
সেদিনের পর সাতেক-বাদে পেখমকে বাসায় আনা হয়েছে। পেখম কারো সাথে কথা বলছে না, এমনকি পল্লবী বেগমের সাথেও না। সৌজন্য পেখমের সামনে আসেনি। তবে পেখমের অবস্থা আগের থেকে উন্নতি দেখার সাথে সাথেই সৌজন্যের খালা নিজে বাদি হয়ে সৌজন্যের বিরুদ্ধে ম্যারিটাল রেপ ও এক্সট্রা ম্যারিটাল এফেয়ারের অভিযোগে মামলা করেন। পুলিশ সৌজন্যকে গ্রেফতার করতে আসে এক রাতে, বৃষ্টি ঝরছিল টুপটাপ। সেই বৃষ্টির শব্দও যেন পেখমের কানে পৌঁছাচ্ছিল না। ঘরের কোনায় বসে থাকা মেয়েটি জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে ছিল নিঃশব্দে। তার দৃষ্টিতে কোনো আগ্রহ ছিল না, শোকও ছিল না—ছিল শুধু একরাশ শুন্যতা। পল্লবী বেগম সৌজন্যের নাম শুনতেই শিউরে ওঠেন। “তুই কিছু বলিস না পেখম, আমি আছি তোর পাশে।” কিন্তু পেখম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। নিঃশব্দে চোখ বুজে নেয়, যেন ঘুমিয়ে পড়ে নিজেকে। পল্লবী বেগমের মনে একটাই ভাবনা, এই মেয়েটার সাথে কেনো এমন করল সৌজন্য? যে পেখমের চোখে কোনো ভাষা পর্যন্ত বেঁচে নেই এখন? পরদিন সকালেই সৌজন্যের খালা এলো তারপর পল্লবী বেগমের সাথে কথা বলে আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করল। কোনো দ্বিধা ছাড়াই তিনি পেখমের পক্ষ নিয়ে ডিভোর্স ফাইল করার সিদ্ধান্ত নেন। সমাজ, আত্মীয়স্বজন, পরিবারের মান-ইজ্জতের কথা ভেবে চুপ ছিলেন পল্লবী বেগম। কিন্তু সৌজন্যের খালার বারবার বলার পর পল্লবী বেগম পেখমের চোখের সেই স্তব্ধতা যেন সমস্ত সম্পর্কের ভাষা কেড়ে নিল, এবং অভিযোগ জানাল।
সৌজন্য তখনো থানায় রিমান্ডে, তার পক্ষে কেউ নেই। না পরিবার, না বন্ধু, আনিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একসময় যে সৌজন্য গর্ব করে বলতো, “পেখম আমার অধিকার”—আজ তার সেই ‘অধিকার’ নিজেকে মুক্ত করতে চায় সমস্ত বন্ধন থেকে। ডিভোর্স পেপার পাঠানো হয় থানাতেই। পেখম নিজ হাতে সাইন করেন না, তাঁর হয়ে স্বাক্ষর করেন পল্লবী বেগম নিজে, অভিভাবক হিসেবে। কারণ পেখম তখনও স্বাভাবিক নন, যেন কোন এক ভাঙা দেয়ালে হেলান দিয়ে পড়ে আছে নিজের ভিতরেই। তিন সপ্তাহ পর আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বৈবাহিক সম্পর্কের ইতি ঘটে। একটি অধ্যায় শেষ হয়, যেটা আদৌ শুরুই হতে পারেনি। পেখমের ডিভোর্স সনদ পেয়ে পল্লবী বেগম চুপচাপ পেখমের ঘরে ঢুকে সনদটা টেবিলে রেখে দেন। বলতে পারেন না কিছু। শুধু একবার মাথায় হাত রেখে বলেন— “এইবার তুই নিজের মতো করে বাঁচ, মা। কারো ছায়া হয়ে নয়। নিজের আলো হয়ে।” পেখম সেদিনও কিছু বলে না। তবে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার চোখের কোণ বেয়ে। সেটাই ছিল তার প্রথম অনুভব; চুপিসারে মুক্তির। তবে কি আদোও সে নিজের অনুভূতি থেকে পালাতে পেরেছে? নাকি অস্বীকৃতি জানাতে পেরেছে সৌজন্যের প্রতি তার ভালোবাসা? সৌজন্য এমন করল অথচ পেখমের ভালোবাসা ছিল নিখাঁদ। ~ ডিভোর্সের এক সপ্তাহ পর পেখম আরও নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। পল্লবী বেগম বুঝতে পারেন, চুপচাপ বসে থাকা মেয়েটির প্রয়োজন এখন শুধু সময় নয়, প্রয়োজন চিকিৎসা। মনকে খোলার, ভুলে যাওয়ার, কিংবা অন্তত নিজের বেদনার সঙ্গে সহবাস করার মতো একটি পথ। তিনিই একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দেখা করেন।
