নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব-৫১]

গ্রীষ্মের দাবদাহ কবেই হার মেনেছে আকাশভরা বৃষ্টির কান্নায়। এখন বর্ষাও ক্লান্ত৷ শেষের দিকে এসে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাধ্যমে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ধীরে ধীরে চলে যাবার জন্য। তেমনই এক ঝিরিঝিরি বৃষ্টির রাতে অরিজিত দ্রুত পা চালাচ্ছে নির্জন বাঁশবাগানের সংকীর্ণ পথে ধরে। দূরের কোনো গহীন জঙ্গল থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে শেয়ালের দীর্ঘশ্বাসমাখা হুক্কাহুয়া ডাক। মাথার উপর পরিষ্কার আকাশে চকচক করছে গোলগোল পূর্ণিমার চাঁদ। জীবনে প্রথম বৃষ্টির সঙ্গে এত সুন্দর চাঁদ দেখল। হঠাৎ পিছনে কোথাও মচমচ শব্দ হয়! পাতা নাকি কারো পা? সে থমকে দাঁড়ায়, গলা শুকিয়ে আসে। ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, কিছুই নেই। গা ছমছম করে ওঠে। ভ্রম নিশ্চয়ই! নিজেকে বুঝোনোর চেষ্টা করে, তবু মনে গুডগুড় করতে থাকে অকারণ ভয়। এইরকম হালচাল হলে অরিজিতের একটা পুরনো ফিকির আছে, সে গুনগুনিয়ে গান গায়। নিজের গলার আওয়াজ নিজের কানে এসে পৌঁছলে ভয়ডরটা একটু হলেও কমে যায়।
গান গাইতে গাইতে পৌঁছে যায় বাঁশতোলা রোডে। রাস্তার পাশে জ্বলজ্বল করা বাতির আলোয় দেখা যাচ্ছে একদিকে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে পুরনো, খানিকটা ভাঙাচোরা কয়েকটা বিল্ডিং। এগুলো ইংরেজ আমলের ঘরবাড়ি। সবগুলোতে এখানকার স্থানীয় লোকজনেরা বসবাস করে।
চোখকান খোলা রেখে চারদিকটা একবার ভালো করে দেখে সে ঢুকে পড়ে একটা সিঁদুরে গলির মুখে। গলিটা এতই সরু যে দুজন পাশাপাশি হাঁটলে হাত ঠেকে যাবে দেয়ালে। দুপাশে পুরনো ইটের দেয়াল, যেগুলোতে বর্ষার পানি ঢুকে গিয়ে কাইয়ের দাগ ফেলেছে। মিনিট চারেক এঁকেবেঁকে হাঁটার পর এসে ঠেকে একটা হলদেটে রঙের তিনতলা বাড়ির সামনে। বাড়িটার রং ঘোলাটে কমলার মতো হয়ে গেছে বৃষ্টি আর রোদে পোড়ে। নিচতলার গ্যারেজে দাঁড়িয়ে আছে একটা পুরনো গাড়ি। দেয়ালজুড়ে ছোপ ছোপ কালো সবুজ দাগ। জানালার কাঠের গরাদগুলো পোকায় কেটে ফেলেছে, কোথাও কোথাও ঝুলে পড়েছে।
আরেকবার চারপাশটা পরখ করে অরিজিত গা ঘেঁষে ঢুকে পড়ে বিল্ডিংয়ের ভেতর। ভেতরের সিঁড়িতে একটা ম্যাজম্যাজে গন্ধ। বড় বড় পা ফেলে ফেলে উঠে যায় দ্বিতীয় তলায়। করিডরটা অন্ধকার, শুধু দূর থেকে একটা বাল্বের আবছা আলো এসে পড়েছে।
শেষ ঘরটার সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় সে। হলুদ রঙা পুরনো এই বাড়ির কোণার ঘরটিই গত দুই মাস ধরে গুলনূরের গোপন আশ্রয়। সিকান্দার এখনো অধরা। তাকে ধরার সুযোগ এতদিনে একবারও মেলেনি। এরমধ্যে গুলনূর অধৈর্য হয়ে উঠেছিল। একবার তো নিজেই সিকান্দারের বাড়িতে তল্লাশি চালাতে চেয়েছিল, নওয়াজ বাহাদুর প্রাণপণে বাধা না দিলে হয়তো সেদিন বড়সড় কোনো বিপদ ডেকে আনত। আজ অবশেষে সেই বহুপ্রতীক্ষিত ক্ষণ এসেছে।
পর্দার আড়াল থেকে ঘরের ভেতর তাকিয়ে দেখে, গুলনূর বসে আছে এক কোণের টেবিলে, মাথা নুয়ে কিছু লিখছে। কাঁধ থেমে থেমে কাঁপছে। হঠাৎ সে পৃষ্ঠা দুটো ডায়েরি থেকে ছিঁড়ে দুমড়েমুচড়ে ছুঁড়ে ফেলে মেঝেতে। দুই হাতে চোখের জল মুছে প্রাণভরে শ্বাস নেয়। অরিজিত অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।
গুলনূরের চোখ পড়ে দরজার দিকে। গলা উঁচিয়ে বলে, ‘কে ওখানে?’
