
নতুন শহরের অচেনা পরিবেশে যখন আমি একাকিত্বের সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম, তখন পাশের এপার্টমেন্ট থেকে ভেসে আসা গিটারের ছন্দ, গানের সুর আমার নিঃসঙ্গতার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছিল। একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত ফালাক নামের তরুণটি প্রতিদিন সকালের কোমল সূর্যকিরণের স্পর্শে বারান্দায় বসে গান গাইত, সেই সুর আমার ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে আমার হৃদয়ে প্রশান্তির ঢেউ তুলত। মনের বিষণ্নতা মুহূর্তেই উবে যেত, হৃদয়ে আনন্দের ঢেউ আছড়ে পড়ত। শুনেছি ফালাকের স্বপ্ন, একদিন সে বিখ্যাত গায়ক হবে।
সন্ধ্যার আলো-আঁধারির মায়াবী মুহূর্তে ছাদে জমায়েত হতো তার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আড্ডা। বিল্ডিংয়ের ছোট্ট ছেলেমেয়েরা চারপাশে বৃত্ত তৈরি করে বসত, আর ফালাক গান গেয়ে মুগ্ধ করত সবাইকে। কখনো রবীন্দ্রনাথের সুরের মাধ্যমে, কখনো বাংলা ব্যান্ডের উত্তাল ছন্দে, আবার কখনো নিজের অন্তর থেকে উৎসারিত কোনো সুরের মাধ্যমে। সবার মুখে হাসি ফোটানোর এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার। এমন প্রাণবন্ত, এমন আনন্দময় একটা মানুষ! হাসিটা ছিল সংক্রামক – যে একবার দেখত, সেই অনিবার্যভাবে হাসতে বাধ্য হতো। এমন সংক্রামক হাসি তৈমুরেরও ছিল!
মাস দুয়েক পর একটা অদ্ভুত, অস্বস্তিকর ব্যাপার আমার নজরে আসতে শুরু করল। ফালাক আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। আমি যখন বাজার থেকে ফিরি, তখন দেখি রাস্তার ওপাশে সে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। করিডরে হাঁটার সময় পেছন থেকে আসা পায়ের আওয়াজ আমার কানে বাজে। আমি যখন হঠাৎ পেছন ফিরে তাকাই, সে চট করে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে, চোখ এড়িয়ে যায় আমার দৃষ্টি থেকে।
মেয়েদের সহজাত একটা বুদ্ধি থাকে, একটা অন্তর্দৃষ্টি থাকে। আমরা বুঝতে পারি কোনো পুরুষ আমাদের দিকে কীভাবে তাকায়। সেই দৃষ্টিতে কী লুকিয়ে আছে। প্রশংসা, নিছক কৌতূহল, নাকি আরো গভীর কিছু। ফালাকের চোখে থাকা তীব্র আগ্রহ, প্রেমময় আকর্ষণ আমি স্পষ্ট টের পেতে শুরু করলাম।
সবচেয়ে বেশি দেখা হতো লিফটের সংকীর্ণ পরিসরে। আমি উঠতে গেলেই দেখতাম সে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি একা থাকলে সে লিফটে উঠত, অন্য কেউ থাকলে পরের লিফটের জন্য ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করত। আমার দিকে তাকাতো চুপিসারে, লুকিয়ে লুকিয়ে, আমি টের পেয়ে তাকাতেই লিফটের বাটনের দিকে তাকানোর ভান করত।