ড. আশিয়া তাসনিম, একজন প্রথিতযশা ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রিস্ট। প্রথম দিনেই পেখম তার সামনে বসে থাকে অনেকটা নির্বাক পাথরের মতো। কথা বলে না, তাকায় না, কেবল সামনের ঘড়ির কাঁটার শব্দ শোনে। ড. আশিয়া প্রশ্ন করেন না প্রথম দিন, শুধু বলেন—– “তুমি আজ শুধু বসো। কিছু বলতে হবে না। এই চুপচাপ থাকাটাও একটা ভাষা।” তারাপর আশিয়া সব কিছু বুঝে সপ্তাহে দু’দিন সেশন এর বন্ধাবস্থা করেন। এতোদিন পেখমে পর্যবেক্ষণ করেন আশিয়া। দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে পেখম হঠাৎ প্রশ্ন করল, “মানুষ কেন কারো শরীরের ওপরে অধিকার দাবি করে? ভালোবাসা কি এমনই হয়?” ড. আরশিয়া চুপ থেকে বলেন, “ভালোবাসা জোর করে কারো শরীর ছোঁয় না, পেখম। ওটা বরং সবার আগে মন ছোঁয়।” এই ছোট ছোট বাক্যগুলো পেখমের নিস্তব্ধ মনের ভেতরে ছোট ঢেউ তোলে। চতুর্থ সপ্তাহে এসে সে ধীরে ধীরে বলে— “আমার একটা বাচ্চা আসছিল… আমি তাকে চাইনি। কিন্তু এখন মনে হয়, ওটাই শুধু চেয়েছিল আমাকে। আমায় ও এখনো ডাকে… আপনি ওর কান্না শুনতে পাচ্ছেন?” “তুমি ওকে এখনও মিস করো?” “না… আমি নিজের ভিতরটাকে মিস করি। আমি আর আমি নেই।” এই ভাঙা ভাঙা বাক্যগুলোর মধ্য দিয়ে, যেন পেখম ধীরে ধীরে ফিরতে শুরু করে। ড. আশিয়া তাকে বলেন একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা–—– “তোমাকে এখন নিজের শহর থেকে দূরে যেতে হবে। নিজেকে দেখতে হবে অন্য এক চোখে। নতুন আকাশ, নতুন হাওয়া— তোমার ফুসফুসের জন্য না, তোমার আত্মার জন্য জরুরি।” পেখম চমকে তাকায়। যেন কেউ ভিতরটা দেখে ফেলেছে। পরদিনই পল্লবী বেগমকে বলে, “মা, আমি কোথাও যেতে চাই… দূরে। কিছুদিনের জন্য।” পল্লবী বেগম কাঁপা গলায় বলেন, “এখন কোথায় যাবে তুমি? তুমি এখনো সুস্থ নও!” “একা যেতে চাই মা। আমার এই শহর থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির স্বচ্ছ বাতাসে শ্বাস নিতে চাই। এই শহরে আমার দমবন্ধ লাগছে আমি শ্বাস নিতে না পারলে মরে যাব।” ভীতু চোখে তাকায় পল্লবী বেগম। দুইমাসের বেশি হয়ে গেছে সে ঘটনার পর। এই প্রথম পলক বায়না ধরেছে, ভয় পেলেও কাঁপা গলায় শুধায়, “যা মা… তুই এবার একটু নিজের মতো করে বাঁচ। তুই যেদিকে যাবি, ওখানেই আমি তোকে আশীর্বাদ পাঠাব।” — ড. আশিয়া একটি নির্দিষ্ট জায়গার নাম দেন—সাজেক ভ্যালি।
অবিকল সবুজে মোড়া, মেঘে ভেসে থাকা এক পরিস্কার পৃথিবী, যেখানে নিজেকে আবার মানুষ বলে অনুভব করা যায়। তিন সপ্তাহের সেই ভ্রমণে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়। সাদা-নীল একটা ডায়েরি নেয় পেখম, ভেতরের পাতায় প্রথম লেখে: “আমি যাচ্ছি। আমি ফিরে আসবো কি না জানি না, তবে এবার আমি নিজেকে খুঁজতে যাচ্ছি। এইবার কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না, আমি নিজেই নিজেকে খুঁজবো।” — রাত প্রায় দশটা। ঢাকার সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে থমকে দাঁড়িয়ে আছে একটা পুরোনো শ্যামলী