অরিজিত ধীরপায়ে পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢোকে বলে, ‘আমি, আপা। তৈরি তুমি?’
এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে গুলনূর। তারপর শক্ত হাতে চুল বাঁধে। টপের উপর চাপিয়ে নেয় ওভারকোট। মুখে একটুও ভাবলেশ নেই, ‘হু, চলো,’ বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
তার সঙ্গে কথা বলার মানে যেন খরস্রোতা নদীতে পাথর ছুঁড়ে শব্দ খোঁজা। এককথায় থেমে যায় সব আলোচনা। পৃথিবীর কোনো সুখদুঃখ, আনন্দবেদনা তাকে নাড়াতে পারে না। অরিজিতের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। চোখ পড়ে মেঝেতে বল পাকানো কাগজটির দিকে। কি এমন লিখছিল? কৌতুহল দমাতে পারে না। ধীরে ধীরে কাগজটা তোলে, ভাঁজ খুলে মেলে ধরে চোখের সামনে। অক্ষরগুলো চোখে পৌঁছানোর আগেই গুলনূর ফিরে এসে সেটা ছিনিয়ে নেয়। একটা কথাও না বলে চলে যায় আলমারির দিকে। কাগজটা সেখানে রেখে তালা লাগিয়ে চাবিটা ওভারকোটের পকেটে রেখে কেবল বলে, ‘চলো। দেরি হচ্ছে।’
রাত সাড়ে এগারোটা। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় গড়ে ওঠা ‘ব্লুমুন ক্লাব’এর সামনে একটা কালো গাড়ি এসে নিঃশব্দে দাঁড়ায়। পেছনের সিট থেকে সিকান্দার বেরিয়ে আসে। তার পরনে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, হাতে ঘড়ি। দেখতে যতটা পরিপাটি, চোখে-মুখে তার থেকেও বেশি অস্থিরতা। যেন কোনো অদৃশ্য শিকারি তার পিছু নিয়েছে। ক্লাবের নিয়ন সাইনের আলোয় তার মুখ নীলাভ দেখাচ্ছে। সে একবার বাঁয়ে, একবার ডানে তাকায়। রাস্তায় পার্ক করা গাড়িগুলোর মধ্যে কোনো সন্দেহজনক নড়াচড়া আছে কিনা খোঁজে।
ক্লাবের সামনে দাঁড়ানো দুজন এগিয়ে আসে। একজনের গলায় মোটা সোনার চেইন, অন্যজনের কোমরে রেডিও সেট।
‘সিকান্দার ভাই?’ মোটা চেইনওয়ালা জিজ্ঞেস করে।
‘হ্যাঁ।’
‘বস আপনার জন্য বসে আছেন। আসেন।’
ক্লাবের ভেতরে ঢুকতেই সিকান্দারের নাকে ভেসে আসে সিগারেটের ধোঁয়া আর চন্দন-পাউডারের গন্ধ। দেয়ালজুড়ে লাল মখমলের কাপড়, সিলিং থেকে ঝুলছে ঝাড়বাতি। এক কোণে ছোট মঞ্চে একজন যুবতী গায়িকা গাইছে কিশোর কুমারের গান। ‘ইয়ে জো ভাদা হ্যায়, ইয়ে জো মস্তি হ্যায়…’
হলরুমের বিভিন্ন টেবিলে বসে আছে শহরের প্রভাবশালী মুখগুলো। কেউ একা, কেউ বা তরুণীদের সাথে আড্ডায় মশগুল। বারের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছে লাল ব্লাউজ পরা একজন বারটেন্ডার, তার পেছনে সাজানো নানা ধরনের মদের বোতল।
