নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব-৫২]

ঋতুর চক্রাবর্তের মতোই নিয়তির হাত ভূঁইয়া পরিবারের জীবনে এনেছে আমূল পরিবর্তন। সুফিয়ান এখন বিছানার কয়েদি। সকালের সূর্যোদয় থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত তিনি শুধু শুয়ে থাকেন, নিথর পাথরের মতো। ভোরের মিষ্টি আলো যখন জানালার দিয়ে মেঝেতে আছড়ে পড়ে, অথবা বিকেলের সোনালি রোদ যখন ঘরের দেয়ালে নরম ছায়া ফেলে, তখনই সুফিয়ানের মনে জাগে বাইরের জগতের প্রতি একটুখানি আকাঙ্ক্ষা। অনুগত সেবক মনিরই এখন তার একমাত্র সহায়। সযত্নে তাকে তুলে ধরে, তার দুর্বল শরীরের ভর নিয়ে বারান্দার একটি চেয়ারে বসিয়ে দেয়।

বারান্দায় বসে সুফিয়ান তাকিয়ে থাকেন দূর দিগন্তের দিকে। কী যেন খোঁজেন সেই অসীমের মাঝে। ললিতা নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিয়েছেন। ঘরবন্দী হয়ে চুপিসারে কেবল নীরবতা পোষেন। দাসদাসীরাও ললিতার এই নীরবতায় সংক্রমিত হয়ে গেছে। একসময় যে বাড়িতে সারাদিন কাজের আওয়াজ, কথাবার্তার শব্দ, হাসিঠাট্টার রোল ভেসে বেড়াত, আজ সেই বাড়িতে পিনপতন নিরবতা। সবার মুখে যেন তালা ঝুলে গেছে। কেউ আর আগের মতো উৎসাহে কাজ করে না, কেউ আর আগের মতো কথা বলে না। অবসরে কাটছে সবার দিন। কাজকর্মও এখন আর আগের মতো গুরুত্ব পায় না। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শব্দর নিজেকে সময়ের দাসে পরিণত করেছে। দিন আর রাতের কোনো হিসেব তার কাছে নেই। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, মধ্যরাত থেকে ভোর – সব সময়টাই সে ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকে। তার একটাই চিন্তা – এই ব্যবসাটাই তো তাদের শেষ ভরসা, শেষ সম্বল। পরিবারের সমস্ত দায়দায়িত্ব এখন তার একার কাঁধে এসে পড়েছে।

ব্যবসার পিছনে পাগলের মতো ছুটে চলেছে সে। কখনো আড়তে, কখনো গুদামঘরে, কখনো বাজারে, কখনো ব্যবসায়ীদের সাথে দেখা করতে। চোখের নিচে কালো দাগ ফুটে উঠেছে। মুখে ক্লান্তির ছাপ। সুঠাম শরীরটা ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। মাঝে মাঝে এমন দুর্বল হয়ে পড়ে যে বিছানা ছাড়া আর কোথাও যেতে পারে না। ওষুধের শিশিগুলো এখন তার নিত্যসঙ্গী। ওষুধই এখন তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

দুপুরের সূর্য আজ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে। আকাশ ধূসর রঙের চাদরে ঢাকা। মৃদু বাতাস জানালার পর্দাগুলোকে আলতো করে দোলাচ্ছে। এমন মেঘলা দিনে ভূঁইয়া বাড়ির দ্বিতীয় তলার ঘরে চলছে পবিত্র কুরআনের পাঠ। ঘরটি সাজানো-গোছানো, দেয়ালে ঝুলানো আছে কয়েকটি ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি। একটি ছোট্ট কার্পেটের উপর রাখা দুটি চেয়ার – একটিতে বসে আছেন ওস্তাদজি, অন্যটিতে রাইহা।

