সেদিন ও সে [পর্ব-০৪]

নিজের বক্তব্য টুকু শেষ করে সৌজন্যের দিকে তাকাল সৌজন্যের খালা। সৌজন্য লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে আছে। খালার কথা শুনে কিছু বলার আগেই সৌজন্যের গালে একটা শক্ত চড় পড়ে। অবাক চোখে সামনে তাকাতেই পেখমের মা পল্লবী বেগমকে দেখে একটু থমকে যায় সৌজন্য। পল্লবী বেগম রাগান্বিত মুখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,

“আমার মেয়ে কি এতই খারাপ ছিল যে তোর পরকীয়া করে আমার মেয়ে আর দুটো নিষ্পাপ প্রাণ কেড়ে নিতে ইচ্ছে হলো?”

ঢোক গিলল সৌজন্য। তারপর নিজের সাফাই দেবার মত বলল,

“মা আমার কথা…!”

“চুপ… ওই মুখ থেকে আমায় মা ডাকবি না। যেই ছেলে আমার মেয়ের সাথে এমন নেমক-হারামি করতে পারে, তার মুখ থেকে অনন্ত আমি মা ডাক শুনতে চাই না!”

একটু অপরাধবোধে ঘিরে ধরল সৌজন্যকে। তবে আবারও একটা চড় পড়ায় আরো একটু হতভম্ব হয় সৌজন্য। উপরে তাকানোর আগেই কেউ তার শার্টের কলার চেপে ধরে তাতেই চমকে সামনে তাকিয়ে নিজের মাকে দেখে একটু ভরকায়। সৌজন্যের মা চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“লজ্জা করে না তোর? এমন নিষ্পাপ একটা মেয়ের সাথে এমন করতে বুক কাঁপল না তোর? তুই আদোও আমার পেটে জন্মেছিস?”

“আম্মা…”

“তোর ওই পাপী মুখ থেকে আমায় আম্মা ডাকবি না সৌজন্য। আমার আদর্শে বড় হওয়া সৌজন্য এমন নয়, তুই পাপ করেছিস। যেই পাপের কোনো ক্ষমা নেই। সাথে পাপ ঢাকার জন্য তুই মিথ্যা বলেছিস। জা নো য়া র হয়েছিস, মানুষের বাচ্চা না…!”

এর মধ্যে রিসিপশনের মিতু নামের মেয়েটা তাদের উদ্দেশ্য করে বলল,

“এক্সকিউজ মি, এটা হসপিটাল। দয়া করে এভাবে চেঁচামেচি করবেন না। এগুলো আমরা এলাউ করতে পারব না, সাথে প্রেসেন্টদের সমস্যা হবে।”

কথাটা বলেই সে আবারো নিজের কাজে ব্যস্ত হয়। পল্লবী বেগম শুনল তারপর মিতুকে পর্যবেক্ষণ করে এগিয়ে এলো তার সামনে তারপর মিতুর কাছে তারপর ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“এক্সকিউজ মি? একটু আগে যে ছেলে ডক্টরটা অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়েছে তার পরিচয় জানা যাবে?”

মিতু দ্বিধাদ্বন্দিত চোখে তাকিয়ে বলল,

“শিউর ম্যাম। গিভ মি জাস্ট ফাইভ মিনিট’স!”

কথাটা বলেই কম্পিউটারে কিছু একটা দেখে পল্লবীর দিকে তাকায় তারপর বলল,

“ডক্টর আশরিয়াল নওশির ফরম তুর্কী। তিনি আমাদের মেডিক্যাল কলেজের ইনভাইটেড প্রফেসর। ছ’মাসের জন্য এসেছে। এন্ড হি ইজ এ হার্ট সার্জন।”

এতটুকু বলে থামল মিতু। পল্লবী বেগম শান্ত মুখে মাথা নাড়িয়ে আবারো এগিয়ে এসে সবার থেকে একটু দূরে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এর মধ্যে একজন নার্স এগিয়ে এসে চেঁচিয়ে বলল,

“৩০৭ নম্বর কেবিনের পেসেন্ট কেমন যেন করছে!”

কথাটা শুনতেই ব্যস্ত হয় মিতু। সবার মাঝে একটু চঞ্চলতা সৃস্টি হলো। পল্লবী বেগম এগিয়ে এসে মিতুকে দ্রুত গলায় জিজ্ঞেস করল,

“৩০৭ তো পেখমের!”

মিতু মাথা নাড়িয়ে ডক্টর শিউলিকে ইনফর্ম করতেই সে দৌড়ে এলো৷ তারপর পেখমের কেবিনে ঢুকল। খানিক বাদে আবার বেড়িয়ে এসে চেঁচিয়ে বলল,

“দ্রুত অপারেশন থিয়েটার রেডি করো।”

কথাটা বলেই আবারো মিতুর সামনে এসে জিজ্ঞেস করল,

“হার্ট সার্জন এসেছে কোনো?”

