
পেখম বিকেলবেলা কটেজ থেকে বেরিয়ে সাজেকের পথ ধরল। পায়ের নিচে ভেজা মাটি, মাথার উপর মেঘে ঢাকা আকাশ, আর মিষ্টি পাহাড়ি হাওয়া। পেখম এখানে কিছুই চেনে না তাই কোথাও যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়নি। তাই ভাবল নিজের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য পাহাড়ি পথ ধরে এগিলে মন্দ হয় না। একবার ভেবেছিল নওশিরকপ ডাকবে, তবে কি মনে করে আর ডাকেনি। পেখম হাটতো হাটতে বাজারে চলে এসেছে তাই এখানে যে ছোট ছোট দোকান আছে সেগুলোতে ঘুরল, কাঠের তৈরী একটা চুড়ুনী আর একটা শোপিস কিনল নিজের জন্য।
আরেকটু এগোতেই এখানের এক নাম করা রেস্তরা দেখে থমকালো তারপর আশেপাশে একটা বাচ্চা দেখে থমকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার কাছে এগিয়ে গেলো। ছেলেটা মাটিতে বসে খেলছি, পেখমকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। পাহাড়ি বাচ্চা ছেলে, দেখতে কি মায়াময় তার চেহারা। পেখমের বুকে যেন চাপ দিল। তবুও মিজেকে শক্ত রেখে ছেলেটার মাথায় হাত রেখে নাম জিজ্ঞেস করতেই বাচ্চা ছেলেটা নিষ্পাপ মুখে বলল,
‘তাইংহো চাকমা!’
মিষ্টি হাসল পেখম। তারপর আবারো জিজ্ঞেস করল,
‘বাসা কোথায় তোমার বাবা?’
বাচ্চা ছেলেটা হাত দিয়ে অদূরে একটা বাড়ি দেখাল। পেখম দেখল তারপর ফের জিজ্ঞেস করে,
‘খেয়েছ?’
মাথা নাড়ল ছেলেটা। সে খায় নি। তাই পেখম চোখ ঘুরিয়ে রেস্তরাটা দেখে বলল,
‘আমার সাথে ওই রেস্তরায় খাবে?’
ছেলেটা অনেকটা সময় তাকিয়ে পেখমকে দেখল। পেখমের মুখটা বাচ্চা বাচ্চা আদলে হলেও একটু বিদেশীদের মত। হবেই বা না কেন? বাবা তুর্কীশ আর মা বাঙ্গালী যে। পেখমের লালচে চুল গুলো বাঁধা মাথার উপর। কালো জ্যাকেট পড়া, সন্ধ্যার পর পাহাড়ে একটু ঠান্ডা ঠান্ডা পড়ে। ছেলেটা এতোটা সময় পেখমের দুকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পেখম ফের জিজ্ঞেস করে,
‘কি হলো? খাবে আমার সাথে?’
এবার ছেলেটা সম্মতি জানায় তাই পেখমও খুশি হয় আর ছোট পাহাড়ি ছেলের সঙ্গে রেস্তরায় যেয়ে সেখানকার বিখ্যাত খাবার গুলো খেল।
সেখান থেকে যখন বের হলো। ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে পাহাড়ের আড়ালে। আকাশে ছড়িয়ে গেছে কমলা নীল রঙ। রাতের আঁধার একটু একটু করে নেমে এলো ধরনীতে।
ফিরে আসার পথটা একটু অন্ধকার আর নির্জন। হঠাৎ সামনের একটা বাঁকে পেখম নওশিরকে দেখতে পেল, নওশির একা দাঁড়িয়ে আছে, সম্ভবত সে-ও ঘুরতে বেরিয়েছিল। পেখম আর দাড়ালো না। নওশিরের কাছে দৌড়ে যায় তারপর আচমকা জিজ্ঞেস করে—–
‘আপনি এখানে কী করছেন?”
