মুখ তুলল। দুটো হাতে আমার গাল ছুঁয়ে চোখে চোখ রাখল। ওর চোখে জমে থাকা জলের ঝিলিক আমার সমস্ত প্রতিরোধকে নরম করে দিতে চাইল। আমি অনুভব করছিলাম, আমার বুকের বরফ গলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। শুধু গলেই যাচ্ছে না, মিষ্টি শরবতে পরিণত হচ্ছে৷ ওর স্পর্শ, ওর বাহুর জোর সবকিছুই আমার প্রতিদিনের অভ্যাস ছিল। চেনা উষ্ণতা আমাকে তীব্র গতিতে টানছে ওর দিকে।
তৈমুর কাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘তুমি পারবে আমাকে ছেড়ে থাকতে?’
আমি এক পা পিছিয়ে গিয়ে আবারও হাসলাম। বললাম, ‘থাকিনি? পাঁচটা মাস কম নয় তৈমুর।’
তৈমুর তখন থেমে গেল। আহত চোখে তাকিয়ে রইল, যেন ভেবেই উঠতে পারছে না, তার চেনা মানুষটা এমন বদলে গেল কীভাবে! আমি ওর সেই আহত চোখ দেখতে পারছিলাম না। চোখ ফিরিয়ে নিলাম। দ্রুত স্যুটকেস গোছাতে লাগলাম। এই জায়গায় আর নয়। এই সম্পর্কের গোলকধাঁধায় আর ফেরা নয়।
পেছন থেকে তৈমুরের কণ্ঠ ভেসে এলো,
‘তোমাকে সেদিন থেকে পাগলের মতো খুঁজেছি। মিসিং ডায়েরি করেছিলাম… পুলিশ খুঁজেছে, তোমার মামারাও চারদিকে খুঁজেছে। পাসপোর্ট ট্রেস করে জেনেছিলাম তুমি ইন্ডিয়ায় গিয়েছিলে। আমিও সেখানে গিয়েছিলাম… থেকেছি দুই মাস… রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি, একেকটা স্টেশনে, হোটেলে, টার্মিনালে খুঁজেছি। সব জায়গায় গেছি, যেখানে একটু হলেও সম্ভাবনা ছিল। তুমি ছিলে না কোথাও। তখন বুঝলাম, যে মানুষ নিজেই হারিয়ে যেতে চায়, তাকে কি আর খুঁজে পাওয়া যায়?’
ওর কণ্ঠটা নরম হয়ে এলো, ‘তারপর থেকে অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত। আমার সেই অপেক্ষা আজ পূর্ণ হয়েছে…তুমি ফিরে এসেছো। প্লিজ, আর চলে যেও না। তোমাকে ছাড়া আমার কোনো মূল্য নেই, আমি থাকতে পারি না…’
আমি নিঃশব্দে শুনছিলাম ওর কথা। পিঠটা তখনও ওর দিকে, তাই ও দেখতে পেল না, আমার চোখ বেয়ে নেমে এসেছে দু’ফোঁটা জল। বলতে পারলাম না, আমিও ভালো ছিলাম না। তোমার অনুপস্থিতি আমায় প্রতিদিন একটু একটু করে গিলে খেয়েছে। বরং কাঠ কাঠ গলায় বললাম, ‘আমাকে আঘাত করার আগে এসব ভাবা উচিত ছিল তোমার।’
ও ধীরে ধীরে এসে আমার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। বলল, ‘আমি সরি, অলকা। আমাকে ক্ষমা করো। আমি ভুল করেছি, মহাভুল। আমি অন্যায় করেছি… অপরাধ করেছি। তুমি যা চাও শাস্তি দাও, তবুও প্লিজ দূরে যেও না…’
আমি তখন স্যুটকেস গুছিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছি। ওর চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘সরি বললেই সব অপরাধ মাফ হয়ে যায় না। ভালো থেকো।’
আমি ঘুরে দাঁড়াতেই, ও জড়িয়ে ধরল আমাকে। দুই হাতে পেট আঁকড়ে ধরে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলল, কাঁধে নিঃশ্বাসভেজা চুমু দিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে যেতে দেব না…’
আমি ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করলাম,
‘ছাড়ো।’
‘ছাড়ব না।’
‘আমি চেঁচাব…’
‘চেঁচাও।’
‘তৈমুর, প্লিজ!’
