নবোঢ়া [পর্ব ৫০ শেষ অংশ]

শব্দর দ্বিতীয় তলার বারান্দা অতিক্রম করে ঘরে ঢুকে দেখে, আয়নার সামনে বসে জুলফা তার চুলের খোঁপায় রূপার কাঁটা গাঁথছে। ঘরের পরিবেশ ভারী হয়ে আছে চুলের সুরভি আর আতরের সুবাসে। নিজ প্রতিচ্ছবিতে মগ্ন জুলফা শব্দরের আগমন টের পেতে অনিচ্ছুক, নাকি অবগত হয়েও এড়িয়ে যাচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে না। শব্দর এগিয়ে এসে বলে, ‘যাত্রাপালার সকলে কি তোমাকে কেবল জেসমিন পরিচয়েই জানত?’

জুলফার হাত স্থির হয়ে যায়, খোঁপা খুলে চুল হাতে ঝুলে পড়ে। আয়নায় অনড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দেয়, ‘দর্শকের কাছে জেসমিন হিসেবে পরিচত থাকলেও, আমার সঙ্গে যারা কাজ করত সকলেই আসল নাম-পরিচয় জানত। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? কিছু হয়েছে?’

শব্দর ঠোঁট চেপে মুহূর্তকাল ভেবে নিয়ে শুধায়, ‘আগামীকাল বিকেল থেকে বাড়িতে মেহমানদের ভিড় জমবে। কালীগঞ্জ থেকে অনেক অতিথি আসবে। কেউ যদি তোমাকে চিনে ফেলে, যদি বলে বসে তুমি যাত্রাদলের নাচিয়ে জেসমিন, ভাইজান কিছুতেই মেনে নেবেন না। বেদেকন্যা পরিচয়ে হয়তো সহনশীল থাকতেন, কিন্তু যাত্রার মেয়ে,’ শব্দর বিরতি নিয়ে পুনরায় বলে, ‘সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’

‘জানাজানি হলে আপনার ইজ্জত চলে যাবে?’

‘যদি সম্মানের কথা ভাবতাম, তোমাকে বিয়েই করতাম না। তুমি কে, কোন্‌ পরিবেশ থেকে এসেছ -সবকিছু সম্পর্কে জেনেই তোমাকে ঘরে এনেছি, রানি করেছি।  কিন্তু ভাইজান জানতে পারলে… তোমার মুখ দেখা দূরে থাক, আমার দিকেও তাকাবেন না। বিয়ের রাতে তো সব বলেছিলাম, মনে নেই?’

জুলফা নিরুত্তর।

শব্দর বলে, ‘এক কাজ করো। আগামীকাল গুলনূরের সঙ্গে বাংলোবাড়িতে চলে যাও। সবাইকে বলব, গুলনূরের আপন বলতে কেউ নেই সেজন্য তুমি কনেপক্ষ নিয়েছ। বিয়ের দিন ফিরে এসে অসুস্থতার বাহানায় কিছুক্ষণ আড়ালে থেকো।’

জুলফা উঠে দাঁড়ায়। আয়নার সামনে রানির ভঙ্গিমায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অনড়ভাবে জানায়, ‘আমি জমিদারবাড়ির বউ হয়ে চোরের মতো লুকিয়ে থাকব না। আমাকে লুকিয়ে রাখতে হলে এই বিয়ের অর্থই বা কী? আমার মর্যাদা, আমার অধিকার সব কোথায়?’

শব্দর অনুনয়ের সুরে বলে, ‘জুলফা, ভাইজানের কথা একটু ভাবো। সামান্য এই সহযোগিতাটুকু করো। বিনিময়ে যা চাইবে, তাই পাবে।’

‘আমার চাওয়ার কিছু নেই। শুধু মর্যাদার সাথে নিজের পরিচয়টুকু চাই।’ পায়ের নিচে নরম গালিচায় মৃদু শব্দ তুলে ঘর পেরিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায় জুলফা। মনে মনে ভাবে, শব্দরের স্ত্রীর পরিচয় তার কখনোই দরকার ছিল না। কিন্তু তার অতীত লুকানোর জন্য শব্দরের এই লজ্জা, এই ভীতি সেটাও সে কিছুতেই মানবে না। তার অহংবোধ মানতে দিবে না।

শব্দর তার পেছনে ধাওয়া করে, তখন বারান্দার মুখে এসে উপস্থিত হয় মনির। মাথা নত করে সালাম জানিয়ে বলে, ‘হুজুর, বড় হুজুর আপনাদের দুজনকে ডেকেছেন।’

‘খানিক পরেই আসছি।’

‘এখনই যেতে বলেছেন, হুজুর।’

শব্দরের কণ্ঠ শুষ্ক হয়ে আসে। বুকের ভেতরে একটা আশঙ্কা ধুকপুক করে ওঠে। ‘ভাইজান কি জুলফার পরিচয় জেনে গেছেন? বাড়িতে এমন কেউ এসেছে যে জুলফার সঙ্গে পূর্ব পরিচিত?’ উৎকণ্ঠায় মুখ বিবর্ণ হয়ে যায় তার। সে জুলফার দিকে তাকায়। জুলফা ততক্ষণে বারান্দা অতিক্রম করে বৈঠকখানার দিকে যাচ্ছে। সেও দ্রুত জুলফাকে অনুসরণ করে নিচ তলায় নেমে আসে। সেখানে পৌঁছে দেখে নয়নাভিরাম এক দৃশ্য! বৈঠকখানা যেন রূপকথার রাজপ্রাসাদে রূপান্তরিত হয়েছে। এক প্রান্তে বিছিয়ে রাখা হয়েছে রঙবেরঙের, নকশিকাঁথার মতো কারুকার্যময় অসংখ্য শাড়ি আর জামদানির মেলা। শহরের সবচেয়ে নামকরা তাঁতিকে হাজির করেছেন সুফিয়ান। বৈঠকখানার আসনে আজ প্রথমবারের মতো বসেছে গুলনূর। পর্দার আড়ালে থাকা দাসী আজ মুখ আধা-ঢাকা ঘোমটায় জাওয়াদের পাশে বসে আছে পূর্ণাঙ্গ গৃহিণীর ভূমিকায়। তাদের থেকে কিছুটা ব্যবধানে সুফিয়ানের পাশে বসেছে নাভেদ।

তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে সুফিয়ান মুখ তুলে বলেন, ‘এসো জুলফা। দেখো, যেটি ভালো লাগে সেটিই নাও।’

জুলফা একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে এগিয়ে আসে। ঘরভর্তি মানুষজন, অপরিচিত চোখের পলক। সে কিছুটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে একটা ঝকঝকে লাল জামদানির দিকে হাত বাড়ায়। দৃষ্টি গিয়ে পড়ে নাভেদের উপর। নাভেদ মৃদু মাথা নেড়ে ইশারা করে, এটা নয়। জুলফা সঙ্গে সঙ্গে হাত গুটিয়ে নেয়। এরপর আরেকটা নীলাভ রঙের শাড়ির দিকে হাত বাড়ায়, এবারও নাভেদ চোখের কোণে মানা করে। তৃতীয়বার একটা অপূর্ব খয়েরি-সোনালি মেশানো আভার জামদানিতে স্পর্শ করে। নাভেদ এবার মৃদু সম্মতি জানায়। জুলফা ঠোঁটে একটুখানি হাসি ফুটিয়ে বলে, ‘এইটাই নেব। রঙটা চমৎকার।’

শব্দর একটা সূক্ষ্ম জরির কাজ করা কমলা রঙের শাড়ি তুলে ধরে উৎসাহের সঙ্গে বলে, ‘এটাও নাও। তোমাকে ভীষণ মানবে।’

জুলফা তৎক্ষণাৎ বলে, ‘না, না। দুটো লাগবে না। আমার একটাই যথেষ্ট। আমি যেটা পছন্দ করেছি সেটিই নেব।’

মুহূর্তের মধ্যে বৈঠকখানায় বিস্ময়কর নিস্তব্ধতা নেমে আসে। স্বামী পছন্দ করে দিচ্ছে অথচ সেটি নিবে না! এ কেমন স্ত্রী! শব্দর সকলের সামনে কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সে নিজেই কণ্ঠস্বর কোমল করে বলে, ‘ঠিক বলেছ। তুমি যেটি পছন্দ করেছ সেটিই সর্বাধিক সুন্দর। সেটিই নাও।’

একে একে সকলে মনোমতো শাড়ি নির্বাচন করে। রাইহা শব্দরের পছন্দের শাড়িটি নিজের জন্য পছন্দ করে। শব্দর স্নেহমিশ্রিত হাসি দেয় তার দিকে তাকিয়ে। শেষে সুফিয়ান মেরুদণ্ড সোজা করে সামান্য হেলান দিয়ে বসে বলেন, ‘নাভেদ, এবার তুমি তোমার স্ত্রীর জন্য একটি পছন্দ করো। কত করে বলেছি বউমাকে নিয়ে আসতে, আনলে না কেন?’

জুলফা বিদ্যুৎ-কাটা খেয়ে তাকায় নাভেদের দিকে। তার চোখে বিস্ময়। যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে মাথার উপর। চোখাচোখি হয় দুজনের। সেই দৃষ্টিসংঘর্ষে যেন সময়ও থমকে যায়। নাভেদ ক্ষণিকের জন্য টলমল করে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। সকলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কণ্ঠে ভারসাম্য ফিরে আসতে একটু সময় লাগে, তারপর গলা মোলায়েম করে বলে, ‘ওর সামনে পরীক্ষা, চাচাজান।  কী করে বলি, আনন্দ-উৎসবে এসো? সময়টা একদম মানানসই নয়।’

ঘরের ভেতরে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। রাইহা, ললিতাসহ সকল দাস-দাসীরা চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে। কেউই জানত না নাভেদের স্ত্রী আছে। বৈঠকখানা রীতিমতো কানাকানির আড্ডাখানায় রূপ নেয়।

-‘নাভেদ বাবু বিবাহিত?’

-‘কবে থেকে? কার সাথে?’

-‘এতদিন কেন গোপন রেখেছেন? কাউকে বলেননি কেন? নিশ্চয় ঘাপলা আছে।’

এইসব হল্লার ভিড় কানে পৌঁছায় না জুলফার। তার বুকের ভেতর কী যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটি ডুবে যাচ্ছে অভিমানের গভীর কালো জলে। মুখজুড়ে বিশ্বাসভঙ্গের তিক্ত ছাপ। মনের ভেতর কেউ যেন চিৎকার করে বলছে, ‘তুই বোকা! তুই প্রতারিত!’