নওশির পাশে তাকাল, পেখমকে দেখে চোখে প্রশান্তি নামল। সাথে শীতল গলায় জবাব দিল—–
‘এমনি হাঁটছিলাম।’
পেখম হেসে ফেলল, তারপর বলল—–
‘তাহলে ভালোই হল, আমি একা একা হেঁটে ভীষণ বোর ফিল করছিলাম। আসুন একসাথে হাটি! আমি শুনেছি ওই মাচাং এর পর এলটা সুন্দর জায়গা আছে। চলুন, চলুন, এক সাথে যাই। তাহলে আমার বোরও কম লাগবে।’
পেখমের একসাথে এতো কথা বলা দেখে নওশির প্রথমবারের মত সামান্য হাসল। পেখম নিজেই এগিয়ে গিয়ে পাশে দাঁড়াল নওশিরের তারপর নিজে থেকেই নওশিরের হাত ধরল আর বলল—–
‘আমি এখানে কয়েকটা দিন আছি। আপনিও একা, আমিও একা! নিশ্চয়ই বোর হচ্ছেন। চলুন আমরা এক সাথে ঘুরি তাহলে আর বোরিং লাগবে না। আর ট্যুরটাও বেশ জমবে।’
নওশির পেখমের কথায় নির্জীব দৃষ্টি রাখে পেখমের মুখে তারপর জিজ্ঞেস করল,
‘কয়দিন থাকবেন?’
পেখম কাধ উঠিয়ে নিঢষ্পাপ স্বরে বলল,
“জানি না। তবে বেশি কয়দিন থাকার চেষ্টা করব।”
তারপর আর কোনো কথা হল না। দুজনেই হাঁটতে শুরু করল। ধীর ও নরম পায়ে, শান্ত চুপচাপ ও নিস্তদ্ধ, একে অপরের পাশে যেন কত আত্মার আত্মীয় তারা! এখানে কোনো জোর নেই, না কোনো প্রশ্ন তাদের মাঝে। শুধু হুট করেই শান্ত সন্ধ্যায় পাহাড়ি বাতাসে আদুরে মুহুর্ত আআর পেখমের এক টুকরো অতীত। যা এখন আর পেখমকে টেনে রাখতে পারচে না।।
—
ওরা কোটেজে ফিরেছে রাত দশটার পর। পেখম কি মনে করে নওশিরের দরজার কাছে এসে থমকায় তারপর আবারো চলে যেতে নিয়েও দরজাটায় নক করে, তবে পেখমের আলতো ধাক্কায় দরজাটা খুলে যায়, তাই একটু কপাল কুঁচকায় আর ঘরে ঢুকতেই দেখল, নওশির বিছানার পাশে বসে চোখ বুঁজে আছে। কপালের কাছে আঙুল দিয়ে আলতো হাতে চাপছে। নওশিরের মাথাব্যথা করছে নিশ্চয়ই। পেখম চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল আর বলল,
‘আপনার যদি মাথাব্যথা হয়, আমি অয়েল ম্যাসাজ করে দেই? ছোটবেলায় দিতাম মনে আছে?’
নওশির চোখ বন্ধই রাখে জবাবে কিছু বলল না। পেখমের মন খারাপ হল। খানিক সময় পর উত্তর এলো—
‘না। দরকার নেই।’
পেখম কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
‘আপনার ইচ্ছা। আমি তো শুধু কেয়ার করতে চেয়েছিলাম।’
তারপর সে পাশের সোফায় বসে পড়ে। হাঁটুর ওপর হাত রেখে ভেবে নেয়, কী করা যায়। ঠিক তখনই বাইরে থেকে হালকা আওয়াজ ভেসে এলো, কেউ গান গাইছে, আর এক সাথে অনেকের হইচইপূর্ণ কলরব। পেখম উঠে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাহিরে উঁকি দিল। তারপর আবারো নওশিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আউটসাইডে মনে হচ্ছে কেউ বনফায়ার করছে। কি সুন্দর সবাই মজা করছে!’
