বিরহ বীণার সুর [পর্ব-০১]

খুব অল্প বয়সে প্রেম নামক সমুদ্র তার পূর্ণাঙ্গ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমার নিরীহ হৃদয়ের উপর। অনুভূতির প্রবাহ এতটাই তীক্ষ্ণ ছিল যে মনে হতো আমার সমস্ত চেতনা, সমস্ত আবেগ একসাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। দিনকে দিন যেন অতল সাগরে ডুবে যাচ্ছিলাম। নিঃশ্বাসের জন্য হাহাকার, বুকের কাছে পানির চাপ, আর মধুর দমবন্ধ অনুভূতি; একইসাথে যন্ত্রণাদায়ক এবং পরমসুখের।

আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল নাটকীয়ভাবে, সেদিন পাড়ার মাঠে আমরা বাচ্চারা ‘জামাই-বউ’ খেলায় মেতে উঠেছিলাম। এই খেলায় একজন ‘জামাই’ হয়, আর বাকি মেয়েরা ‘বউ’ সাজে। জামাই তার পছন্দের বউ বেছে নেয়। সেদিন তৈমুর নামে ছেলেটি ‘জামাই’ হয়েছিল। আমি ছিলাম প্রতিযোগী ‘বউ’দের দলে। অনেকগুলো মেয়ের মাঝ থেকে যখন তৈমুর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আমাকে বেছে নিয়েছিল, তখন অবুঝ মনেই আনন্দে হাততালি দিয়েছিলাম।

তারপর থেকে শুরু হলো আমাদের একসঙ্গে পথ চলার অভিযান। কৈশোরে আমরা বন্ধু থেকে প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে উঠলাম। তৈমুর ছিল আমার দুই বছরের সিনিয়র। আমরা একই স্কুলে, একই কলেজে, একই ভার্সিটিতে পড়েছি। প্রতিবার ও আমার দুই ক্লাস উপরে থাকত। তবুও আমাদের জীবনধারা এমনভাবে সংযুক্ত ছিল যে মনে হতো আমরা একই তালে, একই ছন্দে জীবন যাপন করছি। একসঙ্গে স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে যাওয়া, একসঙ্গে বাড়ি ফেরা, পরীক্ষার আগে রাত জেগে ফোনে পড়া রিভিশন করা, ক্যান্টিনের চা ভাগাভাগি করে খাওয়া; সবকিছুতেই আমরা ছায়ার মতো জড়িয়ে থাকতাম। সকলের কাছে তৈমুর-আমি মানেই ছিলাম চিরকালের আদর্শ জুটি।

যতদিন গেছে, আমাদের সম্পর্কের শিকড় আরও গভীরে গেঁথে গেছে। প্রেম একটা অনুভূতি থেকে রূপান্তরিত হয়েছে জীবনের অপরিহার্য অংশে। আমরা একে অপরের অস্তিত্বের এমন অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিলাম যে আলাদা থাকাটা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। তাই আমরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিয়েতে কোনো জমকালো আয়োজন ছিল না, কিন্তু আকাশের রং সেদিন একটু বেশিই নীল ছিল। বাতাসে একটা মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল।

তারপর একদিন, আমাদের নির্ভার প্রেমের গল্পটা হঠাৎ করে ছিঁড়ে গেল একটা থাপ্পড়ে। বিয়ের ঠিক এক বছর পর, একেবারে সামান্য কারণে তৈমুর আমার গায়ে হাত তুলল। থাপ্পড়ের আওয়াজে আমার প্রিয় বিড়ালটা পর্যন্ত লাফিয়ে উঠেছিল। আমি ছিলাম নির্বাক। শরীরটা কাঁপছিল না, অথচ ভেতরে কোথাও একটা ফাটল ধরছিল। যেন একটা শক্ত কাঁচের দেয়াল চুরমার হয়ে গেছে। এ কি আমার সেই তৈমুর? যে মানুষটার চোখে আমি মায়া খুঁজে পেতাম, যার স্পর্শে সারা পৃথিবী কোমল হয়ে যেত, যে মাঝরাতে সোহাগ করে কপালে চুমু দিয়ে বলত, ‘তুমি আমার পৃথিবী’। সে কীভাবে এমন করতে পারল? প্রশ্নটা আমার মনে হাজার বার করে বাজছিল।

