নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব ৬৩]

দূরের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে দুটি কুকুরের চিৎকার। কণ্ঠস্বর এতটাই তীক্ষ্ণ, এতটাই বিদ্ধ করা যে মনে হচ্ছে কোনো রক্তাক্ত সংঘর্ষ বেঁধে গেছে ওখানে। জুলফার মেরুদণ্ড বেয়ে হিমেল অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেহে। একটুর জন্য থমকে গিয়ে, নিজের অস্থির শ্বাস-প্রশ্বাস সামলে নিয়ে পুনরায় সতর্কতার সাথে মেপে মেপে পা ফেলে সুরঙ্গের মুখের দিকে এগোতে থাকে।

আজ নাভেদের সাথে দেখা করার কথা৷ বনের শেষ প্রান্তে, যেখানে পুরোনো শিমুল গাছটা দাঁড়িয়ে আছে তার বিশাল শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে নাভেদ। আজ সে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে…বলবে ঠিক কবে সে এই বাড়ি, এই গ্রাম, এই শ্বাসরুদ্ধকর জীবনের স্বামী-সংসার ছেড়ে পালিয়ে যাবে, কবে তারা নতুন জীবন শুরু করবে।

সুরঙ্গের মুখে পৌঁছে ধীরে ধীরে মাথা বাড়িয়ে বাইরে উঁকি দিতেই দুপুরের নির্দয় সূর্যকিরণ এসে আছড়ে পড়ে মুখের ওপর। চোখ ধাঁধিয়ে যায় মুহূর্তে। তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে ফেলে, তারপর ধীরে ধীরে পলক খোলে। চোখ অভ্যস্ত হতে দু’সেকেন্ড সময় নেয়।

দূর থেকে ডাহুকের একঘেয়ে ডাক ভেসে আসছে। মাথার ওপরে বিশাল করই গাছের ঘন ডালপালা। সামনে বিস্তীর্ণ বন। জুলফা দ্রুত পা বাড়ায় সামনের দিকে। হঠাৎ পায়ের আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ায়, সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে যায় সতর্কতায়। কেউ এগিয়ে আসছে। দ্রুত সে বিশাল বটগাছটির পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। চোখ পড়ে বটগাছের মোটা শেকড়ের গোড়ায়। সযত্নে রাখা একটা মাটির পাত্র! পাশে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা মুড়ি-চিড়ে, সঙ্গে বাদামি গুড়ও! কেউ অতি সম্প্রতি এখানে এসেছিল, হয়তো কিছুক্ষণ আগেই!

ভয়ে তার রোমকূপ খাড়া হয়ে যায়। বটগাছে নাকি আত্মা বাস করে। ভূতপ্রেতের কাজ নয়তো? সে ভূতে বিশ্বাসী গ্রামের প্রতিটি মানুষের মতোই, যদিও ভয় তার কম। তবে আজ খুব ভয় লাগছে। এমন নির্জন বটগাছের নিচে একা একা ভয় লাগে না আবার কার!

তখনই চোখে পড়ে, বনের ভেতর থেকে ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি পরে এগিয়ে আসছে শব্দর! সিনা টান করে হাঁটছে, যোদ্ধার মতো। পাশে একটা কুকুর…তাদের বাড়ির পোষা কুকুর!

জুলফার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যায়। উনি এখানে কেন? উনার না ব্যবসায়ী কাজে দূরে যাবার কথা!

আতঙ্কের অদৃশ্য দৈত্য তার কণ্ঠনালী চেপে ধরে, শুষে নেয় সমস্ত লালা, মুখগহ্বর হয়ে ওঠে শুকনো মরুভূমির মতো। জিভ আটকে যায় তালুতে। সে বটের পেছন থেকে সরে গিয়ে একটা ঘন ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। দুর্ভাগ্যবশত, পায়ের নিচে পড়ে থাকা শুকনো পাতা মচমচ করে ওঠে।

যেখানে জুলফা দাঁড়িয়ে ছিল মুহূর্ত আগে, সেখানে এসে থমকে দাঁড়ায় শব্দর। পাতার মচমচ শব্দটা সঙ্গে সঙ্গে কানে এসে পৌঁছায়৷ চোখ সরু হয়ে আসে সন্দেহে, ভ্রু কুঁচকে যায় চিন্তায়।

বাড়ির কুকুরটা বনে এসেই অন্য একটা বুনো কুকুরের সাথে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েছিল। চিৎকার শুনে শব্দর গিয়ে দুজনের ঝগড়া থামায়। তাকে চিনতে পেরে কুকুরটিও শান্ত হয়ে পেছন পেছন চলে এসেছে।

কেউ নেই তো, মনে মনে ভাবে শব্দর! হয়তো কোনো বন্যপ্রাণী ছিল! পালিয়ে গেছে তার উপস্থিতি টের পেয়ে। শব্দর ঘাড় ঘুরিয়েই নিচ্ছিল ফিরে যাওয়ার জন্য, ঠিক সেই মুহূর্তে কুকুরটা হঠাৎ ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠে ঘন ঝোপের দিকে তাকিয়ে, যেখানে জুলফা লুকিয়ে আছে। পরপর তিনবার চিৎকার করে।

শব্দর কুকুরটির মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে? কিছু আছে ওখানে? কী দেখলি?’

জুলফার হৃদয়টা আতঙ্কিত পাখির মতো ধড়ফড় করে ওঠে। ডানা ঝাপটায় বাতাসে উড়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য। এই কুকুরটা এমন করছে কেন! নিমকহারামটাকে কতবার সে খাইয়েছে! আদর করেছে! মনে মনে কুকুরটিকে কুৎসিত কিছু গালি দেয় সে!