নওশির চোখ খুলে তাকাল। তারপর পেখমকে বলল,
‘হু। স্টাফরা বলেছিল আজ রাতে একটা গ্রুপ এসে পার্টি করবে। ওরাই করছে হয়ত।’
পেখমের চোখে উচ্ছ্বাস ফুটে উঠল। তারপর এগিয়ে এসে নওশিরের কাছে আবদারের স্বরে বলল,
‘চলেন না! আমরা ওখানে যাই! কটেজ থেকেই যদি কেউ ইনভাইট করে থাকে তো…’
নওশির ঠোঁট কুঁচকে বলল,
‘না! আপনাকে থ্যাঙ্ক ইউ, আমি পারব না, আমার এইসব হৈ হুল্লোড় পছন্দ না তা আপনি ভালো মতই জানেন।’
পেখম নড়ে উঠল, শুনল না নওশিরের বাড়ন। জেদ ধরে বলল,
‘একটু রিল্যাক্স করা তো দরকার, নওশির ভাই। জীবন তো আর প্রতিদিন এত কাঠিন্য নিয়ে কাটে না। একদিন… শুধু একটুখানি হেসে বাঁচা যায় না, দেখুন আমার সাথে কত কিছু হচ্ছে তবুও আমার সুন্দর ভাবে জীবন কাটানোর কত লোভ?’
নওশির পেখমের দিকে তাকাল। মেয়েটার মুখে এমন প্রাণচঞ্চলতা সে অনেক বছর পর দেখছে। তবু নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
‘আমি ভীড় পছন্দ করি না পেখম।’
পেখম মুচকি হেসে কাছে এগিয়ে এসে বলল,
‘আমি তো আছি। আপনার পাশে আমি থাকব। কাউকে পাত্তাই দেব না।’
নওশির কিছু না বলেই তাকিয়ে রইল। পেখম এক পা এক পা এগিয়ে এসে ধীরে তার সামনে দাঁড়াল। হাতটা রিকুয়েষ্ট করার মতো উঁচিয়ে বলল,
‘চলেন, প্লিজ? এখন না বললে আমি একা চলে যাব।’
এইবার যেন একটু নড়েচড়ে বসল নওশির।
তার ঠোঁটে অদ্ভুত এক দীর্ঘশ্বাসের হাসি এলো।
‘আপনি কি এখনো এমনই? যা মন চায় তাই করবেন?’
পেখম চোখ মেরে বলল,
‘হ্যাঁ! আর এখন আমার মনের চাই -টা হলো আপনি। চলুন আমার সাথে। আর কোনো না আমি শুনব না।’
কথাটা বলেই নওশিরকে টেনে উঠালো। নওশির আর না করতে পারল না। সে ধীরে উঠল। মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘ঠিক আছে। কিন্তু আমি বেশিক্ষণ থাকব না।’
পেখম উচ্ছ্বসিত গলায় নওশিরকে বোঝানোর গলায় বলল,
‘থাকবেন! থাকবেন। আপনি নিজের অজান্তেই উপভোগ করবেন, আমি নিশ্চিত।’
——–
বনফায়ারের আগুন ধীরে ধীরে জ্বলছে। চারপাশে কয়েকজন অতিথি গোল হয়ে বসে আছে, কেউ কেউ গিটার বাজাচ্ছে, কেউ কবিতা বলছে, কারও শরীরে শাড়ির আঁচল দিয়ে শীতের ঠাণ্ডা বাদ দেয়ার চেষ্টা, আবার কারও মুখে উচ্ছ্বাস। পেখম একটু দূরে দাঁড়িয়ে পুরো দৃশ্যটা গিলছে চোখ দিয়ে। আলতো করে তার চুলের ক্লিপটা খুলে ফেলে দিলো সে। হাওয়ায় চুল ওড়ার মতো তার ভিতরটাও যেন হাওয়ার মতো হালকা হয়ে উঠছে। কি মনে করে পল্লবী বেগমকে ভিডিও করে তা পাঠিয়ে দিল। তারপর পেখম পাশে দাঁড়ানো নওশিরকে বলল,
‘চলেন, ওইদিকে বসি।’
নওশির পেখমের কথা শুনে চারপাশে তাকিয়ে দেখল। সবাই ব্যস্ত নিজেদের আনন্দে। কেউ ওদের দিকে তাকাচ্ছে না। সে পেখমের পেছনে পেছনে গিয়ে গাছের গুঁড়ির মতো গড়ানো এক টুকরো কাঠের ওপরে বসল। পেখমও পিছনে তাকিয়ে দেখল সেখানেও একটা গাছের গুঁড়ি রাখা। যা সে খেয়ালই করে নি তাই নিজের বোকামির উপর হেসে দিয়ে নিজেও যেয়ে বসে পড়ল পাশেই। গিটার হাতে পেখমের পাশের কটেজের এক ছেলে হঠাৎ টুপ করে বলল,
‘আমার পরের গানটা সেই মেয়েটার জন্য, যে একা একা ঘুরতে এসেছে… আর এখন পুরো আলোর মতো ছড়িয়ে গেছে এখানে।’
পেখম হেসে ফেলে। তারপর তার সাথের একটা মেয়ে আছে সকালেই পরিচয় হয়েছে, নাম লিলি। তাকে শুধালো,
‘আমার কথা বলছে নাকি?’