আমি সেদিন যন্ত্রণায় কাঁদিনি, থাপ্পড়টা খুব একটা ব্যথা দেয়নি। আমি কেঁদেছিলাম চেনা মানুষকে হঠাৎ অচেনা হয়ে যেতে দেখে। মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে সারারাত কেঁদেছি, মাথার ভেতর শুধু ঘুরছিল, ‘ কেন এই পরিবর্তন? কী এমন করেছি আমি?’

পরদিন তৈমুর ক্ষমা চেয়েছিল। নরম গলায়, মায়াভরা চোখে। ওর মুখটা আমার দুর্বলতা ছিল, একবার তাকালে সব অভিমান ভুলে যেতাম। বড্ড ভালোবাসতাম যে। তাই ওর ক্ষমার অভিনয়ে আমি নরম হয়ে গেলাম। ভাবলাম, হয়তো ওর খারাপ দিন ছিল। হয়তো কোনো চাপে ছিল। প্রেমের অন্ধত্ব এমনই, যেখানে কালো রঙটাও সাদা দেখায়। আমি নিজেকে বোঝালাম, এটা একটা দুর্ঘটনা। আর হবে না।

কয়েক সপ্তাহ পর আবারও একই দৃশ্যপট। এবার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ঠিক পরেই হঠাৎ করেই রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল, কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই গলা চেপে ধরল। সঙ্গে ঝরে পড়ল বৃষ্টির মতো কটু কথা, যেন শব্দ নয়, তীক্ষ্ণ বিষের তীর। প্রতিটি শব্দ আমার কানে না লেগে, গিয়েছিল ঠিক বুকে, চেপে বসেছিল শ্বাসের ওপর।

শরীরে তখন আমার একচিলতে কাপড় মাত্র। সেই অবস্থায় ওর মুখ থেকে ঝরে পড়া নোংরা গালিগুলো মনে গেঁথে রইল ট্রমার মতো। আমি কিছু বলার সাহস পেলাম না, শুধু স্তব্ধ, কাঁপা চোখে তাকিয়ে ছিলাম। যার চোখে একদিন ছিল উপচানো মায়া, আজ সে আমাকে এমন চোখে দেখছে, যেন আমি কিছুই না, এক পশলা ধুলোর চেয়েও হালকা। কুকুরের চেয়েও অধম।

আমি আবারও গলা ছেড়ে কাঁদলাম, পাগলের মতো কাঁদলাম। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কেঁদে জ্বর বাঁধালাম।

আমি ছিলাম বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। আদরে গড়ে ওঠা, সোনার খাঁচায় রাখা পাখি। বাবা একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। জীবনে অভাব কী, সেটা কল্পনাতেও আসেনি কখনো। কোনো কষ্ট ছুঁয়ে দেখেনি আমায়। এমনকি রাগ করে কেউ কখনো গায়ে হাত তোলার সাহসও করেনি। যদি অসুস্থ হতাম, বাবা নিজের অফিস বন্ধ করে পাশে বসে থাকতেন। জ্বর হলে মাথা ছুঁয়ে তার চোখ ভিজে যেত। আর এখন সেই আমি… বড্ড হাসি পাচ্ছে নিজের ভাগ্যের উপর। কী বিচিত্র জীবন! যে মেয়েকে পৃথিবীর সব সুখ দিতে চেয়েছিল বাবা-মা, সেই মেয়ে আজ স্বামীর হাতে মার খাচ্ছে।

শেষরাতে নিজেকে জড়ো করে বাবার বাড়ি চলে গেলাম। চোখ লাল, মুখ বিবর্ণ। আমাকে দেখে বাবা প্রথমে কিছু না বুঝলেও যখন কারণ বললাম, রেগেমেগে আগুন হয়ে উঠলেন।