তারপর পা টিপে টিপে সেই জায়গা ছেড়ে অন্যদিকে সরে যেতে শুরু করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আজ তার সাথীই হয়ে বসেছে! পায়ের নিচে একটা শুকনো ডাল মর্‌মর্‌ করে ভেঙে যায়।

জুলফা মনে মনে নিজের কপালে চাপড় মারে, নিজের দুর্ভাগ্যকে অভিশাপ দেয়…তারপর দ্রুত একটা বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। গাছের কাণ্ডটি বেশ মোটা, পুরো শরীর আড়াল করার মতো। শব্দর দ্রুত পায়ে ঝোপের দিকে এগিয়ে এসে দেখে কেউ নেই! কিন্তু তার প্রবৃত্তি, তার ইন্দ্রিয় কারো উপস্থিতি টের পাচ্ছে! কুকুরটা আবার ডেকে ওঠে। লেজ নাড়ছে না, সতর্ক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে কান খাড়া করে।

শব্দর ধীরে ধীরে সামনে এগোতে থাকে। জুলফাও তার সাথে সাথে সরতে থাকে। কখনো ঘন ঝোপে ঢোকে, কখনো বড় গাছের আড়ালে লুকায়, শ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে, কখনো লতানো গুল্মের জটলায় নিজেকে লুকিয়ে ফেলে।

হঠাৎ পায়ের নিচে ধারালো কিছু একটা অনুভব হয়। বিদ্যুৎস্পর্শের মতো ঝাঁঝালো একটা যন্ত্রণা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে পায়ের পাতার ভেতর দিয়ে গোটা শরীর বেয়ে মাথা পর্যন্ত। কোনো ভাঙা শামুক হবে, নয়তো ধারালো পাথরের টুকরো। জুলফা চোখ-মুখ কুঁচকে বসে পড়ে মাটিতে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে যন্ত্রণা চেপে রাখার চেষ্টা করে। গল্‌গল্ করে রক্ত বেরোচ্ছে পায়ের তালু থেকে। ফর্সা ত্বকের ওপর উজ্জ্বল লাল রক্ত। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। মাথা ঘুরতে শুরু করে।

পায়ের শব্দ কাছে চলে এসেছে। জুলফা কোনোমতে দাঁড়িয়ে পা বেঁকিয়ে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অন্যদিকে যায়। শব্দর কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। কখনো ডানদিকে যায়, কখনো বামদিকে। জুলফাও ধরা দেয় না। কখনো সরু আঁকাবাঁকা পথে, কখনো ঘন ঝোপের ভেতর দিয়ে, কখনো বাঁশঝাড়ের ফাঁক গলিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। পা থেকে তখনো রক্ত ঝরছে ক্রমাগত।

আকাশে সূর্য মলিন হয়ে এসেছে, সোনালি আভা ম্লান হয়ে গেছে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতে শুরু করেছে।

ঘুরতে ঘুরতে একসময় জুলফা আবার সেই বটগাছের কাছে চলে আসে। কয়েক হাত দূরেই সুরঙ্গের মুখ! আজ আর বাইরে যাওয়া সম্ভব না। পায়ের যন্ত্রণায় মাথা ভন্‌ভন্ করছে। চোখে ঝাপসা দেখছে। যেভাবে হোক বাড়ির ভেতরে ঢুকে যেতে হবে। মাথায় একটা ফন্দি আসে। সে চারপাশে তাকিয়ে একটা বড় পাথর খুঁজে বের করে৷ তারপর পুরো শক্তি দিয়ে সেটা ছুঁড়ে মারে ডানদিকের ঝোপের দিকে। পাথরটা ঝপাৎ করে ঝোপে পড়ে শব্দ তোলে। শব্দর সাথে সাথে সেদিকে ছুটে যায়।

এই সুযোগে জুলফা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দ্রুত সুরঙ্গের মুখে পৌঁছে নিচু হয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে।

ঝোপের কাছে এসে শব্দর আবিষ্কার করে শুধু একটি পাথর পড়ে আছে। সেইসাথে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ধরে ফেলে, শুকনো পাতার ওপর টাটকা রক্তের দাগ। এখনো ভেজা। সে ঝুঁকে স্পর্শ করে। তার চোখ আরও সরু হয়ে আসে। মাথা তুলে চারপাশে কঠিন দৃষ্টিতে তাকায়। মাটিতে রক্তের ফোঁটা! ধারাবাহিক চিহ্ন! কেউ আহত হয়ে পালিয়ে গেছে। সেই লাল রেখা অনুসরণ করতে করতে পৌঁছে যায় সোজা সুরঙ্গের মুখ পর্যন্ত!

কে ছিল আন্দাজ করতে পেরে তার কপালের রগ দপদপ করতে থাকে। চোয়ালের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায়। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে, ‘জুলফা!’

