
বসন্তের বিকেল এক অনন্য আবহ নিয়ে আসে প্রকৃতির মাঝে। সোনালি রোদ মেখে চারপাশ যেন আলোর খেলায় মেতে ওঠে। গাছের পাতায় এক ধরনের স্নিগ্ধ সবুজের ছোঁয়া, বাতাসে হালকা উষ্ণতা আর কোমল শীতলতা মিশে এক অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ তৈরি হয়। শীতল শ্যামল বসন্তের বিকেলটা ধীরে ধীরে কেটে যেতে লাগলো। অন্ধকার এসে গ্রাস করলো সমগ্র।
মঞ্জুরিকে দেখা গেলো একটি গোরস্থানে। তার ভাইটাকে এখানেই শায়িত করা হয়েছে। সঞ্জু পেশায় একজন পুলিশ অফিসার ছিলো। মঞ্জুরীর বড় ভাই। সঞ্জুও সিএমসি কোম্পানির সম্পর্কে প্রমাণাদি পেয়ে গিয়েছিলো। সেদিন রাতে সঞ্জু তার স্ত্রীর সাথে লং ড্রাইভ ট্যুর থেকে ফিরছিলো। জায়গাটা জঙ্গলে ঘেরা রাস্তা হওয়ায় গাড়ি চলাচল খুবই কম। পথিমধ্যে একটি গাছ পড়ে থাকতে দেখে সেখানে তাদের গাড়ি থেমে যায়। সাইড দিয়ে গাড়িটা নিয়ে যাবে এমন সময় আরেকটি গাড়ি তাদের পাশ কাটিয়ে সামনে চলে তবে সামনে থেকে একটি ট্রাক আসছিলো এমন সময়। সেই ট্রাক সেই গাড়িটার কোনোরকম ক্ষতি না করলেও গাড়িটা হঠাৎ করে সামনে যেতেই গাড়িতে আগুন ধরে গেলো। হতভম্ব সঞ্জু আর রুশা কিছু বুঝে উঠার আগেই ট্রাকটা এসে তাদের গাড়ির ওপর চাপা দেয়। বিশাল ট্রাকের ওমন দানবীয় আক্রমণে থেতলে যায় সঞ্জুদের গাড়িটা।
মঞ্জুরি ঘটনাটা মনে করতেই চোখ বেয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। এমন সময় কাঁধে কারও স্পর্শ পেতেই কিছুটা কেঁপে উঠলো। তবে পাশে ফিরে তাকালো না মেয়েটা। সে জানে কে এই মানুষটা। এদিকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রূপক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,“ রাত হয়ে এলো। বাড়ি ফিরবে কখন?ʼ
মঞ্জুরি সে কথার জবাব না দিয়ে অন্য কথা বললো,“ জানো রূপক এই দিনেই ভাইয়া এই দুনিয়ার মায়া খুব নিষ্ঠুরভাবে ত্যাগ করেছিলো। কি ভয়ানক সেই মৃত্যু। লাশ চেনারও উপায় ছিলো না কোনো। মুখ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিলো না। রক্তমাংস সব মিশে একাকার। এত বড় ট্রাকের চাকার নিচে পড়া চারটে খানি কথা? তোমার বড় চাচাও তো এর সাথে জড়িত ছিলো। সেবার গ্রামে গিয়ে কতবার মারতে চেষ্টা করলাম কিন্তু তুমি আর উৎস বারবার বাঁধা দিলে। এটা কি সত্যিই উচিত? উচ্ছ আমার সহযোগীতা করেছে অনেক মারার জন্য, তবে বারবার তোমাদের জন্য থেমে যেতে হয়েছে। ভাইয়ার এমন মৃত্যুর জন্য দায়ীরাও তো এর থেকে ভয়ানক মৃত্যু প্রাপ্য তাই না? তবে তোমাদেরই এত দ্বিধা কেন?”
