বাহারি স্বপ্ন [পর্ব-৩০]

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই আশিনকে অবাক করে দিয়ে উৎস হঠাৎ করেই বলে ওঠে,“ ক্ষুধা পেয়েছে খুব। খাবার থাকলে কিছু খেতে দাও।ʼ

আশিন উৎসর দিকে গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আশিনের চাহনীর ভাষা এমন যেন উৎস কোনো দণ্ডণীয় অপরাধ করে ফেলেছে। উৎস আশিনের এমন চাহনীতে ভ্রু কুঁচকে বললো,“ খাবার চেয়েছি, পাপ করিনি কোনো? তবে এমন চাহনী কেন?ʼ

আশিন স্বাভাবিক হলো। দৃষ্টি উৎসর দিকে রেখেই বললো,“ তোমার নিহাল, বিশাল, শাওন এসব বন্ধু কোথায়? এরা কি তোমাকে রান্না করে খাওয়ায় না?ʼ

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো উৎস,“ খাওয়ায় তবে আমার মন শুধু আশিনের হাতের রান্না খেতে চাইছে।ʼ

“ ঠিক আছে চলো তোমাকে খাওয়ায়।ʼ

উৎস বাঁকা হেসে বললো,“ কি?ʼ

আশিন মুখ কুঁচকালো,

“ বিষ।ʼ

উৎস হো হো করে হেসে উঠলো। নিচে নেমে এলো দুজন। আগে থেকেই রান্না করেছিলো আশিন। এই ছেলেটার সাথে তার অনেক আগে থেকেই পরিচয়। গ্রামে দেখা,ঝগড়া এসমস্তকিছুই অভিনীত। শুধুমাত্র আশেপাশে মানুষদের চোখে ফাঁকি দিয়ে ঝগড়ার মাঝেই নিজেদের পরিকল্পনাগুলো বিনিময় করতো। কিন্তু তাদের মাঝেও কোনো বিশ্বাস ছিলো না কখনও। উৎসও আশিনকে বিশ্বাস করতো না আশিনও উৎসকে না। তবে উৎস আশিনকে ভালোবাসে। তাদের সম্পর্কই এমন যেখানে ভালোবাসা আছে তবে একজনের পক্ষ থেকে প্রকাশ্য হলেও অপরজনের পক্ষ হতে নিরবতা আর এক আকাশ পরিমাণ শুধু অবিশ্বাস। অথচ ভালোবাসার অন্যতম এক শর্ত হলো বিশ্বাস। তবে দুজনের জীবনই এমন যে কেউ কাউকে বিশ্বাসই করে না। অবশ্য ভালোবাসা হলোই বা কোথায়? এখনও দুজন দুই মেরুতেই অবস্থিত। উৎস এগিয়ে আসতে চাইলে আশিন উৎসর গলা চেপে ধরবে এমনই অবস্থা তাদের। অদ্ভুত!

উৎসকে খাবার বেড়ে দিলো না আশিন। উৎসও অবশ্য বসে রইলো না আশিনের অপেক্ষায়। ডাইনিং এর সামনে এসেই চেয়ার টেনে বসে পড়ে উৎস। টেবিলে থাকা ভাত তরকারি নিজের পাতে বেড়ে নিয়ে একটি প্লেটে হাত ধুয়ে সেখানেই খাওয়া শুরু করবে এমন অবস্থায় আশিনের দিকে তাকালো উৎস। এক লোকমা আশিনের মুখের কাছে তুলে ধরে বললো,

“ বিজ্ঞানী, তোমাকে বিশ্বাস নেই। বিষ টিষও মেশাতে পারো। তাই আগে তুমি এক লোকমা খেয়ে দেখাও। তুমি যদি না মরো তাহলে আমি খাবো।ʼ

বিরক্ত হলো আশিন। ‘তো এতো জানিস খেতে বসেছিস কেন?’ মনে মনে এসব ভাবলেও মুখে বললো,“ বিষ খেতেই বসেছো তবে এখন আবার এসব ড্রামা করছো কেন?ʼ

