
রবিন সাহেব ছিলেন আশিনের বাবার বিশ্বস্ত একজন কর্মচারী। আদ্রিয়েন সাহেবের মৃত্যুর পর রবিন সাহেবও উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। বড় হওয়ার পর সবকিছু যখন আশিন জানতে পারলো তখন সে রবিন সাহেবকে খুঁজে বের করলো। আশিন সেদিন রবিন সাহেবের ডায়েরিটা পড়ছিলো। রবিন সাহেবের স্ত্রী শারিন তো উনাকে ছেড়ে চলেই গিয়েছেন। এরপর মেয়েটাকে নিজেই মানুষ করেছিলেন রবিন সাহেব। রবিন সাহেবের মেয়েটার নাম নাকি রুশা। রুশা আর আশিন সমবয়সী দুজন। তবে রুশার বয়স যখন বিশ বছরের, সেসময় ট্যুর থেকে ফেরার সময় মেয়েটা মারা গিয়েছে একটা দূর্ঘটনায়। বছর নয়েক আগের সেই দূর্ঘটনায় শুধু রুশাই নয় মারা গিয়েছিলেন আরও তিনজন ব্যক্তি। যাদের মাঝে দুজন জার্নালিস্ট আর বাকি একজন রুশার স্বামী সঞ্জু। সেই সঞ্জু আর কেউ নয় অফিসার মঞ্জুরীর আপন ভাই। ভাইয়ের খুনীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য মঞ্জুরী আপাতত প্রতিশোধের অনলে দগ্ধ হচ্ছে। রবিন সাহেবও শত চেষ্টা করেও কিছু জানতে পারে নি। তবে আশিন তো সবই জানে।
গাড়ি চালাতে চালাতে হেসে উঠলো আশিন। তার বাবার মৃত্যুর কারণ যে উরফান মহান নিজে, সেটা আশিন বহু আগে থেকেই জেনে গিয়েছিলো। উরফান মহান যে আশিনকে দিয়ে নিজের শত্রুগুলোকে শেষ করাতে চেয়েছে এটা কি আর বলতে? আশিন গাড়ি চালাতে চালাতে খুব জোরে জোরে হেসে উঠলো। গ্রামের লোকদের খুন হওয়ার ঘটনা পুরোটাই মিথ্যা। আশিন সেই লোকদের মারতো না বরং হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে রেখে দিতো সেসব জায়গায় শুধুমাত্র উরফান মহানকে দেখানোর জন্য। আর আশিনের এসব কাজে সহযোগিতা করতো উচ্ছ। ছেলেটা খারাপ নয়। প্রথম থেকেই আশিনকে সহায়তা করে আসছে। ওকে চোখে চোখে রাখার জন্য উরফান মহান বোনের ছেলের আশেপাশে রেহানাকে পাঠিয়েছিলো। প্রথম প্রথম উচ্ছ সেটা না বুঝলেও পরবর্তীতে সব বুঝে গিয়েছিলো। রেহানা জীবিত নেই। আর না উচ্ছ তাকে মেরেছে!
তাকে মেরেছে উরফান মহানের লোকেরা। উচ্ছ তো শুধু লাশটাকে কবর দিয়ে দিয়েছিলো। এখানে সেখানে পড়ে থাকার চেয়ে কবরে পাঠিয়ে দেওয়া তো অনেক ভালো।
উরফান মহান নিজের ছোট বোন দুটোকেও নিজেই মেরে ফেলেছে। উচ্ছ-উৎসর মা উর্মিলা মহান আর উষা মহানকে। অথচ উষা মহানের মৃত্যুর কারণ হিসেবে সবাই আশিন আর উচ্ছকেই সন্দেহ করছিলো। উচ্ছ আশিন এসমস্তকিছু জানলেও বাঁধা দেয় নি দুজনে। কারণ ওমন পাপীর মৃত্যুই শ্রেয়। আশিন অবাক হয়েছে তো উৎসকে নিয়ে। মানুষটাও আটকায় নি। অদ্ভুত কান্ড!