চমকায় পেখমের পরিবার। পল্লবী বেগমের বুঝতে আর সময় লাগেনি কি হয়েছে। ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেলেন তিনি। এতে যেন হতভম্ব হলো সবাই। পল্লবী বেগমকেও ধরে অন্য কেবিনে নিয়ে যাওয়া হল।

খানিক বাদে একজন চিকিৎসক এলো পেখমকে যে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়েছে সেটায়। পল্লবী বেগমও জ্ঞান হারিয়েছে। সৌজন্যের খালা শুধু দোয়া করছে যাতে পেখমের কিছু না হয়। পল্লবী বেগমের খানিক বাদেই জ্ঞান ফিরেছে। অতিরিক্ত চিন্তায় তিনি জ্ঞান হারিয়েছে। সৌজন্যর মা সৌজন্যের সাথে কথা বলছে না। সময় গড়ায়। সৌজন্য একপাশে নীরব দর্শকের মতো চুপসে আছে।

সময় ব্যবধানে থিয়েটার থেকে ডক্টর শিউলি বের হয়, তার সাথে আরো একজন ডক্টর বের হয়। দুজনে কিছু একটা আলোচনা করছে সাথে তাদের মুখভঙ্গি ভীষণ চিন্তিত ঠেকল। ডক্টর শিউলি হয়তো অনডিউটি ডক্টরকে কিছু বলল তাই সে মাথা নাড়িয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল। ডক্টর শিউলি এগিয়ে আসতে দেখে সৌজন্যের খালা এসে দাড়ায়, তাই ডক্টর শিউলি জিজ্ঞেস করল,

“পলকের মা?”

সৌজন্যের খালা পিছনে ফিরে দুজনকে দেখে ফের সামনে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,

“সে জ্ঞান হারিয়েছিল, অন্য কেবিনে আছে পল্লবী। আপনি যেকোন খবর আমাকে অবগত করতে পারেন। বলুন?”

শিউলি শীতল চাহনি নিয়ে মাথা নাড়িয়ে শান্ত গলায় বলল,

” ইতিমধ্যে জেনেছেন আমি পলককে আগে থেকেই চিনি। আর তার সাথে কি হয়েছে তা জানেন।”

এতোটুকু বলে আবারো সবার মুখ দেখে শুধায়,

“পলক ‘Transient Ischemic Attack’ – মানে মিনি স্ট্রোক করেছে। শুনে ভয় পাবেন না, এটা স্থায়ী ক্ষতি করে না, এবং রোগী এখন স্থিতিশীল আছেন। তবে এটাকে একরকম ‘ওয়ার্নিং সাইন’ বলেই ধরা হয়। ভবিষ্যতে বড় স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়তে পারে, যদি আমরা এখনই সাবধান না হই। তাই কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা আর নিয়মিত ওষুধ শুরু করতে হবে। ভালো খবর হলো – আমরা সময়মতো ধরে ফেলেছি তাই তেমন কোনো ক্ষতি হয় নি। তবে তাকে যদি ঠিক মতো যত্নে রেখে এখন থেকে যদি জীবনযাত্রা ঠিক রাখা যায়, তাহলে আল্লাহর রহমতে বড় কিছু হওয়া ঠেকানো সম্ভব।

এতোটুকু বলেই ঢোক গিলল ডক্টর শিউলি। তারপর ফের বলল,

“চিন্তা করবেন না। আমি আপনাদের পাশে আছি, কোনো কিছু দরকার হলে সরাসরি আমায় জানাবেন। রোগীর জন্য এখন সবচেয়ে দরকার সঠিক পরিচর্যা আর আপনাদের সহযোগিতা। আশা করি তাকে আপনারা সাপোর্ট করবেন।”

তারপর সবার মুখ দেখে আবারো ছোট্ট গলায় জিজ্ঞেস করে,

“মিসেস পল্লবী কোন কেবিনে?”

সৌজনের খালা এগিয়ে এলো তারপর বলল,

“আপনার পরামর্শ মাথায় রাখলাম। আমরা প্রেসেন্টের প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল হব। আর আমার সাথে আসুন!”