‘কি! তোর গায়ে হাত তুলেছে? আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলেছে? ওই কুত্তার বাচ্চার একদিন কি আমার একদিন।’

বাবার চোখ রাগে ঝলসে যাচ্ছিল। হাত কাঁপছিল রাগে। মুখ দিয়ে গলগল করে বের হচ্ছিল ঝাঁঝালো গালাগাল। মা তখন কাছে এসে বাবাকে থামালেন, ‘চুপ করো তো। দু’জন মানুষ একসঙ্গে থাকলে একটু-আধটু কথা-কাটাকাটি, ঠোকাঠুকি হবেই। সব সংসারেই তো হয়।’

আমি স্তব্ধ হয়ে তাকালাম মায়ের মুখের দিকে। যে মা আদরে, যত্নে, লাজুক চোখে আমাকে মানুষ করেছেন, তিনি আজ এতটা নিরাসক্ত কণ্ঠে শারিরীক নির্যাতনকে স্বাভাবিক বলছেন?

বাবা বললেন, ‘সব ঘরে হওয়া আর আমার ঘরে হওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। আমি অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতে শিখিনি।’

মা একটু হাসলেন। বললেন, ‘রাগ হলে পুরুষ মানুষ একটু-আধটু হাত তো তোলে-ই। তুমি কি তোলেনি কখনো?’

বাবা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। আমি চোখ বড় করে তাকালাম বাবার দিকে। তারপর মাকে বললাম, ‘বাবা! বাবা তোমার গায়ে হাত তুলেছে?’

বাবা দাঁড়ালেন না, ধীর পায়ে চলে গেলেন বারান্দার দিকে।

মা বললেন, ‘তুলেছে। বিয়ের পর পর তো খুব রাগী ছিল। সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে গেছে। মেয়ে হয়ে জন্মালে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়।’

আমি তীব্র বিস্ময়ে কাঁপা কণ্ঠে বললাম,

‘তুমি সহ্য করেছো, মানে আমাকেও করতে হবে?’

‘এইটুকু কারণে সংসার ছেড়ে আসা যায় না। পুরুষ মানুষ সারাদিন বাইরে কাজ করে, কত চাপ, কত টেনশন নিয়ে বাড়ি ফেরে। ঘরে এসে যদি শান্তি না পায়, রাগ তো করবেই। কখনো কখনো না চাইলেও, হাত উঠে যা।’

‘আমি কি শান্তি দিইনি? ওর শান্তির জন্য তো সবই করতাম আমি।’

‘তুই হয়তো এমন কিছু বলেছিস, যেটা ওর ভালো লাগেনি। পুরুষ মানুষ সব পারে, কিন্তু নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।’

‘কথা ভালো না লাগলেই কেউ কাউকে মারবে? তাহলে তো আমিও রাগে অনেককে মেরে ফেলতে পারতাম!’

‘মেয়েদের আর ছেলেদের রাগ কি এক? মেয়েরা সবসময় ধৈর্যশীল, সহনশীল। এইটাই তো আমাদের শক্তি।’

‘এই সহনশীলতা দিয়ে কী করব আমি, মা? এই ধৈর্য দিয়ে কী হবে যদি সেটা শুধু মার খাওয়ার অনুমতি হয়ে দাঁড়ায়?’

মা ধীরে ধীরে বললেন, ‘বিয়ে মানেই কেবল ভালোবাসা না, মানিয়ে নেওয়ারও নাম। যতটা পারা যায় বোঝে চলতে হয়।’

আমি চিৎকার করে বললাম, ‘মানে আমি মার খাবো, আর তুমিই বলবে এটা মানিয়ে নেওয়া?’