‘তুমি যাবে না…’
আমি গলার স্বর শক্ত করে বললাম, ‘তোমার সঙ্গে থাকলে আমি তিলে তিলে মরব। আমার সুখ নষ্ট করো না, প্লিজ। আমি কেবল একটু ভালো থাকতে চাই…’
তৈমুর তবুও ছাড়ল না, কাঁধ থেকে মুখ তুলে বলল, ‘আমি নিজেকে বদলেছি, অলকা…একবার অন্তত আমাকে সুযোগ দাও।’
আমি ওর বাঁধা হাত থেকে বেরিয়ে পালাতে চাইলাম। একটু আলগা হয়েও গেলাম৷ বললাম, ‘বহুবার তোমায় সুযোগ দিয়েছি, আর নয়…’
ও আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, জলভেজা চোখে বলল, ‘আর একবার… আর একবার অলকা…আমি সত্যিই অনুতপ্ত…’
আমি ওর বাহু থেকে নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিলাম। স্যুটকেস হাতে দরজার দিকে এগোতে এগোতে ঘৃণা মেশানো কণ্ঠে বলে উঠলাম, ‘অন্য কাউকে সুযোগ দেব, তাও তোমায় না।’
পেছন থেকে সঙ্গে সঙ্গে জবাব এলো, ‘ভুল কি কেবল আমারই ছিল? তোমার কোনো দায় ছিল না?’
আমি থমকে দাঁড়ালাম। চোখ বন্ধ করলাম এক মুহূর্ত, যেন নিজেকে সামলাতে পারি। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম, ‘এখন তুমি ভিক্টিম সাজবে? সত্যিই?’
তৈমুর এগিয়ে এসে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল। বলল, ‘ভিক্টিম সাজার মানসিকতা তোমার। আমার না।’
আমি স্যুটকেসটা শব্দ করে মেঝেতে ফেলে দিলাম। চোখ রাঙিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘আমি ভিক্টিম সাজি? তুমি আমাকে দুবার চড় মেরেছ, একবার সবার সামনে, পাব্লিক প্লেসে!
একবার গলা চেপে ধরেছিলে! আর রোজ রোজ তো ছিলই অপমান, অবহেলা, ছোট করা…তবুও বলবে আমি ভিক্টিম সাজছি? ভিক্টিম নই?’
তৈমুর তীব্র শ্বাস টানল, ওর গলার স্বর থরথর করছে, ‘বলতো, শেষ কবে তুমি আমাকে সরি বলেছ?’
আমি চুপ হয়ে গেলাম।
তৈমুর চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ মনে করতে পারছো না, তাই তো? কারণ তুমি কখনোই সরি বলোনি। আর আজ বলছো, আমার সরির কোনো দাম নেই!
একটা সরি, অলকা…আমার কাছে এই একটা শব্দের অনেক মূল্য ছিল…’
আমি ঠোঁট কামড়ে বললাম, ‘ আমি কখনো অন্যায় করিনি তোমার সঙ্গে। তাই সরি বলার দরকার পড়েনি।’
তৈমুর মাথা নাড়ল, ‘তুমি নিশ্চিত তো, কখনো অন্যায় করোনি?’