আশিনের ফোনে কল আসলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো ইভান কল করছে। এই ছেলেটাও আশিনকে অনেক সাহায্য করেছে। তবে ছেলেটা সাইকোপ্যাথ। মানুষ খুন করতে নাকি তার ভাল্লাগে। আশিন মুখ ব্যাকালো। এই ছেলে তো জেলে ছিলো, ফোন পেলো কোথা থেকে?
“ উহুম, উহুম। ভালো আছেন আশিন? ʼ
ইভানের ভাঙা কণ্ঠস্বর। অসুস্থ নাকি? আশিন একটু কেশে নিলো অতঃপর বললো,“ ভালো আছি। তুমি ফো…ʼ
আশিনের কথা থেমে গেলো গাড়ির সামনে কেউ আসতেই। হুট করেই ব্রেক কষলো আশিন। একদম মানুষটার গায়ে ছুই ছুই অবস্থায়। কল কেটে দিলো। স্থির হলো চক্ষুদ্বয়। অনেকদিন পর দেখা পেলো মানুষটার। যার দেখা পেলে মনের অজানা অনুভুতিরা বিদ্রোহ শুরু করে। অব্যক্ত আবেগগুলো মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা ঝাপটিয়ে খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। তবে আশিন তো আশিন। মনে যতই ক্ষত হোক, ঘা হোক তবুও টিনএজারদের মতো করে তো আর বলবে না কিছু! বরং আবেগ ভেবে উঁড়িয়ে দেয় সব।
আশিন খেয়াল করলো সে সুস্থ স্বাভাবিকই আছে। তবে বিপরীতের কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে সুস্থ স্বাভাবিক লাগছে না। দেহে জড়ানো শার্টে রক্তের ছাপ আর চোখেমুখে ক্লান্তির। গাড়ি থেকে নামলো আশিন। বাম হাতে গুলি লেগে প্রায়ই কুপোকাত হওয়া উৎস তাকালো আশিনের দিকে। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসতে চাইলেও খোলা রেখেছে উৎস। উৎসকে দূর্বল মানায় না। সে তো ইস্পাতের ন্যায়, দূর্বলতা তার নিকট অপশক্তি মাত্র।
“ উৎস তালুকদারেরও যখম হয় এভাবে? ʼ
উৎসর ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা দেখা গেলো। সটান হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে করতে স্বাভাবিক আওয়াজেই বলার চেষ্টা করলো,
“ তুমি তো ডাক্তার, যখমে প্রলেপ না লাগিয়ে এভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছো কেনো?ʼ
“ তোমার অবস্থা দেখছি আগে। ʼ
“ অবস্থা দেখছো নাকি আমাকে দেখছো?ʼ
“ কে তুমি? তোমাকে দেখতে যাবো?ʼ
হাসলো উৎস,“ তোমার পাথর হৃদয়ে বার বার আন্দোলন তোলা সেই সৈন্যদের একবার জিজ্ঞাসা করে দেখো, কে এই উৎস তালুকদার?ʼʼ
কথাটা বলতে বলতে ধীর পায়ে ঢুলুঢুলু অবস্থায় গাড়ির দিকে এগিয়ে এলো উৎস। গাড়ির দরজা খুলে ফ্রন্ট সিটে বসে পড়লো। আশিন কিছুক্ষণ ভাবলো উৎসর বলা কথাটা। ছেলেটা কি আইন নিয়ে পড়াশোনা করার বদলে সাইকোলজি নিয়ে পড়েছিলো নাকি? এসবই ভাবতে ভাবতে গাড়িতে উঠে বসলো। একবার আড়চোখে উৎসর দিকে তাকালো। উৎস একটু হেসে বলল,