লিলি নামের মেয়েটা মিষ্টি করে হাসল তারপর সম্মতি দিল। তারপর ঠোঁটের কোণ টেনে হেসে বলল—–
‘তোমার মতো ছন্নছাড়া মানুষ খুব কমই আসে এখানে। ও অবশ্য ঠিকই বলেছে।’
পেখমের খুশির অবন্ত নেই। তখনই গিটার বেজে ওঠে। গিটারের টুংটাং শব্দরা যেন রাতের হিম হাওয়ায় ঠাণ্ডা প্রেমের মতো। পেখমের মুখে কোমল এক হাসি। সে পা দোলাতে দোলাতে তালের সাথে তাল মিলিয়ে নিচু গলায় গুনগুন করে।
নওশির চোরা চোখে পেখমের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলোয় তার মুখটা ঝলমলে, চুলগুলো উড়ছে হাওয়ায়। পেখম চোখদুটো বন্ধ করে অনুভব করছে আর ঠোঁটে হাসি হাসি করে গুন-গুন করে গান গাইছে।
সেই মেয়েটার মতোই, যাকে একদিন রাতে ছাদে ছাতা হাতে বৃষ্টির পানি ধরতে দেখেছিল। সেদিন রাতে সেই মেয়েকে দেখে একমুহূর্তের জন্য থমকেছে সে! এখন পর্যন্ত সেখান থেকে একটুও নড়তে পাড়ে নি নওশির! ভাগ্য কেন সবসময় সহায় হয় না? পেখম কেনো নওশিরের হয় না?
দূর থেকে একটা কাগজের লন্ঠন উড়তে শুরু করে। সবাই হাততালি দেয়। পেখম উল্লসিত চোখে নওশিরের দিকে তাকাল সে চোখ সরিয়ে নিলো তা অবশ্য পেখম খেয়াল করেনি, পেখম উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল,
‘ওটা দেখতে যাব নওশির ভাই!’
কথাটা বলেই পেখম দৌড়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ায়। তারপর আবার ফিরে এসে নওশিরের হাত টেনে বলে,
‘চলুন না! আপনি এমন কাঠ হয়ে বসে থাকেন কেনো!’