মাসখানেক হলো তার জন্য একজন ওস্তাদজী রাখা হয়েছে। সে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছে ঠিকই, কিন্তু আরবি ভাষার সাথে তার পরিচয় ছিল সীমিত। এখন সেই শূন্যতা পূরণ করার চেষ্টা করছে। আজকের পাঠ আয়াতুল কুরসি। ওস্তাদজি ধীরে ধীরে, স্পষ্ট উচ্চারণে পড়ে শোনাচ্ছেন। রাইহা মনোযোগ দিয়ে শুনছে, চেষ্টা করছে প্রতিটি শব্দের সঠিক উচ্চারণ শিখতে।

ওস্তাদজী নম্র গলায় বলেন, ‘আয়াতুল কুরসি হলো কুরআন শরীফের সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ আয়াত। এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ এবং তার মহত্ত্বের কথা বলা হয়েছে।’

তিনি প্রতিদিনই কুরআন পড়ানোর পাশাপাশি কোনো না কোনো ফজিলতপূর্ণ আয়াত বা সূরা শেখান। শুধু শেখানই নয়, তিনি এগুলোর উপকারিতা এবং পড়ার নিয়মও বিস্তারিত বলেন। রাইহা আগ্রহ নিয়ে শুনে এবং অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করে।

আজও রাইহা কৌতূহল নিয়ে ওস্তাদজিকে প্রশ্ন করে, ‘ওস্তাদজি, আয়াতুল কুরসি পড়লে কী ফায়দা হয়?’

ওস্তাদজি হাসিমুখে জবাব দেন, ‘অনেক ফায়দা আছে বেটি। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে যে, যে ব্যক্তি প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় এই পবিত্র আয়াত তিলাওয়াত করে, আল্লাহ তায়ালা তাকে সকল প্রকার বিপদ-আপদ, মুসিবত এবং অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেন। শয়তান এবং জিন-ভূতেরা তার কাছে ভিড়তে পারে না। বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর আগে এই আয়াত পড়লে সারারাত আল্লাহর ফেরেশতারা সেই ব্যক্তিকে পাহারা দেয়। কোনো অশুভ শক্তি তার ক্ষতি করতে পারে না। এছাড়াও এই আয়াত পড়লে রিজিকে বরকত হয়, মনে শান্তি আসে, এবং দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ হয়।’

ওস্তাদজি আয়াতটি তিলাওয়াত করেন, ‘আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম…’

‘এখন তুমি আমার সাথে পড়ো।’

রাইহা ধীরে ধীরে উচ্চারণ করতে শুরু করে, ‘আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুওয়াল…’

‘একটু জোরে, স্পষ্ট করে বলো। হরফগুলো ঠিকমতো উচ্চারণ করতে হবে। ‘হাইয়্যুল কাইয়্যুম’ – এইখানে ‘য়’ এর উচ্চারণটা গুরুত্বপূর্ণ।’

পড়াতে পড়াতে হঠাৎ ওস্তাদজি প্রশ্ন করেন, ‘বেগম সাহেবা আজ আসেননি কেন?’

কিছুদিন যাবৎ জুলফাও রাইহার সঙ্গে আরবি শিখছিল। প্রথমে সে এসেছিল কৌতূহল নিয়ে, পরে আগ্রহী হয়ে নিয়মিত আসতে শুরু করেছিল। ওস্তাদজিও খুশি হয়েছিলেন দুজন ছাত্রী পেয়ে। রাইহা একটু ভেবে বলে, ‘জানি না ওস্তাদজি। হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত।’

‘বেগমকে বলো, যখন উনার সুবিধা হয় তখন যেন আবার আসেন। আরবি শেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে আমাদের মুসলিম নারীদের জন্য।’

রাইহা মাথা নেড়ে জপতে শুরু করে, ‘আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুওয়াল…’

গ্রামের একটি প্রান্তে, যেখানে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ ক্ষেতের বিস্তার, সেখানে একটি বিশাল বটগাছের ছায়ায় তৈরি করা হয়েছে একটি বাঁশের মাচা। মাচাটি বেশ মজবুত করে তৈরি। পুরনো বাঁশ দিয়ে বোনা। উপরে পাটের চাটাই বিছানো। তার উপর জুলফা আর নাভেদ পাশাপাশি শুয়ে আছে।