মা একটু অস্বস্তিতে বললেন, ‘দেখ মা, তৈমুর ছেলে হিসেবে খারাপ না। ভালো পরিবারের ছেলে, চাকরি আছে, তোকে ভালোবাসেও। একটু রাগী হতে পারে, কিন্তু সেটা তো পুরুষ মানুষের স্বভাব।’

‘যে ভালোবাসে সে গায়ে হাত তোলে কীভাবে?’

‘রাগের মাথায় সব মানুষই কিছু না কিছু করে বসে। তুই নিজেও তো কখনো কখনো খুব রেগে যাস।’

‘আমি রাগ করলে কি তৈমুরকে মারি? গালাগাল করি?’

‘তুই তো আর পুরুষ মানুষ নোস। মেয়েদের রাগ আর ছেলেদের রাগ এক হয় না।’

‘কেন হয় না? আমিও তো মানুষ, আমারও তো রাগ আছে। কিন্তু আমি তো কাউকে মারি না!’

মা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তুই এতো বিশ্লেষণ করিস না। সংসার এমনই হয়।’

‘এমনই মানে? ধরো, তুমি যদি বাবাকে মারতে, তাহলে কি বাবাও বলতেন সংসার এমনই? মানিয়ে চলি?’

মা একটু রেগে গিয়ে বললেন, ‘আমি তোর বাবাকে মারবো কেন? কী বাজে কথা বলছিস!’

‘ঠিক! তুমি বাবাকে মারবে না, কারণ তুমি জানো এটা ভুল। তাহলে তৈমুর কেন আমাকে মারবে?’

মা চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘তুই এখনো ছোট, সংসারের খুঁটিনাটি বুঝিস না। তৈমুর তোর স্বামী, তোর সাথে একটু রাগারাগি করতেই পারে।’

‘একটু রাগারাগি আর মারপিট কি এক জিনিস?’

‘এত তর্ক করিস না। আমিও সংসার করেছি। যখন বিয়ে করেছি, তখন অনেক কিছু সহ্য করেছি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে গেছে। তোর বাবাও এখন আমার গায়ে হাত তোলে না।’

‘বাবা এখন তোমার গায়ে হাত তোলে না! কিন্তু আগে তুলতো! তোমার কী তখন কষ্ট হতো না? বুক ফেটে আসতো না?’

মা একটু অস্বস্তিতে বললেন, ‘ওসব পুরানো কথা তুলিস না এখন।’

‘কেন তুলবো না? এই পুরানো কথা থেকেই তো আমার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হচ্ছে। তুমি সহ্য করেছো বলে আমাকেও সহ্য করতে হবে?’

আমি চুপ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম উত্তরের আশায়। মনে হচ্ছিল, আমি বুঝি অন্য একটা গ্রহে চলে এসেছি। এখানে ভুলটা মেয়েদেরই, আর সহ্য করাটাই প্রেম, সংসার, আর নারীত্বের সেরা গুণ। আমার চোখে জল আসছিল, কিন্তু কাঁদছিলাম না। কারণ এবার কষ্টের সাথে সাথে ভেতরে একরাশ রাগ জমছিল। নিজের জন্য, মা’র জন্য, সমস্ত নারীর জন্য, যাদের শিখিয়ে দেয়া হয়, ‘পুরুষ মানুষ রেগে গেলে মারতেই পারে। সেটা মাফ করে দাও, সেটাই ভালোবাসা।’ আমি বুঝতে পারলাম, এই সমস্যা শুধু আমার নয়। এই সমস্যা আমার মায়ের, আমার মায়ের মায়ের, এবং এমন হাজার হাজার নারীর যারা মনে করে পুরুষের হিংস্রতা সহ্য করাই নারীত্বের পরিচয়।

কিন্তু আমি সহ্য করব না। নিজের আত্মসম্মান খোয়াব না৷ মায়ের মতো ‘সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে’- এই মিথ্যার ছায়ায় জীবন কাটাব না।