নওশির উঠে দাঁড়ায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেও পেখমের পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকে, যেভাবে হয়ত কেউ হেঁটে যায় নিজের ফেলে আসা সময়ের পেছনে। বনফায়ারের সেই আগুনে, হয়ত নওশির নিজের ভেতরের অনেক জমে থাকা অনুরাগ, অভিমান, না-বলা ভালোবাসার কথাগুলো পোড়াতে চায়। আচ্ছা পেখম তার হলে কি এমন ক্ষতি হত? পেখমের জীবনে নওশির প্রথম পুরুষ হলে কি এমন ক্ষতি হত? কতশত প্রশ্ন; অথচ কোনো উত্তরই নওশির জানে না। খুজলেও সেই প্রশ্নপর উত্তর সে পায় না। পেখম হঠাৎ তার দিকে ফিরে বলে—–
‘আবারো মনে হচ্ছে আমি বাঁচছি। আমি আর কারো প্রাক্তন না, আমি হলাম আমি। ’
নওশির তাকিয়ে থাকে। এক মুহূর্তের জন্য কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। ঢোক গিলে তারপর খুব আস্তে বলল—–
‘পেখম… মানুষ নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকে। আপনি সেই লুকিয়ে থাকা নিজেকে খুঁজতে এসেছেন, আর যেহেতু পারছেন তাহলে ধরে নিন এটাই আপনার জয়ের সূচনা…।’
পেখম চমকে তাকায়। চোখে পানি জমে পেখমের। সে আর কিছু না বলে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে নেয়। দূরে আগুনের আলোয় রাত আর কুয়াশা মিলেমিশে গেছে। আর পেখম আর নওশির দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে। সম্পর্কের একটুখানি নরম হয়ে যাওয়া সেই দূরত্বটায়। এটাই কি শুরু নাকি নওশির আর পেখমের জীবনে উঠবে নতুন কোনো আগমনী ঝড়?
—
পাহাড়ের রাত মানেই যেন অন্য এক পৃথিবী।
তীব্র শীত আর আগুনের আশেপাশে জড়ো হওয়া অচেনা মানুষদের মাঝে পেখম প্রথমবারের মতো খানিক স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছিল।চারপাশে গান, গিটার আর ঘুরে ঘুরে দেওয়া ছোট ছোট কাঠের কাপ। যার ভিতরে হালকা বাদামী রঙের পানীয়। সবাই হইহই করে বলল,
“হলুদ রুটের হার্বাল ট্রেডিশনাল। পাহাড়ের লোকের ঘরোয়া বানানো, নেশা নেই। গরম রাখে শরীর।”
পেখমের খেয়ালি মনে কৌতূহল জাগে।
সে অনায়াসে সেই কাপটা হাতে তুলে নেয়।
প্রথম চুমুকেই বুঝল না কিছু। দ্বিতীয় চুমুকেই সে কেঁপে উঠল। জিভে টক-মিষ্টি ছুঁই ছুঁই এক গন্ধ। তৃতীয় চুমুকে সেই অজানা কিছুর ঢেউ মস্তিষ্কে গুনগুন করে বাজতে শুরু করল।
—
নওশির তখন একটু দূরে, আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে। সিগারেটে শেষ টান দিতেই চোখ পড়ল পেখমের উপর। পেখম আচমকা অস্থির হয়ে উঠছে। চোখ ছোট ছোট করে বোঝার চেষ্টা করল পেখমের কি হয়েছে। নুঝল না, পেখম সবার সাথে কথা বলছে বর লিলির সাথে অযথা অস্বাভাবিক রকমের হাসছে। নওশির কিছু বুঝতে না পেরে এগিয়ে এলো।
পেখম তাকে দেখে চমকে উঠল। তারপর আবারো হেসে বলল,
“আরে… আপনি এখন এলেন! আসুন! দেখি আমার গান শুনে বলুন তো কেমন লাগে আমার গান… নাহ, না কবিতা… মন চাইছে এখন কিছু অদ্ভুত বলতে… !”
নওশির থমকাল। পেখমের চোখ এখন অদ্ভুতভাবে ভেজা। সন্দেহ গাঢ় হলো তাই পেখমকে ডেকে উঠলো,
‘পেখম!’
পেখম হেয়ালি চোখে তাকাল তাই নওশির গলায় কড়াভাব এনে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি ঠিক আছেন তো?’