সন্ধ্যার আলো-আঁধারির মুহূর্তে, যখন দিবসের শেষ আলোকরশ্মিগুলো ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছিল এবং রাতের অন্ধকার গাঢ় হয়ে ঘরের প্রতিটি কোণে প্রতিটি ছায়াচ্ছন্ন জায়গায় জমাট বাঁধতে শুরু করেছিল, জুলফা তখন নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে তার কাঠের পালঙ্কে। বন মটমটিয়া গাছের পাতা নিজের হাতে থেঁতলে থেঁতলে একেবারে সরাসরি ক্ষতস্থানের ওপর লাগিয়ে দিয়েছে, যাতে রক্তপড়া বন্ধ হয়ে যায়। শরীরের বাইরের এই ক্ষতটি শুকাতে খুব বেশি সময় লাগবে না, হয়তো কয়েকদিনের মধ্যেই সেরে যাবে। কিন্তু যে ক্ষতটি চোখে দেখা যায় না, যে ক্ষতটি বাইরের কোনো আঘাত থেকে সৃষ্টি হয়নি বরং বুকের গভীরতম অংশে, হৃদয়ের একদম কেন্দ্রস্থলে যে ভয়ংকর আতঙ্কের ক্ষত তৈরি হয়েছে, সেই অনুভূত ক্ষতটি কোন ভেষজ পাতায় সারাবে?

বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে বিরতিহীনভাবে। উনি কি বুঝে গেছেন ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানুষটা কে ছিল? জেনে গেছেন সমস্ত সত্য? তাছাড়া কেনই বা ছিলেন ওখানে? বনের মধ্যে ওভাবে ওঁত পেতে বসে থাকার কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? নিশ্চয়ই সন্দেহ এতোটাই ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে যে, তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলার জন্য, তার গোপনীয়তা উন্মোচিত করার জন্য পূর্বপরিকল্পিত ফাঁদ পেতে বসেছিলেন সেখানে!

জুলফা আর ভাবতে পারছে না। নিজের বুকে হাত রাখে। কেন এত ভয় লাগছে তার? মনের ভেতরের মন একটা সতর্কধ্বনি বাজিয়ে চলেছে… ঘণ্টা বাজিয়ে বলে যাচ্ছে: ঘূর্ণিঝড় আসছে। এক ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে…তছনছ করে সব কিছু উড়িয়ে নিয়ে যেতে।

জুলফা নিজেকে উপুড় করে ফেলে পালঙ্কের ওপর, মুখ গুঁজে দেয় নরম তুলোর বালিশে।

নিশুতি রাতে হঠাৎ দরজায় করাঘাতের শব্দ। জুলফা চমকে ওঠে। বুকের ধুকপুকানি আরও প্রবল হয়ে ওঠে। সে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বিছানা থেকে নামে। পায়ের তালুতে তীব্র ব্যথা। দাঁড়াতে গেলে মনে হয় পা দিয়ে আগুনের শিখা উঠছে। এই রক্তাক্ত পায়ের চিহ্ন উনাকে দেখানো যাবে না। দেখালেই শুরু হবে প্রশ্নের ঝড়।

সন্দেহের কালো মেঘ আরও ঘনীভূত হবে। জুলফা দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করে, ঠিকঠাকমতো পা ফেলে হেঁটে যায় দরজার দিকে। দরজা খুলে কৃত্রিম সুরে বলে, ‘এত রাত হলো যে?’

শব্দর দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়। তার চোখ বরফের মতো ঠান্ডা। দেখছে জুলফাকে। জুলফার মনোহর চোখ দুটি সবসময় নির্মল জলের মতো স্বচ্ছ থাকে, আজ তার কাছে মনে হচ্ছে সেই চোখ দুটিই কপটতার আবরণে ঢাকা। তার নিজের চোখ দুটিও লাল হয়ে আছে। সন্দেহ তার বুক ছাড়খার করে দিচ্ছে।

শব্দর কিছু না বলে ভেতরে ঢোকে। তার হাতে একটা ব্যাগ। জুলফা ভেতরে ভেতরে ভয়ে কাঁপছে। শরীর শিউরে উঠছে। লোকটার চেহারা কেমন থমথমে দেখাচ্ছে।

শব্দর ঘাড় ঘুরিয়ে বিকারহীন গলায় বলে, ‘এদিকে এসো।’’

জুলফা এগিয়ে আসে। শব্দর ব্যাগ থেকে ঘাগড়া, ব্লাউজ, আর পায়ের ঘুঙুর বের করে বিছানার উপর রেখে বলে, ‘প্রস্তুত হয়ে নাচঘরে আসো।’

জুলফাকে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে না দিয়ে শব্দর বেরিয়ে যায়। জুলফা দাঁড়িয়ে থাকে হতবিহ্বল হয়ে। ভয়ে তার গলা বুজে আসে।

হাতে তুলে নেয় ঘুঙুরগুলো। কতদিন এগুলো পরা হয়নি! কতদিন এই ঘুঙুরের নিক্কণ শোনা যায়নি! সদ্য ক্ষত নিয়ে সে কীভাবে নাচবে? কীভাবে তাল রাখবে, ছন্দে পা ফেলবে?

উনি তাহলে সত্যি বুঝে গেছেন, ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানুষটা যে সে ছিল! তার পা কেটে গেছে সেই সত্যও উনার অজানা নয়! এই নাচের আয়োজন আসলে একটা শাস্তি… একটা পরীক্ষা! যেন সে নিজমুখে স্বীকার করে নেয় সব কিছু…যেন তার ক্ষতবিক্ষত পা দেখে সব রহস্য উন্মোচিত হয়!