বৈঠকখানা ভাঙতেই জুলফার ভেতরটা ছাইচাপা আগুনের মতো দপদপ করে জ্বলে ওঠে। হৃদয়ের গভীরতম প্রকোষ্ঠে নিভু নিভু আগুনের শিখা হঠাৎ করে প্রবল দাবানলে রূপ নেয়। বিস্ময় আর উৎকণ্ঠায় বুকের মধ্যে বিষের থেকেও তীব্র যন্ত্রণাদায়ক স্পন্দন অনুভূত হয় – যেন কোনো অদৃশ্য খঞ্জর দিয়ে বারবার আঘাত করা হচ্ছে। নাভেদ দুই দিনের জন্য পুরো ব্যবসায়িক দায়িত্বের সম্পূর্ণ বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। তাকে এখন আড়তে বসে থাকতে হবে… শোলা কাঠের মতো শুষ্ক, নিরস হিসাবের খাতাগুলোতে মুখ গুঁজে কাজ করতে হবে। তাই বৈঠক শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সে ঝড়ের বেগে আড়তের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে। জুলফা মরিয়া হয়ে সুরঙ্গপথের মাধ্যমে বের হয়ে নাভেদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। কিন্তু দাসীদের সদা-চঞ্চল পায়ের শব্দ, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা বাসনের কংকন আর অতিথিদের গোলমাল কোলাহলে পুরো পরিবেশ মুখোরিত হয়ে আছে। এই পরিস্থিতিতে সুরঙ্গপথ ব্যবহার করা তো দূরের কথা, এমনকি বারান্দার প্রান্তে অকারণে গিয়ে দাঁড়ানোও সম্ভব হচ্ছে না। চরম অসহায়ত্বে জুলফার চোখে জল এসে যায়। সেই জল ধীরে ধীরে তার কোমল গাল বেয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ে। যতবার চোখ ভিজে যায় ততবার আঁচল তুলে সেই জল মুছে ফেলে, যাতে কেউ টের না পায়। দূর থেকে ললিতা জুলফার চোখ-মুখের অস্বাভাবিক লালচে আভা এবং বারবার গভীর নিশ্বাস নেওয়ার দৃশ্য লক্ষ্য করেন। চোখাচোখি হতেই জুলফা তার ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর হঠাৎ মনে উজ্জ্বল আলোর ঝলকানির মতো ভেসে ওঠে একটা সমাধান। সে তৎক্ষণাৎ শঙ্খিনীর মাধ্যমে শব্দরকে ডেকে পাঠায়। শব্দর ঘরে পৌঁছাতেই জুলফা অত্যন্ত নম্র ও সংযত ভঙ্গিতে বলে, ‘আমি চিন্তা-ভাবনা করেছি। আপনার কথা মেনে চলা আমার কর্তব্য। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি গুলনূরের সঙ্গে বাংলো বাড়িতে যাব।’

গতকাল থেকে দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে থাকা শব্দরের চোখ দুটি বিস্ময়ে প্রশস্ত হয়ে যায়। প্রায় এক মিনিট পর্যন্ত সে অবাক দৃষ্টিতে জুলফার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আবেগের প্রবল স্রোতে ভেসে গিয়ে সে জুলফার ঠোঁটে গভীর, আবেগপূর্ণ… আরক্ত চুমু অঙ্কিত করে দেয়। মুখে আনন্দের উজ্জ্বলতা নিয়ে সুফিয়ানের কাছে গিয়ে বলে, ‘গুলনূর আমাদের বাড়ির পুত্রবধূ হতে যাচ্ছে, তার মর্যাদা ও সম্মানের যথোচিত খেয়াল রাখার জন্য বাড়ির একজন কর্তীর সঙ্গে থাকা উচিত ভাইজান। অন্যথায় সমাজের মানুষ বলবে যে, সম্ভবত আমরা অন্তর থেকে এই বিয়েতে সন্তুষ্ট নই, তাই ভবিষ্যৎ বধূকে একা ছেড়ে দিয়েছি।’

সুফিয়ান ধীরস্থিরভাবে গভীর চিন্তা-ভাবনার সাথে সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বলেন, ‘ভুল বলোনি! ললিতা পাত্রের মা, সে যেতে পারবে না। তুমি বরং জুলফাকে বলো সে যেন এখনই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়।’

পরদিন বিকেল গড়িয়ে যেতেই আকাশে সূর্যের শেষ রশ্মিগুলো প্রিয়তমার ঠোঁটের মতো কোমল চুমুর আদলে বিদায়ী সম্ভাষণ জানায়। গুলনূরের জমকালো, সুশোভিত ঘোড়ার গাড়িটি রাস্তায় এগিয়ে চলে। ঠিক তার পিছু পিছু, ছায়ার মতো আঁকড়ে থাকা আরেকটি গাড়ি – হলুদ ফুলের মালায় সাজানো, যার কাঠের পাটাতনে বসে থাকা জুলফা তার অস্থির, অদূরদর্শী দৃষ্টি দিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে আছে। বাংলো বাড়ির প্রশস্ত প্রাঙ্গণে গাড়ি এসে থামতেই সে নিঃশব্দে, ভূতের মতো নেমে পড়ে। একবার চোখ বুলিয়ে নেয় চারপাশের পরিবেশ। প্রতিটি কোণ, প্রতিটি গাছের ছায়া, প্রতিটি জানালার অবস্থান সবকিছু মনে গেঁথে নেয়। রাত নামার সাথে সাথেই পেছনের দরজা দিয়ে চুপিসারে বেরিয়ে যায়। বোরকার ঘন কালো কাপড়ে নিজেকে সম্পূর্ণ জড়িয়ে নিয়ে, নিকাব টেনে মুখ আড়াল করে সোজা চলে যায় আড়তের দিকে।

রাত তখন বেশ গভীর হয়ে গেছে। আড়তের চারপাশ নিস্তব্ধতায় ডুবে গেলেও প্রধান দরজার কাছটায় কেরোসিন বাতির ফিকে, মিটমিটে আলোয় অস্পষ্ট ছায়া নড়াচড়া করছে। এমন সময় একজন লুঙ্গি পরিহিত কর্মচারী হঠাৎ করে একটি মহিলার অবয়ব দেখে হতবাক হয়ে থমকে দাঁড়ায়। তার চোখ সন্দেহে কুঁচকে যায়, জিজ্ঞেস করে, ‘কে আপনি? এখানে কী চান?’

জুলফার চোখ তখন উন্মাদের মতো হন্তদন্ত হয়ে চারপাশ খুঁজে বেড়াচ্ছে নাভেদকে। তার দৃষ্টি অস্থির, উৎকণ্ঠিত।

কর্মচারীটি একটু এগিয়ে এসে কণ্ঠস্বর চড়িয়ে আরো কঠোরভাবে জিজ্ঞেস করে, ‘কাকে খুঁজছেন বলুন তো?’