কথাটা বলেই ডক্টর শিউলিকে নিয়ে পল্লবী বেগমের কেবিনের দিকে যায় সৌজন্যের খালা।

সৌজন্যের খালা আর ডক্টর শিউলি চলে যেতেই নওশির আসে তারপর একবার ওয়েটিং সীটের দিকে তাকায়। সেখানে সৌজন্য আর তার মাকে দেখে কপাল কুঁচকায়। তারপর মিতুর দিকে তাকিয়ে এগিয়ে যায় পেখমের কেবিনের দিকে। তারপর দরজার কাচেঁ চোখ রেখে ভিতরে অক্সিজেন মাস্ক পরিহিত সাফেদ হসপিটালের চাদর দিয়ে পেঁচানো পেখমকে দেখে। তারপর হাতে পড়া নিজের ঘড়ির দিকে তাকায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মানুষের জীবন কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায় কেউ জানেনা।

পেখমকে দেখে এসে রিসিপশনের মেয়ের সামনে দাঁড়াতেই মিতু মেয়েটা চমকায়। নওশিরপর ডিউটি আজকে এগারেটায় শেষ। কিন্তু এখনে সে যায় নি? শরীরে এপ্রনটা নেই। তাহলে এমনিই আছে? কিন্তু তার তো থাকার কথা নয়! শরীরের পেস্ট ব্লু কালার শার্টটা এলোমেলো ভাবে ভাঁজ পড়ে আছে। মিতু যখন নওশিরকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত তখন নওশির অন-প্রফেশনালি আধভাঙ্গা বাংলায় জিজ্ঞেস করল,

“৩০৭ নম্বর কেবিনের প্রেসেন্টের আপডেট কি?”

মিতু অবাক হয়। নওশির নিজের কাজ ব্যতীত তেমন একটা কারো সাথে কথা বলে না। আজকে অন-প্রফেশনালি বাংলা আর এতোটা সময় হসপিটালে দেখে মিতু একটু অবাকই হয়েছে বোধহয়। মিতুকে এমন তাকিয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হয় নওশির তাই কপাল কুঁচকে আবারো নির্জীব গলায় শুধায়,

“এক্সকিউজ মি মিস?”

মিতু নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা নাড়িয়ে ছোট গলায় বলল,

“ওয়েট অ্য মিনিট স্যার.!”

তারপর একটা ফাইল এগিয়ে দেয় নওশিরের দিকে। নওশির ফাইলটা দেখে তারপর কপাল কুঁচকে থাকে অনেকটা সময়। রিপোর্ট বুঝতে সময় লাগে নি। নিজেও হার্ট সার্জন। তারপর ফের মিতুর দিকে তাকিয়ে পল্লবী বেগমের কথা জিজ্ঞেস করতেই মিতু নম্রগলায় সব বলল, তবে মিতু একটু অবাক হল বোধহয়। নওশিরের আগ্রহ যেন মিতুকেও খুব প্রভাবিত করল। নওশির কি কোনো ভাবে পল্লবী ও পেখমকে চেনেন? মিসেস পল্লবী বেগমও নওশিরের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল। কি এমন রহস্য আছে তাদের মাঝে? কি এমন লুকোচুরি আছে যে নিজেদের ভেতর কথা না বলে রিসিপশনে এসে সবাই সবার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিতু, তার এত ভেবে কাজ নেই, তবে নওশিরের আগ্রহবোধ তাকে একটু ভরকেছে; এ-ছাড়া আর কিছুই নয়…!”

চলবে…

  • প্রানেশা আহসান শীতল
  • Related Posts

    বিরহ বীণার সুর [পর্ব-০৩]

    বাবার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সাহস হয় না। জানি, মায়ের সামনে দাঁড়ালে প্রশ্নের পাহাড় নিয়ে বসবে, -‘কোথায় ছিলি তুই?’ -‘এভাবে কেউ বাড়ি ছেড়ে যায়?’ -‘সংসারে তো ঠোকাঠুকি হয়ই, তাই বলে চলে…

    বিরহ বীণার সুর [পর্ব-০২]

    নতুন শহরের অচেনা পরিবেশে যখন আমি একাকিত্বের সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম, তখন পাশের এপার্টমেন্ট থেকে ভেসে আসা গিটারের ছন্দ, গানের সুর আমার নিঃসঙ্গতার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছিল। একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You Missed

    বিরহ বীণার সুর [পর্ব-০৩]

    বিরহ বীণার সুর [পর্ব-০৩]

    সেদিন ও সে [পর্ব-০৪]

    সেদিন ও সে [পর্ব-০৪]

    বিরহ বীণার সুর [পর্ব-০২]

    বিরহ বীণার সুর [পর্ব-০২]

     প্রাণদায়িনী [পর্ব-০২]

     প্রাণদায়িনী [পর্ব-০২]

    বিরহ বীণার সুর [পর্ব-০১]

    বিরহ বীণার সুর [পর্ব-০১]

    প্রাণদায়িনী [পর্ব-০১]

    প্রাণদায়িনী [পর্ব-০১]