পেখম তার কণ্ঠে একটুও কান না দিয়ে হঠাৎ করে নওশিরের কাঁধে মাথা রেখে সাথে শব্দ করে কান্না করে নওশিরের শার্টের বুকের দিকে টেনে ধরল, তার টানটা এতোই দৃঢ় চিলো যে একটা বোতম ছিড়ে দূরে হারিয়ে গেলো। পেখম কান্নারত গলায় অভিযোগ করতে করতে বলল,
‘আমার খুব একা লাগছে নওশির ভাই। জানেন? খুব একা… আমার একজন খুব আপনজন চাই, আমি তাকে ছুঁতে চাই কোনো জড়তা ছাড়াই… যার গায়ের গন্ধটায় আমি লেপ্টে থাকব আর সে শুধু আমার মনে থাকবে.. সৌজন্য তো আমায় ভালোবাসল না। আমকে ছুয়ে দেখে ওই আনিয়াকে ভালোবাসল। মিথ্যে বলে আমার বাচ্চা গুলোকে মে রে ফেলল।’
নওশির এক ধাক্কায় পেখমকে সরিয়ে দিয়ে নিজেও পেছিয়ে আসে। তবে পেখম তার হাত আঁকড়ে রাখে যেন সে পড়ে না যায়। নওশির একটু চমকালো সাথে ঢোক গিলল। পেখম নিজের হুশে নেই। পেখমকে সরিয়ে দেয়ায় সে আবারো কান্না করে নওশিরের কাছে আসে আর তার গালে হাত রেখে নিষ্পাপ কণ্ঠে জানতে চায়,
‘আমি কি অসভ্য কিছু বলেছি? আমি… আমি তো এমন না…’
নওশির এক মুহূর্ত চুপ থাকে। পেখমের থেকে সেই নেশাদ্রব্যের ঘ্রাণ আসছে।যদিও সে আগেই বুঝেছিলো তবে এবার তার ধারণায় সত্যি হলো। তাই পেখম এসব কেনো এসব বলছে তা বুঝতে সময় লাগেনি। পেখম নিজের হুশে নেই। তাই নওশির নরম গলায় বলল,
‘আপনি যেটা খেয়েছেন সেটা আপনাকে দিয়ে এসব বলাচ্ছে, পেখম। এখন চলুন রুমে ফিরি।’
পেখম হাসে তারপর আবারো হাত গলায় কাছের শার্ট খামচে ধরে কাছে টেনে ফিসফিস করে বলল,
‘আপনি আমাকে এসব বলবেন না তো নওশির ভাই! আজকের রাতটা শুধু আমার… আপনি যদি চান, তবে আজ আমি শুধু আপনার হতে পারি…’
এই কথা শুনে নওশিরের চোখ নেমে আসে নিচে। সে গভীরভাবে শ্বাস নেয়, তারপর পেখমের হাতে শক্ত করে ধরে বলে,
‘আপনি নিজের হুঁশে নেই পেখম, উল্টপাল্টা বলছেন। আমি আপনাকে অপব্যবহার করব না। না তেমন কোনো ইন্টেনশন আছে আমার। এভাবে নয়, পেখম… কখনো না।’
পেখম হালকা হাসে, চোখ বন্ধ করে ফেলে মাথা তার বুকে ঠেকিয়ে বলে—–
‘আপনি এখনও সবসময়ের মতোই নির্লিপ্তই… পুরুষ পুরুষে কত পার্থক্য তাই না নওশির ভাই?’
নওশির তার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই পেখম কোনো নাটক করছে না, কোনো চেষ্টা করছে না… সে একা, ক্লান্ত, ক্ষতবিক্ষত। সে এবার চুপচাপ পেখমকে কাঁধে মাথা রাখতে দেয়।
কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, কোনো উষ্ণতা নেই, আবার অভিমানও নেই। শুধু সহানুভূতির স্তব্ধতা। সে আস্তে পেখমের কানে ফিসফিস করে বলে——
‘রুমে চলুন পেখম। আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন, আমি পাশে থাকব। কথা দিচ্ছি, কিছু হবে না। আমি কিছু হতে দেব না।’
পেখম আর কিছু বলে না। সে তার দুঃখ ক্লান্তি, নেশা, অভিমান সবকিছু নিয়ে কেবল হেঁটে যায় নওশিরের সাথে। আর অদূর পাহাড়ের কুয়াশা তাদের গিলে নেয়।
চলবে,…
- প্রানেশা আহসান শীতল