জুলফা কাঁপা কাঁপা, নিচু স্বরে উত্তর দেয়, ‘নাভেদ সাহেব… তিনি আছেন?’

পাশের ছোট্ট ঘরটায় নাভেদ তখন হিসাবের বিভিন্ন খাতা উল্টে-পাল্টে দেখছে। হঠাৎ দরজার ওপাশে পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে তার সমস্ত শরীর সতর্ক হয়ে ওঠে। সে গা টান করে উঠে দাঁড়ায়। পর্দার ফাঁক দিয়ে চোখ রাখতেই তার দৃষ্টি পড়ে চিরচেনা অবয়বের উপর। তৎক্ষণাৎ সে সেলিমকে পাঠিয়ে দেয়। সেলিম এগিয়ে এসে কর্মচারীকে বলে, ‘আপনি যান, আমি দেখছি বিষয়টা।’

কর্মচারী কৌতূহলী ও সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে দুজনকে একবার দেখে, পেছনে তাকিয়ে ধীর পায়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরে যায়। সেলিম কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘ভাইজান বলেছেন, আমার সাথে যেতে। উনি কিছুক্ষণ পরেই আসবেন। এই জায়গা আপনার জন্য মোটেও নিরাপদ না।’

কোনো প্রশ্ন না করে, কোনো দ্বিধা-সংকোচ না দেখিয়ে জুলফা নিঃশব্দে সেলিমের পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। দুজনে পাশাপাশি, সম্পূর্ণ কথাবার্তাহীন দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়। কাঁচা, উঁচু-নিচু রাস্তা পেরিয়ে, গাছপালার ঘন পাতার ফাঁকে আলো-ছায়ার খেলা মাড়িয়ে প্রায় ত্রিশ মিনিট অবিরাম হাঁটার পর তারা এসে দাঁড়ায় একটি নিভৃত ঝুপড়ি কুটিরের সামনে। কুটিরের দুপাশে দুটি সুউচ্চ তালগাছ পাহারাদারের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ডান পাশে বিস্তৃত মৌসুমি সবজির ক্ষেত রয়েছে, যেখানে সেচের জন্য কাটা নালায় পানি টুপটাপ শব্দে বয়ে চলেছে অবিরাম। আকাশে অসংখ্য তারা টিমটিম করে জ্বলছে, বাতাসে জোনাকিরা উড়ে বেড়াচ্ছে আলোর নৃত্য নিয়ে। শুধু জুলফার হৃদয়ে কোনো আলো নেই। সমস্ত পৃথিবী তার কাছে শূন্য, নিরর্থক লাগছে। এক ভয়ানক শূন্যতায় সে নিঃশব্দে পুড়ে যাচ্ছে। জুলফা নিরাসক্ত গলায় বলে, ‘উনি কখন আসবেন?’

সেলিম মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে বিনীতভাবে বলে, ‘ আপনি ভেতরে গিয়ে বসুন, বেগম সাহেবা। ভাইজান এক্ষুনি এসে যাবেন।’

জুলফা ঠোঁট কামড়ে নিঃশ্বাস টেনে কুটিরের ভেতর ঢুকে ভারাক্রান্ত পায়ে। দেওয়ালের বাঁশের আলমারিতে বোরকা আর নিকাবের কৃষ্ণবস্ত্র ঝুলিয়ে রাখে। চারপাশে বেতের আসবাবপত্র। চেয়ারে ধুলোর মখমলি আস্তরণ, ছোট্ট খাটিয়ায় পাতলা তোশকের কোমল বিছানা। দীর্ঘ মুহূর্ত কেটে যায় মনের অতলান্ত গহ্বরে ডুবে থেকে। হঠাৎ দূরাগত দিগন্ত থেকে ভেসে আসে ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি। জুলফার হৃদয়পিঞ্জর থরথর করে কেঁপে ওঠে। ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে গিয়ে দরজার সামনে স্থিরচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে।

আকাশজুড়ে তখন জোনাকির মিছিল আর দূর দিগন্তে নক্ষত্রদের ঝিকমিক মেলা। এমন রাতের বুকে দুর্বার বাতাসের গর্জনের সাথে এসে পৌঁছায় ঘোড়ার খুরের টুংটাং শব্দ। ঘোড়ার পিঠে বসে আছে নাভেদ। দৃশ্যটি চোখে পড়তেই জুলফার অন্তর টালমাটাল হয়ে যায়। চোখের কোণে জমে ওঠে অশ্রুকণা, বুকের ভেতর শুরু হয় বজ্রপাতের গর্জন। সে ছুটে যায়; নাভেদ ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে মাটিতে নামে। দুই হাতে তুলে জুলফার গালের অশ্রুধারা মুছে দিয়ে বলে, ‘কী হয়েছে আপনার? এমন ব্যাকুলতার কারণ কী?’

দাঁতে কান্না চেপে নাভেদের বুকের পোশাক মুষ্টিবদ্ধ করে আঁকড়ে ধরে, প্রচণ্ড ক্রোধে জুলফা বলে, ‘আপনি সত্যিই জানেন না? জানেন না এই হাহাকারের মূল কারণ?’

নাভেদ জুলফার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘শান্ত হোন…শান্ত হোন।’

‘শান্ত? আমি শান্ত হব?’ জুলফা দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে, আপনি বিবাহিত, এই সত্য কেন গোপন রাখলেন আমার কাছে? কেন প্রকাশ করলেন না এই সত্য?’