জুলফা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করে। মেরুদণ্ড সোজা করে বসে। আতঙ্ক গলা অবধি উঠে এসেছে, শ্বাসরোধ করতে চাইছে। শরীর খারাপ লাগছে। জ্বর জ্বর ভাব, মাথা ঘোরা, অস্থিরতা। হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি তুলে নেয়। কাঁপা হাতে গ্লাস ঠোঁটে ঠেকায়। ঢক ঢক করে পানি পান করে। এরপর প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। বিপদ কাটাতে হবে। যেভাবে হোক কাটাতে হবে। নাচতে হবে৷ যতই ব্যথা হোক, যতই পা কাটা থাকুক। এই নাচের মাধ্যমেই তাকে শব্দরকে বোঝাতে হবে যে সে নির্দোষ। নাচের ছন্দে, নাচের ঘূর্ণনে, নাচের মাদকতায় তাকে সন্দেহের ঘোর থেকে বের করে আনতে হবে। প্রমাণ করতে হবে যে সে সেই ছায়ামূর্তি ছিল না, সে নির্দোষ, সে বিশ্বস্ত।

জুলফা নাচঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজার হাতল ধরে দীর্ঘশ্বাস নেয় বুক ভরে। তারপর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে। ঘরে ঢুকতেই একটা গা ছমছমে অনুভূতি তাকে গ্রাস করে ফেলে। ঘরের চারপাশে দেয়ালে বাঁধানো মশালগুলো কাঁপছে। নিভু নিভু হচ্ছে, আবার জ্বলে উঠছে।

শব্দর আয়েশ করে বসে আছে ঘরের এক কোণে, নরম কুশনে হেলান দিয়ে রাজার মতো। হাতে রুপোর পানপাত্র। পাত্রের ভেতরে লালচে শরবত। ঘন, লাল নেশার পানীয়। ঢকঢক করে পান করছে। চাহনি অস্বাভাবিক। মুখের খাঁজে খাঁজে গাম্ভীর্য।

জুলফাকে ঢুকতে দেখেই কেমন ঘেরঘেরে নেশাগ্রস্ত কণ্ঠে বলে, ‘বহুদিন তোমার নাচ দেখি না, জেসমিন।’

জেসমিন…নামটা উচ্চারিত হতেই জুলফার মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। এই নাম তার আরেক পরিচয়, আরেক সত্তার নাম। যে সত্তা নাচে, যে সত্তা বিনোদন দেয়, যে সত্তার কোনো মর্যাদা নেই, কোনো প্রশ্ন করার অধিকার নেই।

শব্দর পানপাত্র রেখে টেপ রেকর্ডারটা চালু করে। ঘড়ঘড় আওয়াজ তোলে যন্ত্রটা, তারপর বেজে ওঠে গান,

আমি রূপ নগরের রাজকন্যা,

রূপের জাদু এনেছি

ইরান তুরান পার হয়ে আজ,

তোমার দেশে এসেছি

জুলফা চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্তের জন্য। তারপর চোখ খোলে। এখন সে জুলফা নয়, জমিদার বধূও নয়…সে জেসমিন। একজন নর্তকী, একজন নটী!

সে ধীরে ধীরে হাত তুলে আকাশের দিকে, আঙুলগুলো মসৃণ বক্ররেখা তৈরি করে বাতাসে। কব্জি ঘোরে, হাতের কাঁকন ঝনঝন করে বাজে। তারপর পা ফেলে শুরু করে নাচ৷

ব্লাউজ ছোট। নাভির অনেক উপরে শেষ হয়েছে। নাভির চারপাশের খোলা ত্বকে মশালের আলো এসে পড়ে, ঝলমল করে ওঠে। কোমরে ঘাগড়ার কোমরবন্ধ আঁটসাঁট বাঁধা। কানে ঝোলানো কানপাশা।

শব্দর একদৃষ্টিতে জুলফাকে দেখছে। না, সমস্ত শরীর নয়, তার দৃষ্টি নিবদ্ধ শুধুমাত্র জুলফার পায়ে। শিকারীর মতো খেয়াল রাখছে সে। দেখতে চায় জুলফা আহত পা নিয়ে কতক্ষণ নাচতে পারে, কতক্ষণ ভান করতে পারে!

জুলফা নাচছে। প্রথমে অনিচ্ছায় নাচলেও ধীরে ধীরে গানের সুর তার শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে। সে ভুলে যায় শব্দরকে, ভুলে যায় সন্দেহকে, ভুলে যায় ক্ষতস্থানকে। নাচতে নাচতে সে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। নাচ আর অভিনয় তার আত্মার খোরাক, তার প্রাণের প্রাণ। এই নাচের মধ্যেই সে মুক্তি খুঁজে পায়।

তার হাত ওঠে, নামে, ঘোরে বাতাসে। পা পড়ে তালে তালে…একবার ডান, একবার বাঁ, আবার ডান। শরীর দুলছে সাপের মতো। কোমর বাঁকছে, সোজা হচ্ছে, আবার বাঁকছে। চুল উড়ছে বাতাসে। নাচতে নাচতে সে নিজেকে সুখী অনুভব করে। সেই আনন্দও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। পায়ের ক্ষতস্থান থেকে আবার রক্ত বেরোতে শুরু করে। প্রথমে কয়েক বিন্দু, তারপর ফোঁটা ফোঁটা, তারপর গলগল করে। মেঝে লাল হতে শুরু করে। সাদা মার্বেলের উপর লাল দাগ ছড়িয়ে পড়ে। মেঝেতে মোজাইক করা আলপনা আঁকা, রঙিন পাথরে তৈরি জটিল নকশা। সেই রঙের মধ্যে লাল রক্ত হয়তো ওতো সহজে চোখে পড়বে না। হয়তো শব্দর টের পাবেন না। জুলফা এই আশা নিয়েই নাচতে থাকে।

ঠোঁটে হাসি নিয়ে চোখ মেলে শব্দরকে চোখের ইশারায় আহ্বান করে। ঘুরে ঘুরে দেখায় নিজেকে। আঙ্গুলের ইশারায় ডাকে। সে চায় শব্দরের দৃষ্টি তার মুখে থাকুক, তার শরীরে থাকুক, পায়ে নয়!