ইলিয়াস গাজী বসে আছেন হলের একদম ভেতরের কোণে। পঞ্চাশের কোঠা কবেই পেরিয়ে যাওয়া মানুষটির পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা। গলায় আঙুল মোটা সোনার চেইন। সামনের টেবিলে রাখা হুইস্কির বোতল আর কাচের গ্লাস। সিকান্দারকে দেখতে পেয়ে ইলিয়াস হাত উঠিয়ে ইশারা করেন, ‘এদিকে আসো।’
সিকান্দার এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসে। ইলিয়াস এক গ্লাস হুইস্কি এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন কাটছে দিনকাল?’
সিকান্দার গ্লাসটা হাতে নিয়ে নিচু গলায় বলে, ‘যেমন তেমন চলছে। আপনি হঠাৎ ডাকলেন… মানে, কী ব্যাপার?’
‘ছোটখাটো ব্যাপার হলে নিশ্চয়ই ছেলের বন্ধুকে ক্লাবে ডাকতাম না?’ ইলিয়াস নিঃশ্বাস টেনে নিজের গ্লাসে চুমুক দেন। বলেন, ‘তুমি জানো, আমার ছেলে আরিশ আর ওর বন্ধুরা… সবাই একে একে খুন হয়েছে।’
সিকান্দারের হাত সামান্য কাঁপে। যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বলে, ‘জানি।’
‘খুনি এখনও ধরা পড়েনি। কিন্তু আমি জানি সে কে। আর সে তোমার খোঁজে ঘুরছে।’
‘কে?’
ইলিয়াস সামনে ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলেন, ‘আজ রাতেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
সিকান্দার অস্বস্তিতে চারদিকে তাকায়।
‘জানো তো, কেন তোমাকে এখানে ডেকেছি?’ ইলিয়াস প্রশ্ন করেন।
সিকান্দার মাথা নাড়ে। সে জানে না।
‘টোপ।’ একটা নিষ্ঠুর হাসি ফুটে ওঠে ইলিয়াসের ঠোঁটে। বলেন, ‘তুমি আজ আমার টোপ। খুনি জানবে তুমি এখানে আছো। সে আসবে। তখন আমার লোকেরা তাকে জ্যান্ত ধরবে।’
কথাটা শুনে সিকান্দারের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। তার জীবনটাকে দাবার ঘুঁটি বানানো হচ্ছে! সে ভয়ার্ত চোখে চারদিকে তাকায়। হলরুমের স্বাভাবিক আমোদ-প্রমোদ চলছে, কিন্তু তার কাছে প্রতিটা মুখ সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। প্রতিটা ছায়াকে মনে হচ্ছে একেকটা মৃত্যুফাঁদ। কাঁপা গলায় বলে, ‘আপনি… আমাকে মরণের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন।’
‘মরণের মুখে তো তুমি আগে থেকেই আছো। ভয়ে ঘরের কোণে বসে আছো। ইঁদুর-বিড়ালের মতো লুকিয়ে থাকছো। এখানে অন্তত আমার নিরাপত্তায় আছো। দ্যাখো, চারদিকে আমার ছেলেরা।’
সিকান্দার ঘাড় ঘুরিয়ে লক্ষ্য করে, বিভিন্ন টেবিলে বসে থাকা কড়া চেহারার পুরুষদের। তাদের সবার চোখ তার দিকে নিবদ্ধ। যেন একটা নিরাপত্তা বলয় তাকে ঘিরে রেখেছে। প্রত্যেকে খুনিকে শনাক্ত করার জন্য প্রস্তুত।