‘বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেই কি প্রেমের সত্যতা অসত্যে রূপান্তরিত হয়?’ প্রশ্ন করে নাভেদ। দুই হাত তুলে জুলফার অশ্রুমাখা মুখ স্পর্শ করতে উদ্যত হয়। কিন্তু জুলফা বিদ্যুৎগতিতে দূরে সরে দাঁড়ায়, ‘হ্যাঁ, হয়! আপনি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আপনার ঘরে স্ত্রী আছে, তাহলে আমার অবস্থান কোথায় এই সম্পর্কে? আমি কী আপনার কাছে?’ জুলফা শিশুর মতো ফোঁপাতে থাকে।

নাভেদ শান্ত কণ্ঠস্বরে উত্তর দেয়, ‘আপনিও তো পরের ঘরের স্ত্রী। তবুও আপনাকে ভালোবেসেছি।’

বাক্যের তীব্র আঘাতে জুলফা ক্ষণিকের জন্য স্থবির হয়ে পড়ে। সত্যিই তো! সেও তো বিবাহিতা নারী। কিন্তু সে কিছুই গোপন রাখেনি। অথচ নাভেদ সত্য লুকিয়ে রেখেছে। আবার এভাবে তীক্ষ্ণ প্রশ্নের সম্মুখীনও করছে! অভিমানের দাবানলে তার হৃদয় দগ্ধ হয়ে ওঠে। সে কুটিরের ভেতরে দৌড়ে চলে যায়। বোরকা-নিকাব পরতে উদ্যত হতেই পেছন থেকে নাভেদ এসে তাকে জড়িয়ে ধরে।

‘ছাড়ুন…’জুলফার গলায় ফুঁসতে থাকা নোনা ব্যথার আর্তনাদ, ‘দূরে থাকুন।’

নাভেদের বাহু ইস্পাতের শিকলের মতো শক্ত হয়ে জড়িয়ে ধরে। বৃষ্টিফোঁটার মতো নীরব চুম্বনের স্রোত নিয়ে আসে জুলফার কাঁধে। জুলফা ছটফট করে নাভেদের বাহুবন্ধন থেকে মুক্তির খোঁজে, অথচ অন্তরে অন্তরে দপদপ করে ওঠে অবদমিত আকুলতার ঢেউ। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে নাভেদ বলে, ‘আপনি ছাড়া আমার এই ভূমণ্ডলে আর কেউই নেই। আপনি আমার সিংহাসনের একমাত্র সম্রাজ্ঞী। আপনি আমার, আর আমি কেবলমাত্র আপনার।’

হারিকেনের কম্পিত শিখায় জুলফার চোখে অশ্রুরাশির আলো চিকচিক করে। সে অর্ধ-সংশয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘মিথ্যা… তাহলে বৈঠকখানায় যে কথা…’

কথা সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই নাভেদ বাধা দিয়ে বলে, ‘সেদিন ঝড়ের সন্ধ্যায় স্কুলের বারান্দায় আমাদের একসাথে দেখার পর চাচাজান জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মেয়েটি কে! আমি আপনাকেই আমার গৃহিণী বলে পরিচয় দিয়েছি, কেবল ভিন্ন নাম আর ভিন্ন পরিচয়ে।’

‘বিশ্বাস করি না।’

‘কসম এই পৃথিবীর, কসম আপনার…এক বিন্দুও মিথ্যে বলছি না।’

শব্দগুলো জুলফার হৃদয়গহ্বরে অমৃতের মতো প্রবেশ করে; শেষ সন্দেহের কুঞ্চিত ভাঁজ মুছে যায়। সে নীরবে ফুঁপিয়ে ওঠে, আঁচলে মুখ ঢেকে আর্তকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে, ‘সত্যি বলছেন আপনি…?’

নাভেদ তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে, ‘দেখুন, এই চোখজোড়ায় কি মিথ্যার কুয়াশা আছে? কী দেখতে পাচ্ছেন? নির্মল আকাশের মতো স্বচ্ছ নয় কি?’

এতটুকু আশ্বাসেই জুলফার বুকের ভেতর জমে-থাকা হাহাকার বাঁধ ভেঙে সমুদ্রের জোয়ারের মতো উপচে পড়ে। নাভেদ নত হয়ে তার গালের অশ্রুধারা ঠোঁটের উষ্ণতায় শুষে নেয়। মুহূর্তেই জুলফার দেহে বিদ্যুতের ঝলক দৌড়ায়। বিচ্ছেদের দহন মানুষের হৃদয়কে দুর্বল করে, ভালোবাসার ক্ষুধা বাড়িয়ে তোলে। সে খিদে সংযমকে ঝাপসা করে দেয়, বাস্তবতার সব সীমারেখা ফিকে হয়ে যায়। জুলফাও সেই আকর্ষণের নাইলনের সুতোর টানে ধরা পড়ে। নাভেদ সেই রাতে জুলফার হৃদয়ের উপর যে কৌশলের জাল বিস্তার করেছিল তার চূড়ান্ত পরিণতি দেয়। শরীরের সবটুকু তাপ, সবটুকু উচ্ছ্বাস ঢেলে দিয়ে তারা নিষিদ্ধ উপাখ্যানকে পূর্ণতায় অভিষিক্ত করে৷

বিয়ের দিন। সূর্য এখনও ঘুমের কোলে, অথচ জমিদারবাড়ির প্রতিটি মানুষ জেগে উঠেছে অনেক আগেই। রাত থেকেই অনেকে ঘুমহীন। আকাশ আলোর আভায় রাঙিয়ে ওঠার আগেই উঠানে পড়েছে পায়ের শব্দ, হাঁকডাক। কেউ মালাই সন্দেশে রুপালি কাজু বসাচ্ছে নিপুণ হাতে, কেউ ঘিয়ের সুবাসে ভেজাচ্ছে চাল, পোলাওয়ের হাঁড়ি বসানো হচ্ছে একের পর এক লম্বা বাঁশের চুল্লিতে। রান্নাঘরের আগুন আজকের জন্য অম্লান শিখা…নেভবার সম্ভাবনা নেই। সকালের আলো ছড়ানোর সাথে সাথে প্রবেশ করতে থাকেন একে একে অভিজাত আমন্ত্রিতরা। প্রত্যেকের কণ্ঠে একই সুর, একই বিস্ময়, ‘ভূঁইয়া পরিবার দাসীকে ঘরের বউ বানাচ্ছে! কী বিশাল হৃদয়! কী মহত্ত্ব!’