উৎস খাবারের দিকে ভালোভাবে তাকালো। তরকারির কালারটা সুন্দর হয়েছে। দেখতে লোভনীয় লাগছে। লোকমাটা মুখে পুরে নিলো উৎস। ঠোঁটে লেগে আছে মৃদু হাসি। আশিন খেয়াল করলো সেটা। আশিনকে অবাক দেখালো উৎসকে খেতে দেখে। উৎস কি তাকে বিশ্বাস করেই খেলো নাকি? আশিন জানতো উৎস আসবে তার বাসায় আজ। তাইতো এতো খাবারের আয়োজন।

“ তোমাকে বিস্মিত লাগছে শিনজান!ʼ

উৎসর প্রশ্নে ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে এলো আশিনের। অন্যদিকে তাকিয়ে মুখ বেঁকিয়ে বললো,

“ বিস্মিত কেন লাগবে? আজব! আর ওই নামে ডাকা বন্ধ করো তুমি। কি বিশ্রি নাম। নামটা শুনলেই নিজেকে শিম্পাঞ্জি মনে হয়।ʼ

আশিনের কথা প্রেক্ষিতে কোনো জবাব দিলো না উৎস। বরং প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,

“ আমাকে বিশ্বাস করো তাই না?ʼ

“ ফালতু কথা কম বলো।ʼ

উৎস হো হো করে হেসে উঠলো। খুব তৃপ্তিভরে খাওয়া শুরু করলো। আশিন কেমন করে তাকিয়ে রইলো। আশিনের এমন চাহনী উৎসর চোখ ফাঁকি দিতে পারলো না। উৎস খেতে খেতেই বললো,“ অনেকদিন যাবৎ খেতে পাই না তো তাই এভাবে খাচ্ছি।ʼ

আশিন সেখান থেকে সড়ে গেলো। বিড়বিড় করে বললো,“ বিরক্তিকর।ʼ

উৎস পুনরায় হাসলো। খাওয়া শেষে নিজের প্লেট নিজে ধুয়ে নিলো ছেলেটা। আশিন সোফায় বসে সবকিছুই তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করে নিলো। উৎস এসে এবার সোজা তার মুখোমুখি বসে পড়লো। আশিন চোখ সড়ালো না। ‘কেউ যদি তাকায় তোমার দিকে তবে চোখ সড়াবে না, সে যেই হোক না কেন!’ আশিনও এই বাক্যের বিপরীতে গেলো না। আশিনের এমন চাহনীতে উৎসই চোখ সড়িয়ে নিলো। আশিন শক্ত মনের। মেয়েটার কিছু হবে না। তবে উৎসর হবে। ভয়ানক কিছুই হবে। ভয়ানক কিছুই করে ফেলবে। উৎস এদিক ওদিক তাকালো। আশিনের দিকে আবারও চোখ পড়লো। মেয়েটাকে সে ভালোভাবে প্রথমে খেয়াল না করলেও এখন দেখলো আশিন সালোয়ার কামিজ পড়েছে, কালো রঙা। ফর্সা দেহে এই পোশাকে মেয়েটাকে শুভ্রপরি লাগছে যেন। গ্রামে আশিনের নিজস্ব মিশন পুরণে ছাড়া আর কখনও এই পোশাকে দেখে নি উৎস। হ্যা একবার অবশ্য শাড়িও পড়েছিলো মেয়েটা। উৎসর মুখে খুব সুন্দর হাসি ফুটলো। আশিন চরম অবাক হলো। এই ছেলের হয়েছে-টা কি? একা একাই হাসছে?

“ পাগল হলে নাকি? হাসছো কেন? অদ্ভুত!ʼ

উৎস হো হো করে হাসলো। আশিন এবার বিরক্তি নিয়ে বললো,“ খুবই বাজে স্বভাব।ʼ

উৎস উঠে দাঁড়ালো। আশিনের দিকে ঝুকে পড়লো কিছুটা। আশিন তাকালো উৎসর চোখে। নভেমবরের মাঝামাঝি সময় হওয়ায় কিছুটা ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া শুরু হয়েছে। ঋতু পরিবর্তন হবে কিছুদিন বাদে। এবছরের অক্টোবরে একটি গান বেরিয়েছে ইংলিশ গান। সাউন্ড বক্সে, স্লো মোশনে আশিন ওই গানটাই ছেড়ে দিয়েছিলো। Katy perry নামক জনপ্রিয় শিল্পীটির ‘Harleys in Hawai’ গানটা। ঢীমে আওয়াজে বাজছে। উৎসর এমন চাহনীতে অদ্ভুত আফিম মেশানো। আশিন ভড়কালো। তারওপর ওদিকে গানের আওয়াজে রোমাঞ্চকর মুহুর্ত সৃষ্টি হলো মুহুর্তের মাঝেই। এরই মাঝে উৎস টুপ করে আবারও আশিনের গালে একটা চুমু দিলো উৎস। তারপর চলে চলে যেতে যেতে গান ধরলো,