সপ্তাহে অন্তত দুবার জুলফা বেরিয়ে পড়ে নাভেদের সাথে দেখা করতে। কখনো একা, কখনো শঙ্খিনীকে সাথে নিয়ে। আজও তেমনি একটি দিন। বেশ সুখে কাটছে তার দিনগুলো। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে শঙ্খিনী আর সেলিম। তারা দুজন নিজেদের মতো গল্প করছে। তাদের কথাবার্তার আওয়াজ খুবই মৃদু, যাতে জুলফা আর নাভেদের নিভৃত মুহূর্তে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে।

হঠাৎ জুলফা মাথা তুলে নাভেদের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘শুনুন না।’

নাভেদ চোখ ফিরিয়ে তাকায় জুলফার দিকে। প্রতিদিন দেখা হলেও আজ জুলফাকে আরও বেশি সুন্দর লাগছে। দিন দিন মেয়েটা ধারালো সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। তার মুখের আলো, চোখের উজ্জ্বলতা, ঠোঁটের হাসি সব কিছুই মুগ্ধ করার মতো। নাভেদ মাঝেমধ্যে বিস্ময় নিয়ে ভাবে, এমন মেয়ে বেদেঘরে কী করে জন্মাল? উচ্চবংশে বিয়ে হবে, সেই নিয়তি ছিল বলেই কী এমন সৌন্দর্য নিয়ে জন্মেছিল?

জুলফা শাড়ির আঁচল আঙুলে পেঁচাতে থাকে। এটা তার অভ্যাস যখন সে কিছু নিয়ে ভাবে এই কাজটা করে। আজ তার মনটা কেমন যেন আনমনা। নাভেদকে পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু কেমন একটা শূন্যতা কাজ করে বুকের ভেতর। হয়তো একটা পূর্ণাঙ্গ সংসারের জন্য। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করা, গোপনে প্রেম করা, এসব তার আর ভালো লাগছে না। নাভেদ তার অন্তরের কথা বুঝতে পেরে নরম গলায় বলে, ‘বলুন না।’

জুলফা বলে, ‘চলুন না আমরা পালিয়ে যাই। বিয়ে করি, একটা সংসার পাতি।’

নাভেদ হাতে ভর দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে জুলফার এক গাল ধরে নরম স্বরে বলে, ‘আর কয়দিন। তারপরই আমরা অনেক দূরে চলে যাব।’

‘সে তো সবসময় বলেন। কয়দিনটা কবে শেষ হবে শুনি? আর কতদিন এভাবে অপেক্ষা করব? কতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করব?’

নাভেদ তার কথা এড়িয়ে গিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে বলে, ‘আগে বলুন তো, দিন দিন এতো সুন্দর হয়ে উঠছেন কেন? সূর্যের আলোও আপনার আলো দেখে লজ্জা পেয়ে যাচ্ছে।’

জুলফার অভিমান আরও গভীর হয়ে ওঠে। তার কপালে ভাঁজ পড়ে, চোখের কোণে জমে ওঠে অসন্তুষ্টির ছায়া। সে স্পষ্ট বুঝতে পারে নাভেদ ইচ্ছে করেই তার প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিতে চাইছে না। এই ফাঁকিবাজি তার ভালো লাগে না। অভিমানে ভরে ওঠে তার মন। সে উঠে বসে। বাঁশের মাচা থেকে নেমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নাভেদ ছ্যাৎ করে ওঠে, ‘কী ব্যাপার? কিছু না বলে কোথায় চলে যাচ্ছেন?’

গলার স্বরটা খুব কঠিন শোনায়। যেন ধমক দিল! জুলফা চমকে তাকায়। নাভেদ নিজের ভুল বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নেয়। কণ্ঠস্বর খাঁদে নামিয়ে বলে, ‘আমাকে মাসখানেক সময় দিন। শুধু এক মাস। তারপর আপনি যা চাইবেন, যা বলবেন, তাই হবে। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।’

জুলফা তখনও সন্দিহান। প্রশ্ন করে, ‘সত্যি তো?’