কিছুদিন পর শুরু হলো তার অজুহাতের নাটক। একদিন দরজায় মৃদু শব্দে নক দিয়ে বলল বিনয়ী স্বরে, ‘মিস ডিম্পল, আপনার কাছে একটু লবণ আছে? আমার শেষ হয়ে গেছে, কাল বাজার করব।’
হাতে একটা ছোট বাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সহজ সরল ভাবে, এমন নিরীহ অসহায়ত্বের সাথে বলল যে, না করার কোনো উপায়ই ছিল না।
কিছুদিন পর এলো চিনি চাইতে। তারপর একদিন এলো আরও জরুরি অজুহাত নিয়ে, ‘আমার ফ্ল্যাটের কারেন্ট চলে গেছে। আপনার কাছে একটা মোমবাতি হবে?’ আমি যখন মোমবাতি দিতে গেলাম, দেখলাম কারেন্ট ঠিকঠাকই আছে।
দিন দিন তার অজুহাতগুলো আরো সৃজনশীল, আরো কৌশলী হতে থাকল। কখনো বলত গলা খাঁদে নামিয়ে, ‘গলা খুসখুস করছে, আপনার কাছে কোন ওষুধ আছে? প্রতিবেশী প্রতিবেশীকে সাহায্য করা তো সওয়াবের কাজ।’
কখনো বলত সংকুচিত ভাবে, ‘সরি বিরক্ত করার জন্য৷ মায়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু আমার ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। আপনার ফোনটা একটু…’এই সব অজুহাতের মাঝে আমি আরও স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, সে আমার সাথে কথা বলার কোন না কোন সুযোগ খুঁজছে। আমার সাথে কিছু সময় কাটানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। আমি যখন হাসতাম, তখন তার মুখও আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠত, যেন সে জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার পেয়েছে।
একদিন দেখলাম সে তার প্রিয় গিটার নিয়ে আমার দরজার কাছে বসে আছে। আমাকে দেখে নিরীহ ভাবে বলল, ‘হ্যালো মিস ডিম্পল, আমার ফ্ল্যাটের পানির লাইন ফেটে গেছে। এখানে বসে একটু অপেক্ষা করি, প্লাম্বার আসবে।’
তারপরই শুরু হলো তার মিষ্টি গলার গান। আমি ঘরের ভেতরে বসে সেই সুরেলা গান শুনতে শুনতে মন হারিয়ে ফেললাম তৈমুরের স্মৃতিতে। ফালাকের এই সব আচরণ আমার হৃদয়ে তার প্রতি কোনো টান সৃষ্টি করার বদলে, বরং তৈমুরের অনুপস্থিতিকে আরও বেশি করে অনুভব করাত। তার প্রতিটি ভঙ্গিতে, প্রতিটি কথায় আমি খুঁজে পেতাম তৈমুরের প্রতিবিম্ব।
আমাদের ভালোবাসার গল্পে প্রথম হৃদয় হারিয়েছিল তৈমুর। বিভিন্ন ছুতোয় আমাকে দেখতে আসত, কথা বলার সুযোগ খুঁজত। সেই একই লজ্জাভরা চোখ, সেই একই সকাল-সন্ধ্যা নানা অজুহাতে দেখা হয়ে যাওয়া। সেই একই উৎকণ্ঠিত মুখ, সেই একই প্রত্যাশায় ভরা দৃষ্টি।
তৈমুর মিথ্যা করে বলত, ‘মা তোকে ডাকছে।’
আমি তাড়াহুড়ো করে ছুটে গিয়ে দেখতাম কাকিমা কিছুই বলেননি। পেছনে ফিরে তাকালেই চোখে পড়ত, তৈমুর দাঁড়িয়ে আছে মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে। ওর আনন্দ দেখে আমার রাগ হতো না। বরং মনে মনে খুশি হতাম।
পরদিন এসে বলত, ‘আমার খাতার পাতা শেষ। তোর কাছে খাতা আছে?’
তারও পরের দিন এসে বলত, ‘কলমের কালি শেষ। একটা কলম দিবি?’