“ আমার এই বাজে স্বভাব, কোনোদিন যাবে না।ʼ

______________________________

বিশাল এক বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আশিন। রাস্তার অপোজিট সাইডে। হাতে থাকা ঘড়িতে সময়টা একবার দেখে নিলো আশিন। রাত বারোটা বেজে তেরো মিনিট। হাতে থাকা হুডিটা পরনের শার্টের ওপর পড়ে নিলো। ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেলো পাশ দিয়ে। খুবই ঠান্ডা সেই হাওয়া। গা ছমছম করার মতো। আশিনের কাঁধে ঝুলে থাকা ব্যাগটা থেকে ল্যাপটপ বের করে আনলো। সেখানে কিছু একটা ক্লিক করে সার্ভেইল্যান্স ড্যাশবোর্ডে বিশাল সেই বাড়িটার সিসিটিভি ক্যামেরার বর্তমানের সমস্ত ফুটেজ বা ক্যামেরার ছবি তার ল্যাপটপে ভেসে উঠলো। আশিন ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো কড়া পাহাড়ায় থাকা এই বিশাল বাড়িটির আনাচে কানাচে। বাড়ির সিসিটিভি হ্যাক করেছে আশিন। আশিন খুব দ্রুত সার্ভার আর স্টোরেজ ডিভাইস ডাউন করে দিলো। ব্যাগে ল্যাপটপ ঢুকিয়ে এবার অগ্রসর হলো সামনের দিকে। বাড়ির পেছনের দিকটাই এগিয়ে গেলো আশিন। দেয়াল টপকাতে পারবে না। কারণ দেয়ালের উপরিভাগে বৈদ্যুতিক তারের ব্যবস্থা রয়েছে।

আশিন বাড়ির পেছনের দিকের রাস্তাটার বাম দিকে গিয়ে পকেট থেকে গা’নটা বের করে আকাশমুখী একটা শ্যুট করলো। এতেই শব্দ হলো ভীষণ। ভেতরে থাকা গার্ডগুলো সতর্ক হলো এবং কিছুজন দরজা খুলে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিলো। আশিন দ্রুত পায়ে অপরপার্শ্বে লুকিয়ে গেলো। গার্ডগুলো সব প্রাচীরের ভেতরে হওয়ায় বাইরের এমন লুকোচুরি বেশ সহজই হলো। কিছু গার্ড বেরিয়ে আসলো। সবার পরনের জামা কাপড় একই। কালো রঙের। এরই সুযোগ বুঝে আশিন সেই ছোট্ট গেইটটার দিকে এগিয়ে গেলো। গেইটের সামনে গিয়ে কাউকে তেমন দেখতে পেলো না। সবাই দূরে দূরে অবস্থানরত। আশিন গাছগাছালির পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। খুবই সূক্ষ্মভাবে দেখলো সামনের দৃশ্য। বাড়িটাতে প্রবেশ করতে ঠিক কত সময় লাগবে আর কত সময়ের মাঝেই সিসিটিভি সার্ভার এরা ঠিক করে ফেলবে!

আশিন এদিক ওদিক তাকিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো আবারও। এরই মাঝে দুজন গার্ডের সামনে গিয়ে পড়লো আশিন। দ্রুতপদেই লোক দুটোর ওপর আক্রমণ করলো আশিন। আশিন শুধু বিজ্ঞান নিয়েই থাকে নি। নিজের আত্মরক্ষার্থে আর প্রতিশোধপরায়ণতার জন্য সমস্তকিছুই নিজের আয়ত্তে নিয়ে রেখেছে মেয়েটা। এখন শুধু প্রয়োগ করছে।