“ আড়চোখে তাকানোর কোনো দরকার নেই। পাশপাশি যেহেতু আছি,চাইলে একটা চুমুও খেতে পারো।ʼ
মুখ ব্যাকালো আশিন,“ দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ করো।ʼ
উৎস হো হো করে হেসে উঠলেও এতটা আহত হওয়ার দরুণ হাসিতে তেমন একটা প্রাণ নেই। নয়তো এই সুদর্শন পুরুষটার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিলো তার হাসিটা। আশিনের হাত নিশপিশ করতে লাগলো মানুষটার ক্ষত স্থানে একটু ছুয়ে দেওয়ার জন্য। তবে কিছু একটা দ্বিধা।
গাড়ি চলা শুরু করলো। আশিন জানে উৎসর এই আহত হওয়ার পেছনে কার হাত আছে? একবার সুযোগটা শুধু আশিন পেয়ে যাক তারপর সবগুলোকে বোঝাবে ভুল জায়গায় গুলি ছোড়ার শাস্তি ঠিক কেমন হতে পারে? মিরোরে একবার উৎসর দিকে তাকালো আশিন। মানুষটা চোখ বুজে সিটে হেলান দিয়ে রয়েছে। ঘুমাচ্ছে নাকি সেন্সলেস হয়ে পড়েছে। আশিন রাস্তার সাইডে গাড়িটা থামালো। সূর্যটা তখন পশ্চিমে অস্ত যাচ্ছে। লালচে আভায় আকাশ ছেয়ে। উৎসর পাশে জানালাটা খোলা থাকায় উৎসর মুখে এসে লালচে আভার ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে। মানুষটাকে নিষ্পাপ আর সুন্দর লাগছে।
আশিন উৎসর দিকে কিছুটা ঝুঁকে এসে বাম হাতটা পর্যবেক্ষণ করলো আগে। তারপর নাকের কাছে আঙুল নিতেই উৎস আশিনের হাতটা ধরে ফেললো। অবাক হলো না আশিন। স্বাভাবিক রইলো। আজ প্রায় তিনবছর যাবৎ দুজন দুজনের পরিচিত। প্রথম প্রথম ভুল বোঝাবুঝি থাকলেও উৎস যখন আশিনের সত্যিটা জানতে পেরেছে। আশিন যে নিরপরাধ মানুষদের খুন করেনি, সে থেকেই মানুষটা আরও বেশি ঝুঁকেছে আশিনের প্রতি। আশিন সেসব বুঝেও না বোঝার ভান ধরে। নিজেকে সংযত রাখে প্রেম ভালোবাসা নামক জুটঝামেলা থেকে। উৎস তো মানবে না যে আশিনের মতো পাপীষ্ঠদের সাথে উৎসকে মানাবে না। কোথায় আকাশ আর কোথায় পাতাল। সবকিছুর তো আর পূর্ণতা থাকে না। হতাশার শ্বাস ছাড়লো আশিন। উৎস ম্লান হেসে বলে উঠল,“ ভালোবাসি। ʼʼ
আশিন উৎসর থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আবারও গাড়ি স্টার্ট দিতে উদ্যত হলো। কিছুদূর যেতেই আশিনের অবচেতন মন হুট করেই জিজ্ঞাসা করে উঠলো,“ কতটুকু? ʼ
নিজের প্রশ্নে নিজেই অবাক হলো আশিন। এ কেমন টিনএজারদের মতো প্রশ্ন? নিজেকে অষ্টাদশী বালিকা মনে হলো তার। উৎস জানালা দিয়ে আকাশপানে তাকিয়ে ছিলো। আশিনের প্রত্যুত্তরে সঙ্গে সঙ্গেই বললো,
“ যতটুকু ভালোবাসলে তুমি আশিন পুরো এক জীবন আমার সাথে নির্দ্বিধায়,নিঃসংকোচে আর নির্ভয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে। ʼʼ
চলবে,…
- Junani CH