আলোকরশ্মির মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে গুলনূরের ভাগ্য পরিবর্তনের কাহিনী, আর ভূঁইয়া পরিবারের প্রশংসাবাণী। এই প্রশংসায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে আছেন সুফিয়ান। হৃদয়ে সঞ্চিত ক্রোধ, মনোকষ্ট, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সবকিছু মুছে গেছে। যে বিয়েকে তিনি অপমানের কারণ মনে করেছিলেন, সেটাই পরিণত হয়েছে গৌরব ও আনন্দের উৎসে। দীর্ঘকাল পর তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসে জাওয়াদকে ‘তুই’ সম্বোধনে বলেন, ‘তাড়াতাড়ি তৈরি হ, দুপুরের মধ্যে বউমাকে এখানে চাই।’

মানুষটার আনন্দ দেখে জাওয়াদের বুকে আনন্দের স্রোত বইতে শুরু করে। ঘরে বসে থাকা বাল্যবন্ধু শুভঙ্কর হাসতে হাসতে বলে, ‘তাহলে পড়েই গেছিস প্রেমে! কাঠালের আঠার মতো আটকে গেছিস!’

জাওয়াদ মুচকি হেসে গায়ে শেরওয়ানি জড়াতে জড়াতে বলে, ‘প্রেম বললে সঠিক ব্যাখ্যা হয় না।’

‘তাহলে কী? পাগল হয়ে বিয়ে করছিস, অথচ প্রেম নয়?’

‘জানি না শুভো, শুধু এটুকু জানি…গুলনূর আশেপাশে থাকলে বাতাসটা হালকা লাগে। বুকটা শান্ত হয়।’

‘মানে অক্সিজেন?’

হো হো করে হাসে জাওয়াদ। তার চোখের তারায় ভাসছে গুলনূরের নিষ্পাপ মুখ। আর মাত্র কিছু মুহূর্তের মধ্যেই সাক্ষাৎ হবে গুলনূরের সাথে। নববধূর পোশাকে কেমন লাগবে তাকে? লাল বেনারসি শাড়িতে, অলংকারে সুসজ্জিত অবস্থায় কতটুকু মনোহর দেখাবে? নিজের দৃষ্টি কি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে ওই রূপের মোহনায়? এইসব চিন্তাভাবনার মাঝেই বুকের অন্তরালে একটা গোপন উত্তেজনা বয়ে যাচ্ছে। আজ রাত থেকে তারা একই ছাদতলে বসবাস করবে। পাশে থাকবে গুলনূর। তার নিশ্বাসের পাশে আরেকটি নিশ্বাস। একটি কোমল দেহ তার পাশে ঘুমাবে রাতের পর রাত। কল্পনা করতেই জাওয়াদের সমগ্র শরীরে একটা নেশার অনুরূপ উত্তপ্ত অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে জীবনের সরচেয়ে সুন্দর অধ্যায় আরম্ভ হতে চলেছে। সে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকায়। চোখের সামনে ভেসে উঠে বিয়ের জমকালো আয়োজনের ছবি। সুফিয়ান সাহেব নিজের পুরো সামর্থ্য নিংড়ে দিয়ে এই বিশাল উৎসবের ব্যবস্থা করেছেন। ঘোড়ার গলায় ঝুলানো ঘণ্টার আওয়াজ শুনে ছোট ছোট বাচ্চারা হইচই করতে করতে দৌড়ে আসছে। মেয়েরা লজ্জাবতী লতার মতো পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। যুবকেরা এদিক-সেদিক ঘুরপাক খেয়ে বেড়াচ্ছে, উদ্দেশ্য একটাই একবার হলেও দেখে নেওয়া কারুকার্যখচিত বিয়ের আসর। দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন সন্ন্যাসী, ফকির আর দরবেশরা। যাদের সচরাচর দেখা মেলে না। কেউ হাতে পিরিচ ভরে খিচুড়ি খাচ্ছেন, কেউ মিষ্টির প্লেট হাতে নিয়ে হাসিমুখে আড্ডা দিচ্ছেন। দুপুর গড়িয়ে যেতেই উৎসব পুরোদমে জমে ওঠে। বাউল-ফকিররা এখন গলা ছেড়ে গাইছে প্রেম আর মিলনের গান। সুরের ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে সবার মন। আসরে যেই অতিথি বসছেন, অমনি তার সামনে হাজির হচ্ছে নানা পদের মুখরোচক খাবার। সুর আর আতিথেয়তার প্রবাহ যেন থামার নামই নেই। বিকালে শুরু হবে আসল অনুষ্ঠান। গুলনূর পা রাখবে এই জমিদারবাড়ির মাটিতে। বিয়ে পড়ানো হবে। সব অতিথি দোয়া-আশীর্বাদ করে বিদায় নেবেন। সকলেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সেই পবিত্র মুহূর্তের জন্য।

সূর্য যখন ঠিক মাথার চূড়ায়, তখন জাওয়াদ সবার দোয়া-আশীর্বাদ নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে উঠতে যাবে গুলনূরকে পালকিতে করে আনার জন্য, ঠিক সেই মুহূর্তেই হঠাৎ একটা আওয়াজে সবার নজর চলে যায় মূল ফটকের দিকে। ঘণ্টার মিষ্টি ঝনঝন শব্দে দুলতে দুলতে একটি পালকি ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে। সূর্যের তির্যক আলোয় মখমল আর জরিকাটা কাপড়ে মোড়ানো পালকিটি দেখতে একেবারে রাজকীয়। চারজন বেহারা ঘাম মুছতে মুছতে এসে সেটি মাটিতে নামিয়ে রেখেই মুখ নিচু করে দ্রুত ফটকের বাইরে মিলিয়ে যায়। এই পালকিতে চড়ে তো গুলনূরের আসার কথা! কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার ফুরসতও পায় না, বেহারারা উধাও। সবার চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত। গণ্যমান্য ব্যবসায়ী, এলাকার মাতব্বর, দরবেশ-ফকির, গ্রামের সাধারণ মানুষ সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। মুহূর্তেই চারদিকে পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে আসে। জাওয়াদ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘোড়ার গাড়িতে ওঠার কথা ভুলে গিয়ে কপালে চিন্তার রেখা নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় পালকির দিকে। হাত বাড়িয়ে পর্দাটা সরায়। সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘এ কী! একটা কুকুর!’