নাভেদ তার দুই হাত জুলফার হাতের উপর রেখে বলে, ‘সত্যি। সত্যি। একশো সত্যি। আমি আপনাকে কখনো মিথ্যা বলি না। এবার দয়া করে হাসুন। এই অভিমানী মুখটা আমার ভালো লাগছে না।’

জুলফা হাসার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই হাসির আড়ালেও তার মনের গভীরে একটা প্রশ্ন ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে। বুকের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। সত্যিই কি নাভেদ তাকে বিয়ে করবে? এই প্রশ্নটা কেন জানি কিছুদিন যাবৎ তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এতকাল সে নাভেদের প্রেমে অন্ধ ছিল। তার ভালোবাসা পাবার আকুলতা ছিল সর্বস্ব। সেই চাওয়া পূর্ণ হয়েছে বলেই হয়তো এখন তার অবচেতন মন অন্য দিকে কাজ করছে। মেয়েরা তো স্বভাবসুলভভাবেই ভবিষ্যতের অনেক কিছু নিয়ে আশঙ্কা করে থাকে। বিশেষ করে যখন ভালোবাসার মানুষটির ব্যাপারে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। যদিও জুলফা এই ভাবনাটাকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে চায় না, তবুও মনের একটা কোণে সন্দেহটা বাসা বেঁধে আছে।

শঙ্খিনী ও সেলিম দূর থেকে নাভেদ-জুলফাকেই দেখছিল। শঙ্খিনী বলে, ‘একটা কথা বলি সেলিম ভাই?’

সেলিম তার স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বলে, ‘বলেন।’

শঙ্খিনী একটু লজ্জিত স্বরে বলে, ‘বেগম সাহেবাকে আবার এই কথা বলিয়েন না কিন্তু।’

‘চিন্তা করিয়েন না। আমার মুখ খুবই শক্ত।’

‘আমার কিন্তু বেগম সাহেবারে হুজুরের সাথেই ভালা লাগে। দুইজনরে একসাথে একদম রাজা-রানির মতো লাগে।’

‘ভালবাসার উপরে আর কিছুই নাই, শঙ্খিনী।’

‘একটা প্রশ্ন করি কিছু মনে করবেন না তো?’

‘করেন।’

‘আপনি কাউরে ভালবাসছেন?’

সেলিমের চোখ দুটি বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। বলে, ‘বাসছি। অনেক বাসছি। বহুবছর প্রেম করছি কিন্তু তারে পাই নাই। কপালের দোষ কি আর করা যায়।’ একটু থেমে বলে, ‘আমি যদি বলি বেগম সাহেবা নাভেদ ভাইজানরে ভালবাসে না, আপনি বিশ্বাস করবেন?’

শঙ্খিনী অবাক হয়ে হাসে, ‘ও আল্লাহ! এইটাও বিশ্বাস করতে বলেন? দেখেন না কেমন খুশি থাকে দুইজনে!’

সেলিম চোখ তুলে নাভেদ-জুলফার দিকে তাকায়।

‘আমি কী দেখতেছি জানেন?’

‘কী?’

‘বেগম সাহেবার কাছে নাভেদ বাবু একটা সুন্দর খেলনার মতো। যেমন ছোট মেয়েরা পুতুল কিনে আনে – প্রথম প্রথম অনেক আদর করে, তারপর একদিন ভুলে যায়। এইটা হলো মন ভরানো, ভালোবাসা না।’

‘যান, বিশ্বাস করি না।’

সেলিম বিরসমুখে বলে, ‘না করলে নাই।’

‘রাগ করলেন?’

‘না।’ পরক্ষণেই ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, ‘আমি খুব ভালো গান গাই। ভাইজানের বেহালার সুর আর আমার গানের মধ্যে অনেক প্রেম, এই প্রেমে কোনো মিথ্যা নাই, কোনো ভান নাই। আপনি শুনবেন?’