আমি থমকে গেলাম। চোখ কাঁপছিল। মনে মনে গুনে যাচ্ছিলাম, কোথাও কি আমি ভুল করেছিলাম? নির্ভর কণ্ঠে জবাব দিলাম, ‘না। অন্তত ইচ্ছে করে কিছু করিনি।’
তৈমুর মৃদু হেসে বলল, ‘মানুষ শুধু নিজের ব্যথা মনে রাখে। কার মনে কীভাবে ছুরি বসিয়েছিল সেটা খুব সহজে ভুলে যায়।’
আমার হৃদয়ে ঝাঁকুনি খেল। উত্তেজিত হয়ে বললাম, ‘তুমি এখন আমাকে দোষারোপ করছো? প্লিজ, তোমার আসল রূপটা দেখিও না। যাওয়ার আগে অন্তত একটা ভালো স্মৃতি দাও। শেষটায় একটু শ্রদ্ধা রেখো।’
‘আমিতো বিদায় চাই না।’
‘কিন্তু আমি চাই, এটাই হোক আমাদের শেষ।’
তৈমুর এক পা এগিয়ে এলো, আমার দিকে ঝুঁকে বলল, ‘আমার অপরাধের শাস্তি এত বড় কেন? তাহলে তোমার অপরাধের শাস্তিও তো তোমাকে পাওয়া উচিত। সেটা কি তুমি পেয়েছো? আমি যদি তোমাকে শারীরিকভাবে কষ্ট দিয়ে থাকি, তুমি মানসিকভাবে ধ্বংস করেছো আমাকে। তাই তোমাকেও শাস্তি পেতে হবে৷ তোমার শাস্তি হচ্ছে, আমি তোমাকে চাই। আমার সঙ্গে তোমাকে থাকতে হবে।’
আমি একপা পেছনে সরে এলাম। বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললাম, ‘আমি ধ্বংস করেছি?’
তৈমুর শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘করেছো…কিন্তু মনে রাখোনি। তুমি শুধু মনে রেখেছো, আমি তোমাকে কীভাবে কষ্ট দিয়েছি।’
ওর অভিযোগ আমি নিতে পারছিলাম না। আমার ভেতরটা জ্বলে উঠল। চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘আমি কী করেছি হ্যাঁ? কী করেছি? বলো, কী করেছি? কেন মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছো?’
‘তোমার কিছুই মনে নেই?’
আমি রাগে-দুঃখে থরথর করে কাঁপছিলাম, ‘না, মনে নেই। কী করেছি আমি?’
‘বিয়ের পর থেকে তুমি আমাকে একটা রিমোট কন্ট্রোল খেলনার মতো চালাতে চেয়েছ। যেকোনো সিদ্ধান্তে তোমার মতটাই চলেছে৷ আমার কোনো কথা তুমি শোনোনি, যেন আমি আছি শুধু তোমার সিদ্ধান্তে সায় দেওয়ার জন্য।
আমি সবসময় ব্যবসা করতে চেয়েছি, নিজের একটা কিছু দাঁড় করাতে চেয়েছি। হ্যাঁ, প্রথমদিকে লস হচ্ছিল, লাভ আসছিল না, তখন তুমি বলেছিলে, চাকরি করো, বলেছিলে তোমার বাসায় মিথ্যে বলতে, যেন আমি কোনো উঁচু পদে কর্পোরেট জব করি। আমি রাজি ছিলাম না মিথ্যে বলতে। জীবনে কখনো বলিনি, তবুও বলেছি, তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে। তোমার ভালোবাসার জন্য নিজের বিবেকে ফাটল ধরিয়েছি।
তুমি খুব দ্রুত রেগে যাও। রেগে গিয়ে বহুবার আমার হাত চেপে ধরেছো, নখ দিয়ে খামচে দিয়েছো। আমি কি ব্যথা পাইনি, অলকা? পেয়েছি। কিন্তু কখনো সেটা নিয়ে প্রতিবাদ কিংবা অভিযোগ করিনি। কারণ, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