ইলিয়াস গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলেন, ‘চিন্তা করো না। আজকের রাতটা উপভোগ করো। ওপরে ভিআইপি রুমে ভালো সঙ্গিনী আছে।’ বলেই একটা ব্যঙ্গাত্মক হাসি দেন।
রাত বারোটার দিকে ক্লাবে ভিড় ঘনীভূত হতে থাকে। নতুন নতুন মুখের আগমন। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামছে স্ফীত পেটের মন্ত্রী, উঠছে হীরার আংটি পরা ব্যবসায়ী। কেউ পুলিশের বড় অফিসার, কেউ আন্ডারওয়ার্ল্ডের কর্তাব্যক্তি। সবার একই লক্ষ্য, রাতের অন্ধকারে নিজেদের গোপন ক্ষুধা মেটানো।
সিকান্দারের তৃতীয় গ্লাস শেষের দিকে। মাথায় হালকা ঝিম ধরেছে, কিন্তু সতর্কতা এক চুলও কমেনি। প্রতিটা নতুন প্রবেশকারীর দিকে সে ঈগলের মতো নজর রাখছে। কে সাধারণ ভোগী, কে ইলিয়াসের চর, আর কে… খুনি।
ইলিয়াস গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলেন, ‘তোমাকে বেশ অস্থির দেখাচ্ছে, সিকান্দার। চলো, ওপরে যাই। বায়ান্ন নম্বর ঘরে তোমার জন্য একটা চমৎকার মেয়ে অপেক্ষা করছে।’
সিকান্দার আতঙ্কিত গলায় বলে, ‘না, না, এখানেই ভালো। এই জায়গাটাই নিরাপদ মনে হচ্ছে।’
সে একেবারেই নিরিবিলি কোথাও যেতে চাইছে না। তার এই ভীরুতা দেখে ইলিয়াস তিক্ত হাসি হাসেন। বলেন, ‘যেমন ইচ্ছা তোমার।’
তিনি উঠে দাঁড়িয়ে সিকান্দারের কাঁধে ভরসার হাত রেখে বলেন, ‘আজ রাতেই সব শেষ হবে। খুনি আসবেই। আমি তাকে জ্যান্ত ধরব। তুমি শুধু কোনো বোকামি করো না।’
রাত পৌনে দুইটার সময় ক্লাবের প্রবেশপথে দুটি ছায়ামূর্তির আবির্ভাব ঘটে। একজন লম্বা, কালো ওভারকোট পরা, মাথায় হ্যাট টানা। অন্যজন মধ্যবয়স্ক, কালো গোঁফওয়ালা, নেভি ব্লু স্যুট পরা। দুজনেই পুরুষের বেশধারী। লম্বা ব্যক্তিটি গুলনূর। আজ তাকে চেনা দায়। ঠোঁটের উপরে কৃত্রিম গোঁফ, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। ওভারকোটের ভেতরে লুকানো একটি দেশি পিস্তল। সাথে এসেছে নওয়াজ, এই ক্লাবের একজন পুরনো মেম্বার।
দুজনে ঢুকে প্রথমে বারের কাছে গিয়ে অবস্থান নেয়। নওয়াজ স্বাভাবিক গলায় বারটেন্ডারকে বলেন, ‘দুটো হুইস্কি।’
বারটেন্ডার গ্লাস এগিয়ে দিতে গিয়ে গুলনূরের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকায়। গুলনূর তৎক্ষণাত দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।
নওয়াজ গানের ছন্দে মাথা দুলিয়ে গুলনূরকে হলরুমের দিকে ইঙ্গিত করে। ‘ওইযে, ওখানে।’
সিকান্দার কুঁকড়ে বসে আছে তার টেবিলে, নেশার ঘোরে বিভোর হয়ে। তাকে চোখে পড়তেই গুলনূরের পুরো শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে চোখে। নওয়াজ আর সে বারের পাশের একটা কৌণিক টেবিলে বসে। সামনে রাখা গ্লাসে ছোট ছোট চুমুক দিতে দিতে নিচু গলায় আলাপ করার ভান করে। পুরো মনোযোগ রাখে সিকান্দারের উপর।