‘শুনি।’

সেলিম গান ধরে৷ কী অপূর্ব সেই গলা। শঙ্খিনী তো বটে, দূর থেকে নাভেদ-জুলফাও সেই গান মুগ্ধ হয়ে শুনে।

আড়তের কাঠের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে শব্দর। তার শরীরটা পাথরের মতো ভারী হয়ে উঠেছে। প্রতিটি হাড়ে গেঁথে আছে দিনভরের ক্লান্তি। ভোরের আলো ফোটার আগেই সে এসেছিল আড়তে। তারপর থেকে একটানা দৌড়ঝাঁপ। ক্রেতাদের সাথে দামাদামির কোলাহল, হিসাবপত্রের জটিল মারপ্যাঁচ, পণ্য সরবরাহের তদারকি – সবকিছুর দায়ভার তার একার কাঁধে। সন্ধ্যার মিঠে আলো জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েছে ঘরের ভেতর। দূর থেকে ভেসে আসছে মাগরিবের আজানের সুমধুর ধ্বনি।

রাত গভীর হতে না হতেই দরজার কাছে পায়ের শব্দ শোনা যায়। শব্দর আস্তে চোখ মেলে তাকায়। নাভেদ দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়, হাতে তিনতলা স্টিলের টিফিন ক্যারিয়ার। সাদা ফতুয়া আর চেক লুঙ্গিতে দেখতে বেশ ভালো লাগছে। মুখে চিরচেনা নম্র হাসি। শব্দর চেয়ারে সোজা হয়ে বসে। গলার স্বর কেমন জানি ভাঙা ভাঙা শোনায়, যখন বলে, ‘কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?’

নাভেদ ভেতরে এসে টিফিন ক্যারিয়ারটা যত্ন করে টেবিলে রাখে। ‘একটু কেনাকাটা করতে গিয়েছিলাম।’

‘বউয়ের জন্য?’ প্রশ্নটা নিজের অজান্তেই করে ফেলে।

নাভেদের গালে মিষ্টি লাজুক হাসি ফুটে ওঠে। দুটো নরম কাপড়ের ব্যাগ টেবিলের ওপর রেখে বলে, ‘জি, দুটো শাড়ি কিনেছি। কাল সকাল সকালই পাঠিয়ে দেব।’

শব্দর মনে মনে হাসে। নাভেদ কী অসাধারণ যত্নশীল একটা স্বামী! প্রায়ই এরকম ছোটখাটো উপহার কিনে স্ত্রীর জন্য পাঠায়। হাতে দু’পয়সা এলেই প্রথমে বউয়ের কথা মনে পড়ে তার।

নাভেদ টিফিন ক্যারিয়ারের তালা খুলে স্তরে স্তরে সাজানো খাবার বের করতে শুরু করে। সে আর ভূঁইয়া বাড়িতে থাকে না। ভূঁইয়াদের দক্ষিণের গুদামঘরের সঙ্গে একটা পাকা ঘর তোলা ছিল। সেখানেই সেলিমকে নিয়ে থাকে। ভারী আত্মসম্মানবোধ লোকটার!

‘সেলিম রান্না করে দিয়ে গেছে। আসুন একসাথে খাই। সারাদিন তো কিছুই খাননি।’

‘আপনি কী করে জানলেন?’

‘মনে হলো।’

শব্দর মাথা তুলে দেখতে পায় তার প্রিয় খাবারগুলো। সাদা ভাত, মুরগির ঝোল, আলুর নরম ভর্তা, আর ডিমের রসালো ঝোল। কিছুদিন যাবৎ তার খাবারে মোটেই রুচি নেই। কিন্তু নাভেদ যেভাবে যত্ন নেয় তার! খাওয়াদাওয়ার খোঁজখবর, ওষুধপত্র খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেওয়া, এমনকি রাতে ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে কিনা সেটাও দেখে। সুফিয়ানের অসুস্থতার পর নাভেদ না থাকলে শব্দর হয়তো একেবারেই হারিয়ে যেত। কিছুদিন আগে সেলিমের রান্না খেয়ে বেশ প্রশংসা করেছিল। তারপর থেকে নাভেদ মাঝে মাঝেই এভাবে খাবার নিয়ে আসে। ছেলেটা এতো মায়াবী, এতো ভালোবাসার! এমন একটা ছোট ভাই, এমন একটা সন্তান যদি তার জীবনে থাকত!