এরপর পেন্সিল, তারপর রাবার। এভাবে প্রতিদিন কোনো না কোনো অজুহাতে আসত। আমি পরিষ্কার বুঝতাম সবই বাহানা। কিন্তু সেই বাহানাই আমার কাছে ভালো লাগত। লজ্জায়, অনুভবে গালদুটো রক্তিম হয়ে থাকত। ভীষণ উপভোগ করতাম। চুপিচুপি মিটিমিটি হাসতাম। আর অপেক্ষা করতাম, আবার কোন অজুহাতে আসবে।
ফালাকের এই একই ধরনের অজুহাত দেখে আমার মনে হচ্ছিল, সময় যেন স্থির হয়ে গেছে। যেন তৈমুরই আবার ফিরে এসেছে, ভিন্ন রূপে, ভিন্ন নামে।
আমি কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজিয়ে ফেললাম। হাতড়ে খুঁজলাম ওর উপস্থিতি। বুঝতে পারলাম, প্রেম একবারই হয়। বাকি সব শুধু অভ্যাস, সময় পার করার উপায়।
সকালে হাঁটতে বের হওয়ার তোড়জোড় করছিলাম। লিফটের দরজা খুলতেই নাকে এসে লাগল মাদকতা ভরা সুগন্ধ। চোখ পড়ল কর্নারে রাখা বেলি ফুলের মালা। আমার প্রিয় ফুল! পুরো লিফটটা ভরে গেছে তার মিষ্টি ঘ্রাণে।
সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিপটে ভেসে উঠল তৈমুরের মুখ। কত মালা দিয়েছিল ও! হিসেব রাখতে গেলে শেষ হবে না। কখনো লাল জবার মালা, কখনো গোলাপের কোমল পাপড়ি দিয়ে, কখনো রজনীগন্ধার উদাস সুগন্ধ নিয়ে। তবে সবচেয়ে বেশি দিত এই বেলি ফুলের মালা। সম্পর্কে জড়ানোর পর ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’ হয়ে বলত, ‘এই ফুলটা ঠিক তোমার মতো। দেখতে যেমন সুন্দর, গন্ধেও তেমনি মাতাল করা।’ বলতে বলতে আমার দিকে এগিয়ে আসত, যেন আমার সুগন্ধ নিতে চায়। আমি লজ্জায় গুটিয়ে যেতাম কচ্ছপের মতো।
রাতের আঁধারে চুপিসারে আমাদের বাগানের বেলি গাছ থেকে ফুল পেড়ে আনত। সারারাত জেগে থেকে একটা একটা করে গেঁথে তৈরি করত মালা। সকালে কলেজ যাওয়ার পথে দিয়ে দিত আমার হাতে। বলত, ‘ফুলের জন্য ফুলের মালা।’ সহপাঠীরা আশেপাশে থাকত বলে আমি লজ্জা পেতাম। কিন্তু লুকিয়ে ঠিকই মালাটা নাকের কাছে নিয়ে প্রাণভরে তার ঘ্রাণ নিতাম।
এই লেখিকার আরো গল্প পড়ুন,…
পরপর তিনদিন একই দৃশ্য ঘটল। প্রতিদিন লিফটে সুগন্ধি বেলি ফুলের মালা। তৃতীয় দিনে মালার সাথে পেলাম একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো। হস্তাক্ষরে লেখা ছিল, ‘আপনার জন্য।’ লিখনশৈলী দেখেই বুঝলাম, ফালাকের কাজ। চতুর্থ দিন লিফটে ঢুকতেই দেখি ফালাক দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে আজকের বেলি ফুলের মালা। আমাকে দেখে একটু এগিয়ে এলো। বারকয়েক ঢোক গিলে বলল, ‘এতো কষ্ট করে ফুলের মালা বানাই আপনার জন্য। নিয়ে যান না কেন? এমন অবহেলা করবেন না। বুকে লাগে।’
ফালাককে কাছে এসে দাঁড়াতে দেখে মনে পড়ে গেল বহু বছর আগের স্মৃতি। তৈমুর স্কুল থেকে ফেরার পথে হঠাৎ হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল এক নীরব গলিতে। খুব কাছে এসে আকুল হয়ে বলেছিল, ‘তুই কি কিছু বুঝিস না? কেন তোর পিছু ঘুরি? কেন তোকে একটু দেখার জন্য বাহানা খুঁজি। এবার তো সাড়া দে। আর কত পাগল করবি আমায়?’