আবারও সামনে অগ্রসর হলো। যা করার আগামী ত্রিশ মিনিটের মাঝেই কর‍তে হবে। বাড়ির পেছনের রান্নাঘরের ওদিকে কেউ নেই। সেদিকেই এগিয়ে গেলো আশিন। রান্নাগজরের জানালাটা ভাগ্যক্রমে খোলা থাকায় সেই জানালা দিয়ে প্রবেশ করলো ভিতরে। সব গার্ডরা বাইরে হওয়ায় ভেতরে তেমন লোকজন নেই শুধু বাড়ির মানুষরা বাদে। আশিন রান্নাঘর থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় কারও পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো সে। এদিকে বাড়ির পাশেই ছোট্ট কন্ট্রোল রুমে থাকা দুজন লোক সিসিটিভির সার্ভার ঠিক করতে ব্যস্ত তখন। আশিন লুকিয়ে পড়লো। অন্ধকার হওয়ায় দেখা গেলো না কে এসেছে? তবে ফ্রিজ খুলে পানির বোতল নিয়ে চলে গেলো মানুষটা। আশিন খুব ভালোভাবে বুঝলো এটা আর কেউ নয় সরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলে তাওসিফ। বাইরের গুলির আওয়াজ শুনেই জেগেছে নাকি অন্যকিছু?

তাওসিফ চলে যেতেই আশিন বেরিয়ে এলো। রান্নাঘরের দরজার কাছটাই আসতেই তাওসিফের মুখোমুখি হলো আশিন। আশিন চমকালো না। বরং তাওসিফকে এই অন্ধকারেও মৃদু আলোর সান্নিধ্যে ভীত দেখা গেলো। গুলির আওয়াজ সেও শুনেছে। দিনকাল তো আর ভালো যাচ্ছে না। যতই কোর্ট বেকসুর খালাস দেক আসল জনই তো তাদের বিপক্ষে। নিশ্চিন্তে ঘুম হবে কি? হবে না তো! তাই তো তাওসিফ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রান্নাঘর থেকে ঠান্ডা পানির বোতল নিতে এসেছিলো। তবে মৃত্যুকে এতো কাছে দেখতে পাবে আশা করে নি। এদিকে আশিন পকেট থেকে সাইলেন্সার দেওয়া থাকা গা*নটা বের করলো এবার। চোখের পলকে তাওসিফের মাথায় ঠেকালো সেটা। আরেকটু ঝুকে তাওসিফকে আস্তে আস্তে বললো,

“ শব্দ করলে তো মরে গেলে। সবার সামনে মরে যাওয়ার চাইতে নিঃশব্দে মরো। এতে করে আমিও ফাঁসবো না, মৃত্যুর পর তোমারও আর বদনাম হবে না। যে সরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলে তাওসিফ রহমান এক মেয়ের হাতে মৃত্যুবরণ করেছে।ʼ

চলবে,…

  • Related Posts

    প্রণয় প্রহেলিকা [পর্ব- ৩১]

    সকলের একটাই কথা,  “শেষমেশ বাচ্চার কাছেই হৃদয় হারালি?” অনল তখন গর্বের সাথে বললো,  “তাহলে বুঝে দেখ আমার বউটি কতো গুণী, আমার হৃদয় চুরি করা যার তার কাজ নয়।” ধারা তো…

    সেদিন ও সে [পর্ব-০১]  

    মাঝরাতে যখন টের পেলাম সৌজন্য পরকীয়ায় জড়িত, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেদিন সন্ধ্যায়-ই আমি জানতে পারি আমি প্রেগন্যান্ট। সৌজন্য বাসায় এসেই নিজের ক্লান্তি দেখিয়ে ঘুমিয়ে গেছে বিধায় তাকে আর কিছুই বলা…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You Missed

    প্রণয় প্রহেলিকা [পর্ব- ৩১]

    প্রণয় প্রহেলিকা [পর্ব- ৩১]

    সেদিন ও সে [পর্ব-০১]  

    সেদিন ও সে [পর্ব-০১]  

    বাহারি স্বপ্ন [পর্ব-৩০]

    বাহারি স্বপ্ন [পর্ব-৩০]

    প্রণয় প্রহেলিকা [পর্ব-৩০]

    প্রণয় প্রহেলিকা [পর্ব-৩০]

    তৃষিত তরঙ্গ [পর্ব-০১]

    তৃষিত তরঙ্গ [পর্ব-০১]

    বেশ্যার লাশ | সাধুর নগরে বেশ্যা মরেছে

    বেশ্যার লাশ | সাধুর নগরে বেশ্যা মরেছে