কিন্তু আমার আত্মসম্মানও ছিল কাগজের তৈরি দুর্গের মতোই। একটু বৃষ্টিতেই ভেসে যাওয়ার মতো ভঙ্গুর। তৈমুর যখন আমার বাবার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল, সরি বলল, আমার সংকল্প বরফের মতো গলে গেল। না চাইতেও নিজের অজান্তে সেই তথাকথিত আদর্শ স্ত্রী হয়ে উঠলাম। যাকে যতবার ভাঙা হোক, সে ঠিক জোড়া লাগিয়ে ফিরে যায়।

তারপর থেকে যতবারই সংসারে ঝড় উঠত, আমি ভাঙা মন নিয়ে বাবার বাড়ি যেতাম। এক বুক যন্ত্রণায়, অপমানের ভারে নুয়ে পড়া আমি যখন মায়ের সামনে দাঁড়াতাম, তিনি সেই একই পুরনো উপদেশের বাক্স খুলে বসতেন।

-‘মেয়েরা সংসার করে, ভাঙে না।,

-‘একটু সহ্য করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।,

-তোর বাবাও তো রাগ করত, আমি সহ্য করেছি।’

প্রতিটি বাক্য আমাকে আরো একবার ভেঙে দিত। মনে হতো, আমি ভিক্টিম হয়েও অপরাধী বনে গেছি। মায়ের চোখে আমি একজন ব্যর্থ নারী, যে সংসার রক্ষা করতে পারেনি। তার প্রতিটি বাক্য আমার বুকে এসে বিঁধত, ঠিক তৈমুরের আরেকটি থাপ্পড়ের মতো।

এই অসহায়, বোবা লড়াইয়ের মাঝেই একদিন আমার জীবনের একমাত্র আশ্রয়, আমার বাবা স্ট্রোক করে চিরতরে চলে গেলেন। হাসপাতালের বারান্দায় দৌড়াতে দৌড়াতে, ডাক্তারদের কাছে অনুরোধ করতে করতে হারিয়ে ফেললাম আমার একমাত্র সত্যিকারের রক্ষাকর্তাকে। যিনি কখনো আমাকে দোষ দেননি, যিনি আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তার চলে যাওয়ার পর আমার পুরো দুনিয়া টলে উঠল। বুকের ভেতরে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হলো। সব আশা, সব ভরসা একসাথে ধ্বসে পড়ল। তৈমুর সেই সময়টাতে অদ্ভুত রকমের শান্ত ছিল। দেড় মাসের মতো কোনো ঝগড়া হলো না। এর কারণ ছিল আমার নিরবতা, আমার শোক। এমন না যে ও বদলে গিয়েছিল বা আমার দুঃখ বুঝেছিল।

ঠিক দেড় মাস পর, একদিন, মানুষের কোলাহলে ভরা এক রাস্তায় ও হঠাৎ করে আমার গালে আবারও সজোরে থাপ্পড় মারল। কী কারণে, কী অপরাধে ঠিক মনে নেই। শুধু মনে আছে চারপাশের মানুষদের অবাক, কৌতূহলী, অবজ্ঞাময় দৃষ্টি। কারও মুখে মৃদু হাসি, কারও চোখে বিরক্তি। কেউ এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল না, ‘কী হয়েছে এখানে?’

আমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। সেখানেই, জনসমক্ষে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। অঝোর কান্নায় বুক ভাসিয়ে দিলাম। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। শুধু সেখান থেকে না…মা, তৈমুর, এই শহর, এই সংসার, এই অপমান সবকিছু ছেড়ে পালিয়ে গেলাম। চিরতরে। ব্যাংক থেকে তুলে নিলাম আমার নামে থাকা সব টাকা। সেই টাকা নিয়েই পাড়ি জমালাম ভারতে।

একটা অচেনা, মেঘলা শহরে শুরু করলাম নতুন জীবন। না, সেটাও খুব রঙিন ছিল না। প্রথম দিকে একটা ছোট্ট রুমে একা একা অনেক কেঁদেছি। হতাশা, অপরাধবোধ, একাকীত্ব সব মিলিয়ে অনেক কষ্টের দিন কেটেছে। কিন্তু স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, সেই জীবনে ছিল না থাপ্পড়, গালি, অভিযোগ কিংবা বোঝানোর নামে অপমান।