ওর কথা শুনে, নিঃশ্বাসের উষ্ণতা অনুভব করে আমার বুকের ভেতরটা দুলে উঠেছিল। অনুভূতির জোয়ারে মাথা ঘুরে যাচ্ছিল। কোনোমতে তৈমুরকে ঠেলে সরিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম।
ফালাককে কোনো উত্তর না দিয়ে লিফট থামতেই দ্রুত পায়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে চলে গেলাম। দরজা বন্ধ করে দিয়ে বসে রইলাম হতবাক হয়ে। কীভাবে বুঝাব ফালাককে , সে যতো যত্ন ও ভালোবাসা দেখাচ্ছে, তার সবই আমি আগে অন্য কারো কাছে পেয়েছি। তৈমুরও তো একই রকম যত্ন করত। একই রকম ভালোবাসা দিত। পৃথিবীর সব ভালোবাসা একাই বুকে পুষে রাখত। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেও পাল্টে গিয়েছিল।
ফালাকের আগ্রহ, আকুলতা দেখে মনে হচ্ছিল, আমি যেন সময়ের চক্রে আটকে পড়েছি। যেন একই গল্পের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। কেন এই অবিরাম পুনরাবৃত্তি? এই হৃদয় আর কোনো পুরুষের প্রেমে পড়তে চায় না। প্রেমের সব রূপ সে দেখে ফেলেছে। আর কীসে মুগ্ধ হবে? শরীর থেকে তো তৈমুরের ভালোবাসার স্পর্শ কিংবা আঘাত, কোনোটাই মুছে যায়নি।
ফালাকের জন্য শুধু সহানুভূতিই জাগছিল। সে এমন একজনকে ভালোবেসেছে যে তার প্রাপ্য ভালোবাসা দিতে পারবে না। আমি একটা ভাঙা পাত্রের মতো, যেখানে জল রাখলেও তা গড়িয়ে পড়ে যায়। আর ফালাক সেই পাত্রে ভালোবাসার জল ঢালতে চাইছিল।
পরদিন যখন ফালাক আবারও আমার পেছনে পেছনে হেঁটে আসছিল, আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। থেমে গিয়ে তাকে ডেকে স্পষ্ট করে বললাম, ‘আমি ম্যারিড। সেপারেশনে আছি।’
ফালাকের মুখটা সঙ্গে সঙ্গে যেন পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল। চোখ দুটো বিস্ময়ে বিস্তৃত হয়ে উঠল। মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোল না বেশ কিছুক্ষণ। আমি ভাবলাম, হয়তো এবার সে সরে যাবে। হয়তো এই সত্যটুকু জানার পর তার মনে আমার জন্য যে কোমল অনুভূতি ছিল, তা নিঃশেষ হয়ে যাবে। আমি পেছন ফিরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। ফালাকের কণ্ঠস্বর আমাকে থামিয়ে দিল, ‘ডিভোর্স তো হয়েই যাবে। আমার কোনো অসুবিধা নেই।’
আমি স্তম্ভিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ডিভোর্স! শব্দটা প্রবল ঝাক্কি দিয়ে কানে বিঁধল। এক মুহূর্তের জন্য চারপাশের সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল। যেন কেউ আমার মাথার ওপরে বাজ ফেলেছে।
সেদিন সন্ধ্যায় অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে হিসেব করে দেখলাম। পুরো পাঁচ মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে তৈমুরকে ছাড়া। পাঁচটা মাস! এত দীর্ঘ একটা সময় পার করে দিয়েছি একা। কিন্তু তবুও কেন মনে হয় যেন গতকালও ও আমার পাশে ছিল? কেন ওর স্মৃতিগুলো এখনো এত প্রখর, এত জীবন্ত?
রাতের পর রাত জেগে থেকে ভাবতাম, এর কারণ কী? বিবাহের বন্ধনটা এত শক্তিশালী যে সেটা আমাকে এখনো বেঁধে রেখেছে? নাকি আইনত এখনো তার স্ত্রী হয়ে থাকায় আমার অবচেতন মন মুক্ত হতে পারছে না? হয়তো ডিভোর্স না হওয়া পর্যন্ত এই যন্ত্রণা, এই টানাপোড়েন শেষ হবে না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, দেশে ফিরে যাব। ডিভোর্সের কাগজপত্র সম্পন্ন করে আসব।
এত দিনে নিশ্চয়ই তৈমুরও এগিয়ে গেছে জীবনে। নতুন কাউকে খুঁজে পেয়েছে। আমাদের বিবাহিত জীবনের শেষ দিনগুলোতে ও দানবের মতো আচরণ করেছিল। ওর পক্ষে নতুন কাউকে গ্রহণ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এবার গিয়ে সব কিছু পরিষ্কার করে আসব। ডিভোর্স নিয়ে এসে অদৃশ্য শিকলগুলো ভেঙে ফেলব। অতীতের সব পিছুটান মুছে দিয়ে নতুন করে শুরু করব জীবন। তবেই আমি সত্যিকারের মুক্তি পাব।
মাত্র চার দিনের মধ্যে সব ব্যবস্থা সেরে আমি ঢাকায় পৌঁছে গেলাম। সোজা চলে এলাম তৈমুরের ফ্ল্যাটে। গেটে পৌঁছাতেই দারোয়ান কাজি মিয়া আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। তার চোখে অবিশ্বাস, বিস্ময়! কতদিন পর দেখলেন আমাকে!