পালকির ভেতরে বসে আছে সাজানো-গোজানো একটা ছোট্ট কুকুর! মাথায় টিপ, গায়ে পরানো ছোট্ট লাল রঙের শাড়ি, মেহেদি রঙে আঁকা পায়ে নকশা। বউয়ের সাজে সেজে বসে আছে নিখাদ নিরীহ চোখে তাকিয়ে।

সবাই যেন পাষাণমূর্তি হয়ে যায়। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সকলে। জাওয়াদের বুকের ভেতর কিছু একটা থাবা মারে। পা দুটো সিসার মতো ভারী হয়ে আসে। কানে ভেসে আসে কারও গলার আওয়াজ, ‘হায় খোদা, জমিদারের ছেলে কুকুর বিয়ে করবে নাকি?’

সুফিয়ান ভূঁইয়া মানুষের ভিড় ঠেলে হুড়মুড় করে পালকির সামনে এসে দাঁড়ান। খবর পৌঁছে যায় খাসমহলেও। ঝড়ের গর্জনের মতো লাঠি ঠুকতে ঠুকতে ছুটে আসেন কোহিনূর। প্রধান দরজার সামনেই এসেই থমকে দাঁড়ান। কুকুরের সামনে পড়ে আছে একটা ছোট চিরকুট। জাওয়াদ কাঁপা হাতে সেটি কুড়িয়ে নেয়। সেখানে লেখা:

||নারীর নয়, কুকুরের আজ অধিকার, যেমন তোমাদের বিবেক, তেমনই উপহার।

যারা মানুষকে ভাবে জন্তু-জানোয়ার,

তাদের জন্য পশুই মানানসই সংসার||

চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে তার। হাতের লেখাটা সে চিনে…গুলনূরের ছবির মতো সুন্দর হাতের লেখা! কিন্তু এমন নিষ্ঠুর শব্দ তো গুলনূর লিখতে পারে না৷ মনে হচ্ছে যেন মাথার উপর ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ছে। বাতাসে সব উড়ে যাচ্ছে, ধুলো উড়ছে… সেই ধুলোয় অন্ধ হয়ে যাচ্ছে সে। বুকের নরম মাটিতে কার এত কুঠারাঘাত! পেছনে দাঁড়ানো সুফিয়ানের মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। রাগে, লজ্জায়, অপমানে তিনি কাঁপছেন। জাওয়াদ ছলছলে চোখে চারপাশে তাকায়, ব্যর্থ ভাবে হাসতে চেষ্টা করে, এটা নিশ্চয়ই কারও বেখাপ্পা রসিকতা! কেউ নিশ্চয়ই গুলনূরকে দিয়ে এসব লিখিয়েছে! এমন সময় পথচারী কয়েকজনের মুখ থেকে আরেকটি খবর ছড়িয়ে পড়ে, বধূসাজে একটি মেয়েকে তারা দেখেছে এক সুদর্শন যুবকের সাথে রেলস্টেশনের দিকে যেতে! মুহূর্তেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আরও ভয়ংকর সব কথা,

-‘বউ প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেছে।’

-‘বউয়ের বদলে রেখে গেছে একটা কুকুর!’

-‘কুকুরই নাকি এই বাড়ির যোগ্য বউ!’

কিছুক্ষণ আগের প্রশংসার বন্যা এক মুহূর্তে শুকিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। বদলে আসে তিরস্কার, ঠাট্টা-বিদ্রুপের ঢল। যারা একটু আগেও ‘কী মহান হৃদয়!’ বলে বাহবা দিচ্ছিল, তারাই এখন ফিসফিস করে বলতে থাকে,

-‘দেখেছ, অহংকারের ফল!’

-‘নিশ্চয়ই তলে তলে কিছু করেছে, তারই প্রতিশোধ নিয়েছে।’

-‘এই হলো দাসীকে বউ বানানোর পরিণাম! কত দুঃসাহস! জমিদার পুত্র রেখে প্রেমিকের সঙ্গে ভেগে গেল!’

অতিথিরা একে একে মুখ ঘুরিয়ে নিতে শুরু করে। কেউ কেউ তো দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যেতে থাকে, তারা এই লজ্জার ভাগী হতে চায় না। জমিদারবাড়ির মর্যাদা মাটিতে মিশে যায় এক আসরেই। যে পরিবারকে গ্রামের মানুষ শ্রদ্ধা করত, সেই পরিবারই হয়ে যায় হাসির খোরাক…ফিসফিসানির কেন্দ্র। এই অসহনীয় অপমান সহ্য করতে না পেরে বিয়ের সেই মজলিসেই কোহিনূর আর সুফিয়ান- দুজনেই কাঠের পুতুলের মতো লুটিয়ে পড়েন মাটিতে।