তুমি সবসময় অস্থির থাকো, যা চাও সঙ্গে সঙ্গে চাও। কিন্তু জীবনটা তো মাইক্রোওয়েভ ওভেন নয় যে একটু তাপ দিলেই সব রেডি হয়ে যাবে! আমি প্রতিদিন ভয়ে থাকতাম কখন তুমি আবার রেগে যাবে।
বিয়ের প্রথম বছর- যেখানে সম্পর্কটা রোমান্টিক আর স্বপ্নের মতো হওয়া উচিত ছিল। সেটা হয়ে উঠেছিল টক্সিক, পেইনফুল।
এক বছর আমি সহ্য করেছি কোনোরকম প্রতিবাদ ছাড়া৷ তারপর তৃতীয়বার যখন আমি লস খেলাম তুমি রাগে বলেছিলে, ‘তোমাকে দিয়ে ব্যবসা হবে না, চুড়ি পরে ঘরে বসে থাকো, কাপুরুষ।’
এই কথা শুনে আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। বলো তো, ব্যথা কি শুধুই শারীরিক হয়? হৃদয়ের হয় না? তোমার কথাগুলো আমায় গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ভেতরে ভেতরে। আমি চাইছিলাম তুমি আমার পাশে থাকো, জাজ না করো, সাহস দাও, সাপোর্ট করো। সেটা যখন হলো না, উল্টো এভাবে বললে না চাইতেও হাত উঠে গিয়েছিল। আমি মানছি, আমার উচিত ছিল অন্যভাবে রাগ কমানো, থাপ্পড় দেয়া উচিত হয়নি, আমি সেটা স্বীকার করি, সরিও বলেছি। মাফ চেয়েছি, বলো চাইনি? তুমি মাফ করেছো বটে, কিন্তু তারপর থেকে তুমি আর কখনো নর্মালি মেশোনি আমার সঙ্গে।
‘রূপ, লাবণ্য, ক্যারিয়ার, টাকা সব কিছু থাকা সত্ত্বেও আমি কেন সহ্য করব ওর মতো ছেলের থাপ্পড়?’
এই ভাবনা তোমাকে ধীরে ধীরে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। কিছুদিন পর তুমি নরম হয়েছিলে, নিজে থেকে কাছে এসেছিলে, আমি ভেবেছিলাম, ফাইনালি তোমার ভেতরের গ্লানি কেটে গেছে। কিন্তু (ফিজিক্যাল) ইন্টিমেসির পরে তুমি হঠাৎ এমন একটা কথা বললে যে, আমার ভেতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
একটা কল আসায় আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, বের হব কি না। তুমি বলেছিলে, ‘আমি কি তোমার প্রস্টিটিউট? কাজ শেষ আর টাকা দিয়ে চলে যাব?’ আরও বলেছিলে, ‘সেই টাকাটাও তো তোমার নাই।’
তখন আমি… আমি সহ্য করতে পারিনি।
আমার ভেতরে রাগ, অপমান, অভিমান একসাথে ফেটে পড়েছিল। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল, তোমার কণ্ঠটা চিরতরে থামিয়ে দিতে। আমি রাগ বশবর্তী হয়ে
গলা চেপে ধরেছিলাম।
অলকা, আমি তো শুধুই বলেছিলাম, একটা জরুরি কল এসেছে, আমাকে বের হতে হবে। তোমার অনুমতি চেয়েছিলাম। দ্যাটস ইট! তুমি চাইলে যেতাম, না চাইলে না যেতাম। কিন্তু তোমার ইগো হার্ট হয়েছিল। তুমি ভুল বুঝেছিলে, ভেবেছিলে তুমি নিজে থেকে কাছে এলে, আর আমি বের হয়ে যাচ্ছি। তুমি আমাকে অপমান করতে চেয়েছিলে কথাটা বলে… অথচ নিজেকেই অপমান করেছিলে।
তুমি শুধু মনে রেখেছো, আমি তোমার গলা চেপে ধরেছিলাম, কিন্তু তার আগে তুমি কী বলেছিলে, তা কি মনে রেখেছো? তারপরও আমি সরি বলেছি, ফিরিয়ে এনেছি তোমাকে।