শব্দরের দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসে। অবজ্ঞা কমে, সন্দেহ ঝাপসা হয়ে আসে। একটা সম্মোহনী সুগন্ধি টের পাচ্ছে সে৷ জুলফার থেকে আসছে! তার চোখ এখন জুলফার মোমের মতো সুন্দর শরীরের নিখুঁত অঙ্গভঙ্গিতে। প্রতিটি নড়াচড়া এত আবেদনময়ী, এত লাস্যময়ী! জুলফা যখন কোমর বাঁকায়, যখন বাহু তোলে, যখন ঘাগড়া ঘুরিয়ে সামনে এগিয়ে আসে, শব্দরের শ্বাস আটকে যায়। কান দিয়ে আগুনের হলকা ওঠে।

সে এমন নারী দুটো দেখেনি জীবনে। জুলফা বিপজ্জনক সুন্দর! আগে তো এতো সুন্দর ছিল না! বুকের ভেতর রক্ত ছলকে ছলকে ওঠে উত্তেজনায়, আকাঙ্ক্ষায়। হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হয়, নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে। শব্দর ঝুঁকে পড়ে সামনে, হাত বাড়ায় রুপোর পানপাত্রের দিকে। আবার ঢকঢক করে পান করে লাল পানীয়। গলায় জ্বালা করে নামে, তারপর বুকে গিয়ে আগুন ধরায় ঠিক জুলফাকে পেয়েও না পাওয়ার যন্ত্রণার মতো।

অকস্মাৎ তার চোখ পড়ে জুলফার পায়ে।

রক্ত! লাল রক্ত ঝরছে ফোঁটায় ফোঁটায়।

শব্দরের বুকের ভেতরটা হঠাৎ ব্যথায় ভরে ওঠে। কেউ যেন দোফালা করে দেয় কলিজা। সে নিশ্চিত ছিল বনে জুলফাই ছিল।

জুলফা তবুও নাচছে। নাচ থামাচ্ছে না। হার মানছে না। এত জেদ? কিন্তু তার যে জুলফার যন্ত্রণা সহ্য হচ্ছে না! কবে এমন হলো? কবে হৃদয়ের এত গভীরে ঢুকে পড়ল এই মেয়েটা? তার জন্য কিছুই তো করেনি এই মেয়ে! তবে কেন এতটা ভালোবেসে ফেললো? প্রশ্নগুলো ঝড়ের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়।

নিষেধ করার পরও জুলফা কেন বেরিয়েছিল? কেন তাকে দেখে ওভাবে পালিয়েছিল আতঙ্কিত হরিণের মতো? কী লুকাচ্ছে ও? কার কাছে যাচ্ছিল? ও কি কারো সাথে প্রেম করছে? কোনো পুরুষ আছে ওর জীবনে?

বুকের ব্যথা তীব্র আকার ধারণ করে। শব্দর উঠে কয়েক পদক্ষেপে পৌঁছে যায় জুলফার কাছে। জুলফার খোলা মসৃণ পেট, সরু কোমর জড়িয়ে ধরে শক্ত হাতে। তুলোর মতো নরম শরীরে ডেবে যায় তার হাত।

জুলফা চমকে যায। নাচ থেমে যায়, শ্বাস আটকে আসে। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় শব্দরের দিকে বিস্ফারিত চোখে। শব্দর তার মুখের একদম কাছে মুখ নিয়ে এসে হিসহিসিয়ে বলে, ‘কী লুকাচ্ছ জুলফা? কী লুকাচ্ছ তুমি আমার কাছ থেকে?’

জুলফার বুক হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে। শব্দর তাকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেছে। শরীরের সাথে শরীর ঠেকে, নিঃশ্বাস মিশে যাচ্ছে নিঃশ্বাসে। একটা সুঠাম হাত সাপের মতো আঁকড়ে ধরে রেখেছে কোমর। অন্য হাত চেপে ধরে আছে পিঠ। জুলফা পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে টলমল অবস্থায়।

ফ্যাসফ্যাসে গলায়, কাঁপা কণ্ঠে বলে, ‘কী…কী লুকোব?’

শব্দর অগ্নিচোখ জুলফার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওই ভেদকারী দৃষ্টি জুলফার আত্মায় ঢুকে গিয়ে সব রহস্য পড়ে নিতে চাইছে। কী আছে জুলফার মধ্যে? এমন কী জাদু, এমন কী মায়া? ওর চোখে, ওর গায়ে, ওর প্রতিটি নিঃশ্বাসে! সম্মোহন করে ফেলার মতো শক্তি, মাতাল করে দেওয়ার মতো নেশা।

মশালের অল্প আলোয় জুলফাকে এতো মায়াবী লাগছে! রাগ-ক্ষোভকে একটা অন্য তীব্র আকর্ষণ গলা চেপে মেরে ফেলতে চাইছে।

শব্দর সেই আকর্ষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আগে সত্যটা জানতে হবে। আগে নিশ্চিত হতে হবে। অন্য হাত দিয়ে জুলফার পিঠের চামড়া মুঠো করে ধরে নির্মমভাবে। ব্যথায় জুলফার কপাল কুঁচকে যায়। চোখ বন্ধ হয়ে আসে। বিড়বিড় করে প্রতিবাদ করে, ‘ব্যথা পাচ্ছি আমি।’

শব্দর আরও জোরে চেপে ধরে তেজি গলায় বলে, ‘এর চেয়েও বেশি ব্যথা পাবে। অনেক বেশি পাবে, যদি কোনো ছলনা করে থাকো। যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকো।’

জুলফা অবুঝের মতো বলার চেষ্টা করে, ‘কী বলছেন আপনি? কীসের ছলনা? কীসের প্রতারণা? আপনি আমাকে সন্দেহ করছেন?’