নতুন শহরের প্রতিটি দিন কাটত তৈমুরকে ভোলার চেষ্টা করতে করতে। কিন্তু মানুষের মন বোধহয় এমনই যে, যাকে ভুলতে চাই, সেই আরও বেশি করে মনে পড়ে। সারাক্ষণ মনে পড়ত ভালোবাসার দিনগুলো, কপালে ওর চুমু, পিঠে হাত বুলিয়ে বলা, ‘তুমি আমার পৃথিবী।’ সন্ধ্যায় একা একা বসে থাকতে থাকতে ইচ্ছে করত, সব ভুলে ফিরে যাই। ক্ষমা করে দেই। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরি। মনে হতো, হয়তো এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো ও বদলে গেছে। হয়তো আমি অতিরিক্ত সেনসিটিভ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরেই মনে পড়ে যেত সেই রাস্তার থাপ্পড়, সবার সামনে অপমান আর গালিগালাজ; নিজেকে শক্ত করে আটকে রাখতাম।

সমস্ত যোগাযোগের পথ বন্ধ করে দিয়েছিলাম, মুহূর্তের দুর্বলতাও যাতে আমাকে আরেকটা ভুলে না নিয়ে যায়। বাংলাদেশ নামটাই হয়ে উঠেছিল আমার কাছে ব্যথার আরেক নাম। ওই দেশের কোনো খবর, কোনো মুখ, কোনো স্মৃতি আর ফিরত না আমার কাছে। আমি শুধু জানতাম, সেখানে আমার একটি অতীত রয়ে গেছে। একটা দগদগে ক্ষত, যার সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই।

আর এখন, আমি সেই অতীতকে পেছনে ফেলে, খুব ধীরে ধীরে, নিজের মতো করে একটা নতুন আমি গড়ার চেষ্টা করছি। যে আর কাউকে ভালোবাসার নামে সহ্য করবে না। যে আর চড়-গালি-পশুতা মেনে নেবে না ভালোবাসা বা সংসার টিকিয়ে রাখার অজুহাতে।

কিন্তু আমি জানতাম না, ফেলে আসা গল্পটা তখনও এক অজানা মোড়ে অপেক্ষা করছিল তীব্র আকুলতায়।

  • ইলমা বেহরোজ
  • Related Posts

    বিরহ বীণার সুর [পর্ব-০৩]

    বাবার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সাহস হয় না। জানি, মায়ের সামনে দাঁড়ালে প্রশ্নের পাহাড় নিয়ে বসবে, -‘কোথায় ছিলি তুই?’ -‘এভাবে কেউ বাড়ি ছেড়ে যায়?’ -‘সংসারে তো ঠোকাঠুকি হয়ই, তাই বলে চলে…

    সেদিন ও সে [পর্ব-০৪]

    নিজের বক্তব্য টুকু শেষ করে সৌজন্যের দিকে তাকাল সৌজন্যের খালা। সৌজন্য লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে আছে। খালার কথা শুনে কিছু বলার আগেই সৌজন্যের গালে একটা শক্ত চড় পড়ে। অবাক…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You Missed

    বিরহ বীণার সুর [পর্ব-০৩]

    বিরহ বীণার সুর [পর্ব-০৩]

    সেদিন ও সে [পর্ব-০৪]

    সেদিন ও সে [পর্ব-০৪]

    বিরহ বীণার সুর [পর্ব-০২]

    বিরহ বীণার সুর [পর্ব-০২]

     প্রাণদায়িনী [পর্ব-০২]

     প্রাণদায়িনী [পর্ব-০২]

    বিরহ বীণার সুর [পর্ব-০১]

    বিরহ বীণার সুর [পর্ব-০১]

    প্রাণদায়িনী [পর্ব-০১]

    প্রাণদায়িনী [পর্ব-০১]