একজন ছেলে যখন বারবার ব্যর্থ হয়, সবাই তাকে লুজার ভাবে। আমি জানি, পুরুষ মানেই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সেই যুদ্ধে আমি একা ছিলাম না, তুমি ছিলে পাশে, কিন্তু সাহসের বদলে তুমি বারবার আমাকে ছোট করেছো। কারণ তুমি চাওনি ব্যবসা করি। তুমি চেয়েছ হয় চাকরি করি অথবা বিদেশ স্যাটেল হই।
আমি জানি, তুমি আমাকে ভালোবাসো।
তুমি বিশ্বাস করো আমায়। আমার জ্বর হলে, আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে এলে, তুমি দিশেহারা হয়ে পড়ো। তুমি আমাকে বিয়ে করতে নিজের বাবার সঙ্গে লড়াই করেছো। কখনো কোনো ছেলেকে বন্ধুও অবধি বানাওনি। আমাকে নিয়েই সারাজীবন থেকেছো। আমাকেই তোমার জীবন ভেবেছো, আমার সঙ্গে ভালো থাকতে চেয়েছো। শধু বুঝলে না, পুরুষ মানুষও ব্যথায় ভেঙে পড়ে, শুধু শরীর নয়, কথাও ব্যথা দেয়।
যতবার তুমি বাবার বাড়ি চলে গিয়েছো,
আমি তোমাকে অনুরোধ করে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি। তারপর তোমার বাবার মৃত্যুর পর, তুমি চুপ হয়ে গেলে। তোমার হাসি হারিয়ে গেল, শরীর দূর্বল হচ্ছিল। আমি চিন্তায় ব্যবসায়ও সময় দিতে পারছিলাম না। ডাক্তার দেখাতে তোমাকে ঢাকা নিয়ে গেলাম জোর করে৷ কিন্তু তুমি ইচ্ছে ভীড়ের মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলে। যেন খুঁজে না পাই। তুমি একবারও ভাবোনি, আমি কেমন দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম! একটা একটা করে প্রতিটি বোরকা-নিকাবওয়ালা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম। শেষমেশ যখন তোমার চোখ দেখে চিনেছিলাম, তুমি আমায় দেখেও পেছন ফিরে চলে যেতে লাগলে। শুধু এই কারণে যে, আমি তোমায় ডাক্তার দেখাতে এনেছি। তখনও আমি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। একটা থাপ্পড় মেরেছিলাম, আমি খুব বড় অন্যায় করেছি। পুরনো অভিমান, জমানো রাগ, তোমার প্রতি ক্রোধ, নিজের প্রতি হতাশা, সব মিলে আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি পরক্ষণেই বুঝেছিলাম আমার ভুল। আমি প্রয়োজন হলে তোমার পায়ের নিচে পড়ে যেতাম। যদি তুমি থেকে যেতে। কিন্তু তুমি হারিয়ে গেলে।
আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল কি জানো? এই দীর্ঘ সম্পর্কজুড়ে, আমি তোমাকে কখনো সরি বলার জায়গা দিইনি। দোষ যারই হোক, আমি সরি বলেছি। এজন্যই তুমি নিজের অজান্তে ভেবে নিয়েছিলে, তোমার কোনো দোষ নেই। তুমি কখনো অন্যায় করোনি…করো না। আর সেই বিশ্বাস থেকেই, তুমি আমায় যত কষ্ট দিয়েছো, তা কখনো তোমার চোখে ধরাই পড়েনি।’
তৈমুর থামল। প্রাণভরে শ্বাস নিল। ওর চোখ গড়িয়ে জল পড়ছে৷ ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাদের সম্পর্কটা এমন কেন হয়ে গেল, অলকা? ভালো তো কম বাসিনি। তুমিও তো কম বাসোনি।’