শব্দর জুলফার মুখের আরও কাছে তার মুখ নামিয়ে আনে। এত কাছে যে জুলফা তার নিঃশ্বাসের গরম হাওয়া অনুভব করে।

‘করোনি ছলনা? সত্যি করোনি?’

জুলফার গলা শুকিয়ে যায়, ‘না…না, করিনি।’

শব্দর আরও নামিয়ে আনে মাথা, ঠোঁট প্রায় ছুঁয়ে ফেলে জুলফার ঠোঁট। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, ‘করোনি? সত্যি করোনি কিছু?’

জুলফা অস্ফুটস্বরে উত্তর দেয়, ‘নাহ…করিনি। বিশ্বাস করুন, করিনি।’

‘তবে কোথায় গিয়েছিলে? আমি নিষেধ করা সত্ত্বেও, আমার আদেশ অমান্য করে কোথায় গিয়েছিলে তুমি? কার কাছে? কার ডাকে?’

জুলফার ঠোঁট দুটি থরথর করে কাঁপছে। শব্দর বিশালাকার একটা মানুষ। দীর্ঘদেহী, পেশীবহুল, শক্তিশালী। পরিণত পুরুষ, অভিজ্ঞ পুরুষ। তার শক্ত, সুঠাম দুটি হাত লোহার বেড়ির মতো, শেকলের মতো ঘিরে ফেলেছে তাকে। যেন বোঝাতে চাইছে, পালানোর কোনো পথ নেই, রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই।

সে টের পাচ্ছে মানুষটার ভেতরের রাগের সবটুকু উষ্ণতা। সেই ক্রোধ তার ত্বকে লাগছে, নিঃশ্বাসে অনুভব হচ্ছে। ভয় ভয় করছে। সে কোনোরকমে বলে, ‘ঘরে…ঘরে ভালো লাগছিল না। মন খারাপ ছিল। তাই একটু ঘুরে এসেছিলাম। শুধু একটু…’

শব্দর চিৎকার করে ওঠে, ‘কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে? কোন পুরুষের সাথে? প্রেমিক জুটিয়েছো? বলো…বলো সত্যি বলো!’

জুলফার প্রাণ আটকে আসে গলায়। মানুষটার চোখ দুটি থেকে যেন আগুন ঝরছে। ক্রোধের আগুন, ঈর্ষার আগুন। সেই আগুনের স্পর্শ, সেই জ্বলন্ত নিঃশ্বাস এসে পড়ছে তার মুখে, ঠোঁটে। তার চোখে অশ্রু জমে ওঠে। চোখের কোণ ভিজে ওঠে। অশ্রুসিক্ত গলায় বলে, ‘আমি…আমি কারো সঙ্গে দেখা করিনি। কোনো পুরুষের কাছে যাইনি। বিশ্বাস করুন, আল্লাহর দোহাই বিশ্বাস করুন। আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, অকারণে সন্দেহ করছেন আপনি।’

‘সন্দেহ করছি, হ্যাঁ? তাহলে এত ভয় কেন পাচ্ছো? কেন কাঁপছো? চোখেই বা জল কেন?’

‘দারোগার মতো জেরা করলে, চিতার মতো থাবা মেরে ধরে রাখলে ভয় পাব না বুঝি?’

জুলফা অভিমানী চোখে তাকায়। চোখ থেকে দুই ফোঁটা স্বচ্ছ জল গড়িয়ে পড়ে থুতনি ছুঁয়ে। শব্দর সেই অশ্রু দেখে থমকে যায়। জুলফার ভিজে ওঠা চোখ দুটিতে এক পৃথিবী মায়া দেখতে পায়। সেই মায়া তার অনুভূতির আগুনে ঘি ঢেলে লেলিহান করে তোলে। সম্মোহিত হয়ে পড়ে। ক্রোধের জায়গায় ভালোবাসা, সন্দেহের জায়গায় আকাঙ্ক্ষা গেঁড়ে বসে। একটা আগুন ছড়িয়ে পড়ে ভেতরে, যে আগুন ধ্বংস করে না, শুধু পোড়ায়…মিষ্টি যন্ত্রণায়।

জুলফার নাকের ডগা অজানা কারণে ঝিকমিক করছে। হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। মনের রাগক্ষোভ, সন্দেহকে মাড়িয়ে হঠাৎ করেই কোনো এক ফুলের সুগন্ধি এসে পবিত্র করে দেয় শব্দরের হৃদয়পারা। নরম হয়ে আসে মন।

শব্দর ঝুঁকে জুলফার নাকের ডগায় চুমু খায়। তারপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে, ‘তবে আমি কেন এত ভয় পাচ্ছি জুলফা? বলো তো, বুকের ভেতরটা কেন এত অশান্ত ? কেন কোনোভাবেই শান্তি খুঁজে পাচ্ছি না? তোমাকে হারিয়ে ফেলব এই ভয়ে কেন আমার প্রাণ থরথর করে কাঁপছে, কেন আমার সমস্ত অস্তিত্ব টলমল করে উঠছে?’