বাড়ি থেকে মনিরও খাবার নিয়ে আসে। কিন্তু শব্দর নাভেদের সঙ্গেই খেতে বসে।

খাবার খেতে খেতে হঠাৎ প্রশ্ন করে, ‘আপনার স্ত্রী নিশ্চয়ই আপনাকে খুব ভালোবাসে?’

নাভেদ অবাক হয়ে তাকায়। মাথা নত করে হেসে বলে, ‘জি, আমি বলতে পাগলপ্রায়।’

শব্দর আর কোনো কথা বলে না। তার অন্তরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তীব্র বিষাদ। জুলফা এখন আরও দূরে, আরও অধরা। সবসময়ই দূরে ছিল, এখন সেই দূরত্ব আরও প্রশস্ত হয়েছে। এই দূরত্বের যন্ত্রণা তাকে ভেতরে ভেতরে পুড়িয়ে মারছে। কয়েকবার মনে হয়েছিল জুলফা হয়তো তার দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু গত দুই মাসে সেই আশার আলো আরও ক্ষীণ হয়ে গেছে। দোষটা কী তবে তারই? সে কি ভালোবাসতে জানে না? নাভেদ একদিন অন্তর তার স্ত্রীকে মনের কথা লিখে চিঠি পাঠায়, যত্ন করে নানারকম উপহার কিনে দেয়। শব্দরও তো চেষ্টার কমতি রাখেনি! তবুও কেন জুলফার হৃদয়ের দরজা খুলছে না? জুলফা কি কখনোই তার আপন হবে না? ওই মায়াবী দুটি চোখ কি কখনো ভালোবাসার আলোয় তার দিকে তাকাবে না?

শব্দরের গলা শুকিয়ে আসে। ইদানীং সে খিটখিটে মেজাজের হয়ে গেছে। মন খারাপ করে থাকে বেশিরভাগ সময়। নিঃসঙ্গতা, ব্যবসার অসহ্য চাপ, আর শরীরের অসুস্থতা মিলে তাকে ভেতরে ভেতরে ভেঙে ফেলেছে। এখন আর সে যেচে জুলফার কাছে যায় না। ভালোবাসা পাওয়ার এই সংগ্রামে সে কেন এত তাড়াতাড়ি হেরে গেল! এ কি শুধুই বয়সের দোষ? নাকি তার কপালেই নেই ভালোবাসার স্পর্শ? মনের ভেতর হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। কোনো জবাব মেলে না।

‘আপনি ঠিক আছেন?’

শব্দর চমকে স্বাভাবিক হয়। বুঝতে পারে অনেকক্ষণ ধরেই নিরব হয়ে বসে আছে। এক লোকমা ভাত মুখে নিয়ে ভাঙা গলায় বলে, ‘হুম, একদম ঠিক আছি।’

খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর নাভেদ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। চলে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়, যেন কিছু একটা বলতে ভুলে যাচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে শব্দরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কখনো একা ভাববেন না নিজেকে। আমাকে নিজের বন্ধু ভাববেন। আমাদের বয়সের পার্থক্যটা খুব বেশি নয়, কেবল আট বছর।’

শব্দর মুচকি হেসে বলে, ‘আপনি তো বন্ধুই নাভেদ। বন্ধু না হলে কি এভাবে আমাকে, আমাদের ব্যবসাকে শক্ত হাতে ধরে রাখতেন?’

‘আসি তাহলে আজ। আপনি দয়া করে রাত জাগবেন না, বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নিন।’

নাভেদ বেড়িয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর হুড়মুড়িয়ে ঢুকে সেলিম। মাথা নত করে কুর্নিশ করে বলে, ‘মাফ করবেন। আসতে দেরি হয়ে গেল।’

সেলিম দ্রুত টিফিন ক্যারিয়ার গোছাতে শুরু করে। শব্দর তার উদ্বেগ লক্ষ করে মৃদু কণ্ঠে বলে, ‘ধীরেধীরে গোছাও।’

‘জি।’