রূপক মাথা নোয়ালো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শান্তভাবে বললো,“ প্রতিশোধ নেওয়াটা কি কোনো সমাধান? আইনে…ʼ
“ আইন? আইন আসছে কোথা থেকে? তোমরা পারছো কি তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে এই আইনের সাহায্যে?ʼ
হেসে উঠলো মঞ্জুরী। হাসতে হাসতে বললো,
“ আমার প্রফেশনও তোমার মতোই। কই আমি তো আইনকে বড় চোখে দেখছি না। যেই আইনে আদালতের কাঠগড়ায় শপথবাক্য পড়েও একের পর এক মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া যায় আর বিচারপতি ড্যাং ড্যাং করে টাকা খেয়ে বেকসুর খালাস রায় ঘোষণা করে, যেই আইন সত্য মানে না সেই আইনের নাম মুখে আনাও পাপ। অন্তত আজকের দিনে তোমার থেকে এই কথাটা একদমই বেমানান লাগল আমার কাছে।ʼ
রূপক শূন্যে চেয়ে রইলো। মঞ্জুরি ভুল কিছু বলে নি। হতাশার শ্বাসগুলো আজকাল খুব বেশি বেশি বের হতে চায়। সব প্রমাণাদি উপস্থাপন করার পরও যখন কষ্ট বিফলে গেলো উৎসর তখন কিছু করার ছিলো না। ক্লান্ত মুখশ্রী নিয়ে যখন বেরিয়ে আসলো কোর্টের বাইরে, সূর্যের আলোটা তখন তার মুখে এসে পড়ছিলো। ফর্সা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো অদ্ভুত বার্তা বহন করছিলো। রূপক শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে তখন।
রূপক ম্লান হেসে মঞ্জুরির করা একটি প্রশ্নের উত্তর দিলো হঠাৎ,“ আশিনই চাচাকে মারতে দেয় নি। উৎস সবকিছুতেই চুপচাপ ছিলো। সে তার বাবার সম্পর্কে যখন জেনে গিয়েছিলো যে অশোক চাচাই উর্মিলা চাচীকে উরফান মহান নিজ হাতে খুন করেছে জেনে আর এক বাক্যও বলে নি। তার পাপী বাবার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে নিজেও। তবে মিসেস ঊষাকে উরফান মহান নিজের লোক দ্বারা মারলেন, আবার কল্পনার বিয়ে নিয়ে এতো নাটকীয়তা সত্যিই অবাক করার মতোই। গ্রামের মানুষদের নিকট ভালো সাজার জন্যই ওমন ঘটা করে আয়োজন। তবে মিসেস উষার মৃত্যু আর গ্রামে পাওয়া সেই লাশগুলো নিয়েও আমরা তখন বেশ সন্দিহান ছিলাম। এমন করে করে আর কখনও নিজেদের হাতে কিছু করা হয়ে ওঠে নি।ʼ
কিছুক্ষণ চুপচাপ। হঠাৎ মঞ্জুরি বেশ ভাবুক গলায় প্রশ্ন করলো,“ আশিন আর উৎস কি আগে থেকেই একে অপরের চেনা পরিচিত? তাদের প্রাথমিক দেখা আর ঝগড়া! সেসব কি ইচ্ছাকৃত ছিলো?”
“ হ্যা।ʼ
চমকালো মঞ্জুরি,“ তোমাদের গ্রাম তো দেখি নাট্যশালা। সব রকমের খুনীরা ঘুরে বেড়ায় কি অবলীলায়। আর আইনের লোকগুলো চুপচাপ বসে বসে তাদের দেখেই যায়।ʼ
“ খুনী বলতে আশিনকে বোঝাচ্ছো? আর বিমানবন্দরে তুমি নিজেও তো অভিনয় করেছো।ʼ
“ কত খুনীই তো আছে। আর বিমানবন্দরের কথা বলছো? সেখানে তো উরফান মহানের চামচাগুলো উপস্থিত ছিলো বলেই ওসব করা।ʼ
“ তাহলে?ʼ
বুঝলো না মঞ্জুরি। ভ্রু কুঁচকে বললো,“ মানে?ʼ
পরমুহুর্তে যখন ব্যাপারটা বুঝলো তখন বিস্মিত আওয়াজে জিজ্ঞাসা করে উঠলো,“ উৎসদের আশেপাশেও কি, আবার এই উরফান মহানের কোনো লোক ছিলো?ʼ
রূপক মাথা দোলালো। মঞ্জুরি আরও বেশি চমকালো,“ কিন্তু কে?ʼ
“ জানি না আমি।ʼ
মঞ্জুরি অবাক হলো। কিভাবে কি? তারমানে তাদের মাঝেই কেউ প্রতারণা করছে কি?
__________________________
আশিন আজ খুব শান্তির একটা ঘুম দিয়েছে। স্বপ্নে তার বাবা মাকে দেখেছে আজ। বাবা মায়ের চেহারা ভুলে গিয়েছে সে বহু আগে। এইযে আজও স্বপ্নে বাবা-মাকে দেখলো ঠিকই তবে চেহারা পরিষ্কার নয়। তবুও ভালো লাগছে তার। বিকেলের নেতিয়ে যাওয়া সূর্যালো জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আশিন কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলো। অদ্ভুত সুন্দর!