জানালা দিয়ে ধেয়ে আসছে উত্তাল বাতাস। বৃষ্টি হবে। আকাশে মেঘ জমেছে, বাতাসে আর্দ্রতা এসেছে। সেই হাওয়ায় মশালের আগুন লাফাচ্ছে পাগলের মতো। পর্দাগুলো উড়ছে টালমাটাল হয়ে। একইসাথে জুলফার হৃদয়ও টালমাটাল করছে। শব্দর তাকে হারানোর ভয় পাচ্ছে! এই খবর জেনে তার বুকের ভেতর কীসের এতো সুখ? জানে না কারণ, বুঝতে পারে না কেন এই ভালো লাগা। সে দ্শব্দরকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে, ‘মিছেমিছি ভয় পাচ্ছেন। শান্ত হোন, দয়া করে শান্ত হোন, কিছুই হবে না।’

শব্দর চোখ তুলে তাকায়। দুই জোড়া চোখ একে অপরের অতলে ডুবে যায়। শব্দর

আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলে, ‘জুলফা, জুলফা… আমার বউ তুমি। আমার বউ। আমার জীবন। তুমি ছাড়া আমি কিছুই না। একটা শূন্য মানুষ, একটা খালি খোলস। তুমি যদি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করো…যদি অন্য কারো দিকে তাকাও…তাহলে আমি…আমি,’

জুলফা তৎক্ষণাৎ দুই হাত তুলে শব্দরের দুই গাল আলতো করে ধরে, তার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে, ‘আমি কখনো কারো হব না, কারো দিকে তাকাব না। আপনি শান্ত হোন, দয়া করে শান্ত হোন, আমাকে বিশ্বাস করুন।’

‘জুলফা…জুলফা, শোনো,’ শব্দর সদ্য প্রেমে পড়া কিশোরের মতো বলে, ‘আমি তোমার কোমরের লাল তিলকে জানি, তোমার পিঠের পুরনো কাঁটা দাগকে জানি। তুমি…তুমি কি জানো আমার জন্মদাগকে?’

প্রশ্নটা শুনে জুলফার বুকের ভেতরে অপরাধবোধ রাক্ষুসে শকুনের মতো ধেয়ে এসে বুক চেপে ধরে, নখ বসিয়ে দেয় তার হৃদয়ে! বহুবার নিজেকে সমর্পণ করেছে শব্দরের কাছে, কিন্তু কখনো সত্যিকারের আগ্রহ নিয়ে, গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখা হয়নি তার সুঠাম, পেশীবহুল শরীর, জানা হয়নি তার শরীরের গোপন চিহ্নগুলো। হতবিহ্বল হয়ে, লজ্জায়, অপরাধবোধে জুলফা হাত সরিয়ে নেয় শব্দরের গাল থেকে। শব্দর তৎক্ষণাৎ তার হাতের বেষ্টন আরও শক্ত করে জুলফার চারপাশে, এক হাত দিয়ে আদর করে জুলফার কপালের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দেয়, তারপর আস্তে আস্তে আঙুল চালায় তার ঘন, কালো চুলের ভেতর দিয়ে। ফিসফিসিয়ে বলে, ‘আমি যদি ধরার মতো ধরি জুলফা… তুমি কাউকে মুখ দেখাতে পারবে না। কোথাও যেতে পারবে না। আজ তুমি আমাকে জানো…আমার জন্মদাগকে চিনো…পাখি…আমার বোকা পোষা পাখি। আমার খাঁচার পাখি।’

বলতে বলতে শব্দর জুলফার থরথর করে কাঁপতে থাকা গোলাপি, কোমল দুটি ঠোঁট নিজের করে নেয়। জুলফার গা কেঁপে ওঠে। পিছিয়ে যেতে যেতে তার পিঠ শক্ত হয়ে ঠেকে যায় ঠাণ্ডা দেয়ালে।

শব্দর সাধারণত জুলফাকে ভালোবাসে যত্ন করে। যেভাবে একজন মানুষ একটি দামি কাঁচের পুতুলকে যত্ন করে রাখে, ভাঙার ভয়ে সযত্নে ধরে রাখে, ঠিক সেইভাবে। কিন্তু আজ সে জুলফাকে ভালোবাসে কোনো শক্ত ধাতু ভেবে, যে ধাতু ভাঙে না, ব্যথা পায় না। আজ তার ভালোবাসায় চিরচেনা কোমলতা নেই…আছে শুধু অধিকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা, দখল নেওয়ার ইচ্ছা, চিহ্নিত করে রাখার মরিয়া চেষ্টা।

জুলফার চোখ ভিজে ওঠে, তবুও বাধা দেয় না। শব্দরের ভালোবাসা, রাগ, সন্দেহ একসাথে মিলে বেরিয়ে আসে প্রতিটি স্পর্শে, প্রতিটি চুমুতে, প্রতিটি আলিঙ্গনে। চিহ্ন রেখে যায় জুলফার শরীরের আনাচে-কানাচে। ঘাড়ে, কাঁধে, কোমরে, পিঠে।

দেয়ালে ঝোলানো মশালের আগুন তখনও বাতাসের তালে তালে এদিক-সেদিক দুলছে পাগলের মতো।

আলো-আঁধারের খেলা চলছে দেয়ালে।

ভোররাত। আগুনের লেলিহান শিখা প্রথমে স্পর্শ করে পর্দাকে। রেশমি কাপড়ে মুহূর্তে ধরে ফেলে আগুন, জ্বলে ওঠে কমলা-হলুদ শিখায়। দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। আগুনের জিহ্বা চাটতে থাকে দেয়ালে ঝোলানো অলংকরণ, কাঠের খোদাই করা আসবাবপত্র। ধোঁয়া উঠতে শুরু করে কালো মেঘের মতো, ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে বিষাক্ত শ্বাসরোধকারী ধোঁয়া।