মাথা নত রেখে টিফিন ক্যারিয়ারের সব বাটি-বাসন ঠিকঠাক করে সাজিয়ে নেয় সেলিম। আবার কুর্নিশ করে চলে যেতে গিয়ে দরজার কাছে থমকে দাঁড়ায়।

পিছনে ফিরে তাকায় একবার শব্দরের দিকে। কিছু একটা বলবে, না বলবে না, এই টানাপোড়েনে তার মুখমণ্ডল বিকৃত হয়ে উঠেছে। গলার স্বর একটু কাঁপিয়ে বলে, ‘হুজুর, মাফ করবেন। সোনাকান্দার পূর্ব দিকে ডাকাতদের খুব আনাগোনা। ওদিক দিয়ে একা বেগম সাহেবাকে নিয়ে না যাওয়াই ভালো। কিছুদিন আগে ডাকাতদের হাতে মানুষ খুন হয়েছে।’

শব্দরের ভ্রু দুটো কুঁচকে যায়। বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে সেলিমের দিকে তাকায়। বিস্ময় আর অবিশ্বাসের মিশেলে তার গলার স্বর কিছুটা উঁচু হয়ে যায়, ‘আমি তো এক বছর যাবৎ ওদিকে যাই না।’

সেলিমের চোখে তৎক্ষণাৎ বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে। এদিক-ওদিক তাকায় উদভ্রান্তের মতো। হাতের আঙুলগুলো পরস্পরের সাথে জড়িয়ে যায়। উসখুস করে বলে, ‘আজ বেগম সাহেবাকে গরু গাড়ি দিয়ে ওদিকে যেতে দেখলাম। সঙ্গে কী আপনি ছিলেন না…’ সেলিম থেমে যায়। মুখে ভয়ের ছায়া নেমে আসে। হয়তো বেশি বলে ফেলেছে। শব্দর কেমন কাঠ হয়ে যায়। মুখের রং ফ্যাকাশে হয়ে আসে।

‘তুমি হয়তো অন্য কাউকে দেখেছ।’

‘তাই হবে হুজুর।’

সেলিম কুর্নিশ করে দ্রুত বেরিয়ে যায়। বাইরে এসেই নাভেদের দিকে তাকায়। দুজনের চোখাচোখি হয়। সেলিমের মুখে একটা অর্থবহ হাসি ফুটে ওঠে।

শব্দর কারো সঙ্গে কোনো কথা না বলে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে। জুলফা কার সঙ্গে সোনাকান্দা গিয়েছে? একা নয়, কেউ ছিল সাথে — সেলিম সেটাই বুঝিয়েছে। এর কৈফিয়ত কী হবে? একটা ভয়ানক সন্দেহ তার বুকের ভেতর থাবা বসায়। হৃদয়ে অঙ্কুরিত হতে শুরু করে অস্বস্তিকর সন্দেহের বীজ।

  • ইলমা বেহরোজ
  • Related Posts

    সেদিন ও সে [পর্ব-১০]

    সূর্য ওঠার অনেক আগেই পেখমের ঘুম ভেঙে যায়। তার কপালে হালকা ঘাম, সাথে শরীর এতো নরম লাগছে যেন মনে হচ্ছে কবছর জ্বরে হুশ ছিলো না অনায়াসে; এদিকে বুকটাও কেমন ধকধক…

    প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব-০৩]

    আস্তে করে দরজা ঠেলে তিতলি উঁকি দেয় রুমের ভেতর।প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে উঠে মেহগনি উডেন ডাবল সাইড বেড।মানুষ কোথায়?চোখ ঘুরিয়ে ডান পাশে তাকাতেই সাদা এক জোড়া বল সোফা দেখতে পায়।সেখানে…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You Missed

    সেদিন ও সে [পর্ব-১০]

    সেদিন ও সে [পর্ব-১০]

    প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব-০৩]

    প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব-০৩]

    মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৩]

    মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৩]

    সেদিন ও সে [পর্ব-৮ & ৯]

    সেদিন ও সে [পর্ব-৮ & ৯]

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব-৫২]

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব-৫২]

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব-৫১]

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব-৫১]