মুখ খুলে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই আমি সেই দৃষ্টি এড়িয়ে দ্রুত পা বাড়ালাম। লিফটে উঠে তৃতীয় তলায় পৌঁছলাম।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপতে গিয়ে দেখি দরজাটা খোলা। অর্ধেক খোলা। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো মনে। পরে শুনেছিলাম, আমি চলে যাওয়ার পর থেকে তৈমুর নাকি আর কখনো দরজা বন্ধ করেনি। বিশ্বাস করত, আমি যেকোনো মুহূর্তে ফিরে আসব। আর তখন যেন দরজা খুলতে দেরি না হয়।
ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। আমার নিজের হাতে সাজানো সংসার দেখে বুকটা কাঁপতে লাগল। পাঁচ মাস ধরে জমাট বাঁধা বরফের মতো শক্ত হয়ে থাকা আমার হৃদয়ে যেন কেউ ভারী হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করল। ফাটল ধরে গেল সেই বরফে।
আমি নিঃশব্দে আমার থাকার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। ঘরে ঢুকে দেখি, সবকিছু ঠিক যেখানে রেখে গিয়েছিলাম, সেখানেই আছে। আমার বইগুলো, আমার পুতুল, এমনকি আমার চুলের ক্লিপটাও ড্রেসিং টেবিলে সেই জায়গাতেই পড়ে আছে। কী অবিশ্বাস্য! যেন সময় থেমে গেছে এই ঘরে।
পরক্ষণেই আমার চোখ পড়ল মেঝেতে। হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে তৈমুর। গভীর ঘুমে বিভোর। তার চেহারা দেখে চমকে উঠলাম। দাড়ি-গোঁফ অনেক লম্বা হয়েছে। কাপড়চোপড় এলোমেলো। যেন অনেক দিন ধরে নিজের যত্ন নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আমার বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠল। এক অদ্ভুত যন্ত্রণা আর করুণায় ভরে উঠল মন। আমি অনুভব করতে লাগলাম, আমার হৃদয়ের বরফ গলতে শুরু করেছে। গলে গলে পানি হয়ে ঝরে পড়ছে।
না, আমি গলে যেতে পারি না! আমি আবার এই ভুলে ফিরতে পারি না। আমি তো এসেছি সব শেষ করে দিতে, নতুন করে শুরু করতে। তবে কেন আমি এভাবে গলে যাচ্ছি? কেন আমার মন চাইছে তৈমুরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে?কতদিন পর দেখলাম ওকে! কতদিন ওর বুকের উষ্ণতা আমাকে স্পর্শ করেনি। কতদিন ওর নিঃশ্বাসের ছোঁয়া আমি পাইনি। আমার হাত কাঁপতে লাগল। পা দুটো যেন অবশ হয়ে গেল। আমি দাঁত কামড়ে নিজেকে আটকালাম। গলে যাওয়ার ভয়ে পালাতে শুরু করলাম। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে পা লেগে গেল ড্রেসিং টেবিলের কোণায়। কিছু একটা পড়ে গেল। আওয়াজ শুনে জেগে উঠল তৈমুর।
আমি থাকতে পারলাম না। দৌড়ে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। পিছন থেকে তৈমুরের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিল, ‘অলকা! অলকা দাঁড়াও, অলকানন্দা…’
আমি থামলাম না। থামতে পারলাম না।
থামলেই হেরে যাব। আমি হেরে যেতে চাই না।
- ইলমা বেহরোজ