আশিন বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তার বাড়িটা মূলত শহরের বাইরে। আশেপাশেও বাড়ি আছে অবশ্য। তবে সেগুলো কিছুটা দূরে দূরে। আশিন দোতলা থেকে নিচে নেমে এলো। রান্না করবে। পছন্দের সবরকমের খাবার-দাবার আজ রান্না করবে আশিন। হঠাৎ করেই খিল খিল করে হেসে উঠলো মেয়েটা। হাসলো কেন? সেটা সে নিজেও জানে না। হয়তো পুরোনো দিনের কথাগুলো ভেবে হাসলো। হাস্যকরই তো! বাবা মা মারা যাবার পর থেকে জীবনই তো নাট্যময় হয়ে উঠেছে। তবে উৎসর সাথে ঝগড়ার মুহুর্তগুলো সুন্দর ছিলো বলে মনো হলো আশিনের। উৎসকে তার কস্মিনকালেও পছন্দ ছিলো না। মূলত আশিনের কোনো ছেলেকেই পছন্দ নয়। তবে উৎস হুট করেই অদ্ভুত জায়গা করে নিয়েছে আশিনের মনে। আশিনের মস্তিষ্ক জুড়ে উৎসের বিচরণ। আশিন অবাক হয় না। বরং শান্ত থাকে। শান্ত রাখে নিজের মনকে। নিয়ন্ত্রণে কোনো কমতি নেই। নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সেই মন ভারী আবেগী হয়ে ওঠে। তখন পুরোটাই মনময় হয়ে যায়। তাইতো গৌতম বুদ্ধ বলেছেন,
“ মনকে নিয়ন্ত্রণ করো নাহয় মন তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করবে।”
কথাটার মুল্যার্থ আশিন বোঝে। তাইতো এতকিছুর মধ্য দিয়েও কখনও মুখ ফুটে বা আবেগ দেখিয়ে কোনো কাজ করা হয় নি।
রান্নাবান্না শেষে অসময়েই খেতে বসলো আশিন। খাওয়া শেষে ছাদে গেলো তারা দেখতে। এমন কাজ কখনও করা হয় নি তার। আশিনের মতে নিজেকে নিজের কিছু সময় দেওয়া উচিত। সবসময় ক্রোধের আগুনে পুড়ে তো আর প্রতিশোধের পায়তারা করা যায় না। তাই আশিন আজ নিজেকে সময় দিচ্ছে কিছুক্ষণ।
হঠাৎ ছাদের কোণায় কারও অবয়ব দেখতে পেলো আশিন। কফির মগে দ্বিতীয়বার চুমুক দিয়ে ঠান্ডা আওয়াজে আশিন এবার বলেই উঠলো,“ চোরের মতো এভাবে আমার বাড়িতে আসার মানে কি? পেশা আর কাজে তো দেখছি বহুত ফারাক!ʼ
আঁধার ছেড়ে আলোই এসে দাঁড়ালো উৎস। ধীরপায়ে আশিনের দিকে এগিয়ে এলো। একদম আশিনের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। আশিনের হাতে থাকা কফি মগটা নিয়ে নিলো অনায়াসেই। আশিন মানা করলো না আর না কোনো অভিব্যক্তি দেখালো। উৎসকে উপরনিচ একবার দেখলো। আশিন যেদিকে চুমুক দিয়ে কফি পান করেছে সেদিকেই চুমুক বসালো উৎস। শান্ত স্বাভাবিক আওয়াজে বললো,
“ তথাকথিত লোকদেখানো পেশা আর কাজে ফারাক থাকতেই পারে। তবে অভ্যন্তরীণ থেকে ডিগ্রী অর্জন করা পেশা আর কাজে একদমই ফারাক নেই। দেখবে?ʼ
এই বলেই হুট করেই আশিনের দিকে ঝুঁকে এলো উৎস। আশিন পিছিয়ে গেলো না। উৎসর চোখে চোখ রাখলো। উৎস আশিনের বাম গালে একটা চুমু খেলো। আশিন চুপ। কোনো সারাশব্দ নেই। আর না বারতি অভিব্যক্তি। তার অন্য কোনো নারী হলে হয় চড় মেরে বসতো উৎসকে আর নাহয় লজ্জায় রাঙা হয়ে দিতো এক দৌঁড়। তবে আশিন দুটোর কোনোটাই করলো না। বরং উৎসর হাত থেকে কফির মগটা কেড়ে নিয়ে আবারও রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে কফি খাওয়া শুরু করলো। কিয়ৎক্ষণ নিরবতা পালন করে আশিনই আগে বলে উঠলো,
“ দমাও নিজেকে। নাহলে মরার সময় খুব কষ্ট পাবে।ʼ
চলবে,…