কাশির তীব্র দমকে শব্দরের চেতনা ফিরে আসে অবচেতন থেকে। গলা জ্বালা করছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চারিদিকে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া, কিছুই দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট। প্রথমে বুঝতে পারে না ঠিক কী হচ্ছে। তারপর হঠাৎ করেই টের পায় গরম, অসহনীয় গরম। ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর। চোখ খুলে দেখে চারিদিকে আগুন। দেয়াল বেয়ে উঠছে আগুনের স্তম্ভ। তার বুকের ওপর মাথা রেখে এখনও ঘুমিয়ে আছে জুলফা, নগ্ন শরীর চাদরে ঢাকা, নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। শব্দর তাকে জড়িয়ে ধরে হড়বড় করে উঠে বসে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে, ‘আগুন! আগুন লেগেছে!’

জুলফা চোখ খুলে চমকে ওঠে। তীব্র ধোঁয়ায় কাশতে শুরু করে। পর্দাগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে, কাঠের আসবাবপত্র থেকে বেরোচ্ছে কালো ধোঁয়া। যেন জাহান্নামে চলে এসেছে!

শব্দর জুলফার শরীর চাদরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আর্তচিৎকার করে দাসীদের ডাকে, ‘কে কোথায় আছো? আগুন! আগুন লেগেছে এখানে!’

রাইহা চিৎকার শুনে দৌড়ে আসে, পিছু পিছু আসে অন্যান্য দাসীরা। আগুন দেখে আতঙ্কে জমে যায় সবাই। রাইহা চিৎকার করে সবাইকে বলে পানি নিয়ে আসতে, দ্রুত পানি আনতে। শব্দর মরিয়া হয়ে ঝুঁকি নিয়ে জুলফাকে বুকে শক্ত করে ধরে ঝাঁপিয়ে পড়ে জ্বলন্ত আগুনের মধ্য দিয়ে, বেরিয়ে আসার মরণপণ চেষ্টা করে বাইরে। কোনোমতে বেরিয়ে এলেও তার পিঠের অনেকটা জায়গা পুড়ে যায় ভয়াবহভাবে, চামড়া ঝলসে যায় আগুনের তাপে।

সবাই মিলে পানি ঢালতে থাকে নাচঘরে।

রাইহা, গৌতমের মা আঁকড়ে ধরে অচেতন জুলফাকে। রাইহা আতঙ্কে বলছে আর চিৎকার করছে, ‘কীভাবে আগুন লাগল? হায় আল্লাহ! কীভাবে এমন আগুন লাগল? সবাই পানি ঢালো! আগুন থামাও নইলে সব পুড়ে যাবে!’

শব্দর জুলফাকে নিরাপদে ছেড়ে দিয়ে রাগে উন্মাদ হয়ে ওঠে৷ বারান্দা ধরে উল্টোপথে হাঁটতে থাকে। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। পায়ে ধপধপ শব্দ হতে থাকে মেঝেতে। অনেক সহ্য করেছে, আর নয়, আর একটুও নয়। একটা ভুলের জন্য সে সারাজীবন এই নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে পারবে না, পারবে না আর একদিনও। হিংস্র জন্তুর মতো শেষ মাথার ঘরে গিয়ে ঢোকে তীব্র বেগে, যেখানে ললিতা পায়ের উপর পা তোলে আরামে পান চিবোচ্ছিলেন। শব্দরকে দেখেই উঠে দাঁড়ান। শব্দর গিয়ে তার গলা চিপকে ধরে কিড়মিড় করে বলে, ‘এতো বছর জ্বালিয়ে মেরেও তোমার স্বাদ মেটেনি? এখন একেবারে পুড়িয়ে মারতে চাও? তান্ত্রিক দিয়ে কালোজাদু করিয়ে আমার জীবন নষ্ট করার চেষ্টা করেছো, তোমার জ্বালায় ব্যবসার অজুহাতে বাড়ির বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়িয়েছি, এত বছর অবিবাহিত থেকেছি মৃত মানুষের মতো, যখন যে নারী আমার জীবনে আসতে চেয়েছে তাকেই তাড়িয়েছো, এখন বুড়ো হয়েছো তাও তোমার রঙ যায়নি, পাপের নেশা যায়নি? এখন একেবারে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে চাও? জানে মেরে ফেলতে চাও, হা? তোমার পাপের শেষ কোথায়? কোথায় শেষ তোমার এই পশুত্বের?’

  • Related Posts

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব ৬২]

    একটা ছোট মেয়ে। বয়স নয় কি দশ হবে। মাথাভর্তি উসকোখুসকো চুল। পরনের জামাকাপড়ে ময়লার পুরু আস্তরণ জমে আছে। কাঁধে ঝুলছে একটা মোটা পাটের বস্তা, যার প্রায় অর্ধেকটা ভরে গেছে হলদেটে…

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব-৬১]

    গুলনূরের চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসা জলকণা গালের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ে একবিন্দু একবিন্দু করে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, কষ্টের মাঝেও সে হাসছে! তার ঠোঁটের কোণ বিদ্রূপে ভরা। জাওয়াদের দিকে নির্ভীক…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You Missed

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব ৬৩]

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব ৬৩]

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব ৬২]

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব ৬২]

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব-৬১]

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব-৬১]

    মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [শেষ পর্ব]

    মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [শেষ পর্ব]

    অটবী সুখ [পর্ব-০১]

    অটবী সুখ [পর্ব-০১]

    প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব-০৮]

    প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব-০৮]