অন্যদিকে, জাওয়াদ তার নীল গাড়ির স্টিয়ারিং চেপে ধরে বাংলোর দিকে ছুটতে থাকে। বুকের ভেতরে যেন একটা পাখি পাগলের মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে। কী এক অশুভ আশঙ্কা তার মেরুদণ্ড বেয়ে সাপের মতো হামাগুড়ি দিয়ে উঠছে। গুলনূরের নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। তার মগজে এই চিন্তাটা কীলকের মতো বিঁধে গেছে। নিজের হৃদয়ের কাছে মিনতি করে, ‘বাংলোতে গিয়ে দেখব গুলনূর আমার জন্য অপেক্ষার করছে। আমি ও’কে নিয়ে আসব।’

গতকাল রাতে গুলনূরের গায়ে যে সুগন্ধি পেয়ে তার মনে সন্দেহের বীজ বপন হয়েছিল, সেটাই তাকে বাড়ি ফিরে গুপ্তচরের মতো গুলনূরের ঘরের ট্রাঙ্ক খুলতে বাধ্য করেছিল। সেখানে পাওয়া সুগন্ধির কাচের বোতল আর সাদা ব্লাউজ-পেটিকোট তার সব সন্দেহকে সত্যে রূপ দিয়েছিল। সে নিশ্চিত হয়েছিল, গুলনূরই সেই রহস্যময় আগন্তুক। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তার অন্তরে কোনো ক্রোধের আগুন জ্বলেনি। সে সরলমনে ভেবেছে, হয়তো কোনো অভিমানে গুলনূর তার মাকে ভয় দেখিয়েছে। পরে কৈফিয়ত নিবে। গুলনূরের প্রতি তার যে অগাধ বিশ্বাস, সেটা তার মনে কোনো কালো সন্দেহের ছায়া পড়তে দেয়নি। সেসব মনে পড়ে তার হাত দুটো কাঁপতে থাকে পাতার মতো। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, যেন বুকের উপর পাহাড় চেপে বসেছে। স্মৃতির অতল গহ্বর থেকে দুই বছর আগের সেই অভিশপ্ত দিনটা ভেসে ওঠে। যেদিন মায়ের নিষিদ্ধ প্রণয়ের আখ্যান আর নিজের জন্মরহস্য জেনে সে মানসিক চোরাবালিতে দুই বছর ধরে হাবুডুবু খাচ্ছিল। সেই মরণ চোরাবালি থেকে যে মেয়েটি বাঁচাল, তাকে নিয়ে কি সন্দেহের বিষবৃক্ষ রোপণ করা যায়? সেই মেয়েটিই কি আবার তাকে অন্ধকারের অতলে ঠেলে দিতে পারে? এই নিষ্ঠুর পৃথিবী তাকে এতটা নিঃসঙ্গ, এতটা পরিত্যক্ত করে রাখতে পারে না। প্রকৃতির সব উপাদান – আলো, বাতাস, জল – সবকিছু মিলে তার বিরুদ্ধে চক্রান্তের জাল বুনতে পারে না। তার এত সাহস নেই, তার হৃদয়ে এত দুর্দান্ত শক্তি নেই এই আঘাত সহ্য করার!

গ্রামের উঁচু-নিচু, গর্ত ভরা কাঁচা রাস্তায় জাওয়াদ উন্মাদের মতো গাড়ি চালাতে থাকে। এই পথগুলো যানবাহন চলাচলের উপযোগী নয়, কিন্তু তার সেদিকে মনোযোগ নেই। তার চোখ দুটো থেকে বেদনার নদী বয়ে যাচ্ছে। প্রতারণার আতঙ্কে চোখের জল শুকানোর নাম নিচ্ছে না। হাত দুটো এমনভাবে কাঁপছে যেন ম্যালেরিয়া জ্বরে পড়েছে। শরীরে শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছে। চোখের পাতা বার বার ঝিমিয়ে আসছে, মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে দৃষ্টি। সে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে, বাংলোবাড়িতে পৌঁছে সে অন্য কোনো সত্য আবিষ্কার করবে। গুলনূর বিশ্বাসভঙ্গের পাপে পা রাখতে পারে না। কিন্তু তার পূর্বেই গাড়িটা একটা গভীর গর্তে আটকে গিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে যায় অসহনীয় অস্থিরতায়।

প্র‍থম খন্ডের সমাপ্তি।

  • ইলমা বেহরোজ
  • Related Posts

    প্রণয় প্রহেলিকা [পর্ব- ৩১]

    সকলের একটাই কথা,  “শেষমেশ বাচ্চার কাছেই হৃদয় হারালি?” অনল তখন গর্বের সাথে বললো,  “তাহলে বুঝে দেখ আমার বউটি কতো গুণী, আমার হৃদয় চুরি করা যার তার কাজ নয়।” ধারা তো…

    সেদিন ও সে [পর্ব-০১]  

    মাঝরাতে যখন টের পেলাম সৌজন্য পরকীয়ায় জড়িত, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেদিন সন্ধ্যায়-ই আমি জানতে পারি আমি প্রেগন্যান্ট। সৌজন্য বাসায় এসেই নিজের ক্লান্তি দেখিয়ে ঘুমিয়ে গেছে বিধায় তাকে আর কিছুই বলা…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You Missed

    প্রণয় প্রহেলিকা [পর্ব- ৩১]

    প্রণয় প্রহেলিকা [পর্ব- ৩১]

    সেদিন ও সে [পর্ব-০১]  

    সেদিন ও সে [পর্ব-০১]  

    বাহারি স্বপ্ন [পর্ব-৩০]

    বাহারি স্বপ্ন [পর্ব-৩০]

    প্রণয় প্রহেলিকা [পর্ব-৩০]

    প্রণয় প্রহেলিকা [পর্ব-৩০]

    তৃষিত তরঙ্গ [পর্ব-০১]

    তৃষিত তরঙ্গ [পর্ব-০১]

    বেশ্যার লাশ | সাধুর নগরে বেশ্যা মরেছে

    বেশ্যার লাশ | সাধুর নগরে বেশ্যা মরেছে