পরিবহনের বাস। পেখমদের নিজেদের গাড়ি আছে তবে ড. আশিয়ার ভাষ্যমতে পেখমকে এখন একটু পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যাহার করা উচিত। তাই নিজেদের গাড়ির বদলে এখন সাজেক যাবার জন্য বাস গাড়িই নির্বাচন করেছে। পেখমের চোখে তেমন ঘুম নেই, তেমন উত্তেজনাও না, কিন্তু কোথাও একটা টান আছে। সাজেক; হয়তো জায়গাটা নয়, বরং একান্তে থাকার একটা ক্ষুধা। পল্লবী বেগম এটা সেটা বলে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। পেখম শুনছে কিনা বোঝা গেল না তবে সে এক ধ্যাণে রাস্তার বিপরীতে থাকা একটা কাপল ও তাদের কোলে একটা বাচ্চা মেয়োর দিকে তাকিয়ে আছে। বাস ছাড়ার ঢাক পড়ায় পল্লবী বেগম পেখমকে ডাকে। তবে তার তেমন সাড়া না পেয়ে তার বাহু ধরতেই পেখম তাকায় পল্লবী বেগমের দিকে। পল্লবী বেগম বলল, “গাড়ি ছাড়বে।” “আচ্ছা।” কথাটা বলেই পেখম গাড়িতে যেয়ে উঠে বসল। বাসটা ধীরে ধীরে ছাড়ে, জানালার পাশে বসা পেখম জানালার কাঁচ নামিয়ে দেয়। ঠাণ্ডা বাতাসে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যায়, চোখের কোণ ছুঁয়ে যায় একটুকরো অতীত। তারপর ধীরে চোখ বন্ধ করে। খানিকবাদেই অনুভব হয় তার পাশে কেউ বসেছে। তবে চোখ খুলে তাকানোর ইচ্ছে হলো না তার। ধীরে ধীরে সে ঢলে পড়ে গভীর ঘুমে। রাতভর বাস ছুটে চলে চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে। কখনো চোখের সামনে আলোর রেখা ভেসে ওঠে, আবার কখনো নিস্তব্ধ অন্ধকারে ডুবে যায় সবকিছু। ভোরবেলা খাগড়াছড়ি পৌঁছেই প্রথম নিশ্বাসে পেখম টের পায়। সে সত্যিই শহর ছাড়িয়ে গেছে। পিটপিট চোখে তাকায় পেখম। গাড়ি থেকে অনেকমানুষই নেমে গেছে। তাই লম্বা একটা শ্বাস ফেলল তারপর নিজের পাশের সিটে তাকায়। সেখানে একটা মিনারেল ওয়াটার বোতল রাখা তবে কেউই নেই। পেখম নিজের সীটে পানি খুঁজল, পেল না। তারপর মনে পড়ল, সে গাড়িতে উঠেই ঘুমিয়ে গেছে পানি নেয়া হয়নি। তবে যা খাবার কেনা হয়েছিল তা এখনো ব্যাগেই পড়ে আছে। বিরক্তির শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে একটা দোকান থেকে পানি কিনে তা দিয়ে মুখে পানি দেয়। তারপর কুলকুচি করে এদিকসেদিক তাকিয়ে একটা চায়ের দোকান থেকে কড়া দেখে একটা চা নিয়ে খেয়ে কিছুক্ষণ পর একটা চাঁদের গাড়ির হুড খোলা দুলুনির মধ্যে উঠে বসে সে, পাহাড়ি পথে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে তার জন্য। সাজেক এখন কেবল গন্তব্য নয়, বরং নিজেকে খুঁজে পাওয়ার একটা ছুতো। — সাজেক ভ্যালি। রাঙামাটির বুক ভেদ করে ধীরে ধীরে উঠতে থাকা পাহাড়ি পথ, একপাশে উঁচু খাদ, অন্যপাশে সবুজের ঢেউ। পথ যত উপরের দিকে ওঠে, পেখমের বুকের ভার যেন ধীরে ধীরে নেমে আসে। অল্প চুল খোলা, ক্যানভাস জ্যাকেট পরে সে তাকিয়ে থাকে বাইরের আকাশের দিকে। কখনও চোখ বুজে, কখনও দূরের মেঘের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়—ছুঁতে নয়, হারিয়ে যেতে। এই প্রথম সে একা। সত্যিকার একা। রিসোর্টে পৌঁছে চুপচাপ ব্যাগ রাখে। ডায়েরি খুলে লিখে ফেলে এক লাইন— “এই পাহাড়টা আমার কবর হতে পারত… এখন এটাকেই আশ্রয় বানাতে চাই।” —
চলবে,..
- প্রানেশা আহসান শীতল