নওয়াজ গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলেন, ‘এখানে অনেক লোক।’
‘নিশ্চিত, ওপরে যাবে।’ গুলনূর জবাব দেয় গলার স্বর ভারী করে, ‘নারীর লোভ ও সামলাতে পারবে না।’
ইলিয়াস গাজী ইতিমধ্যে সিকান্দারের পাশ থেকে উঠে চলে গেছেন। বয়স্ক মানুষ, গভীর রাত জাগতে অভ্যস্ত নন। যাওয়ার সময় আশ্বাস দিয়ে গেছেন, ‘ভয় নেই, আমার ছেলেরা তোমার চারপাশে আছে।’
সিকান্দার এখন একা। চতুর্থ গ্লাস প্রায় শেষ। মাথায় তীব্র ঝিমুনি। স্টেজের গায়িকা এখন গলা ছেড়ে গাইছে আরও উত্তেজক গান। তার সাথে দুইজন অর্ধনগ্ন নর্তকী কোমর দুলিয়ে নাচছে। সেই দৃশ্য দেখে সিকান্দারের শরীরে কামনার আগুন জ্বলে উঠছে। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, মদের নেশা আর নারীদেহের আকর্ষণ তাকে পাগল করে তুলছে। সে সতর্ক থাকার তাগিদ আর শারীরিক ক্ষুধার মধ্যে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মদ আর দীর্ঘ অপেক্ষার যন্ত্রণা তার বিচারবুদ্ধি ঝাপসা করে দেয়। কতদিন সে নারী সংস্পর্শ থেকে বঞ্চিত! অবশেষে কামনার জয় হয়। সে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়। পায়ে ভর নেই, মাথা ঘুরছে। তবুও সিঁড়ির দিকে এগিয়ে চলে। মদের ঘোরে তার পা দুটো যেন সুতোর পুতুলের মতো। প্রতিটি ধাপে হোঁচট খাওয়ার উপক্রম। হঠাৎ সিঁড়ির মাঝামাঝি একজন লোকের সাথে তার প্রচণ্ড ধাক্কা লাগে। লোকটি নিচে নামছিল আর সে উঠছিল। ধাক্কায় দুজনেই টাল সামলাতে হিমশিম খায়।
‘মাফ করবেন ভাই!’ লোকটি দ্রুত বলে।
ধাক্কার জোরে সিকান্দারের পকেট থেকে একটা ছোট চামড়ার ডায়েরি মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে। তাতে স্পষ্ট করে লেখা তার নাম, বাড়ির ঠিকানা আর কয়েকটি জরুরি ফোন নম্বর।
‘ভাই, এটা আপনার, পড়ে গেছে!’
লোকটি ডায়েরি হাতে তুলে নিয়ে দেখে সিকান্দার ইতিমধ্যে মদের ঘোরে উপরে উঠে গেছে। কিছুই শুনতে পায়নি। লোকটি কয়েক মুহূর্ত দ্বিধায় থাকে। ডায়েরিটা ফেরত দেওয়া উচিত। সে সিকান্দারের পেছনে পেছনে উপরে উঠতে থাকে।
দ্বিতীয় তলায় দীর্ঘ করিডোর। দুই পাশে অসংখ্য ঘর। মেঝেতে বিছানো লাল কার্পেট, দেয়ালে আবছা আলোর বাল্ব। পুরো পরিবেশটাই রহস্যময়। কখনো ভেসে আসছে নারী কণ্ঠের হাসি, কখনো নিচু গলায় কথাবার্তা। সিকান্দার একটা ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজায় করাঘাত করে।
‘কে?’ ভেতর থেকে নারী কণ্ঠ ভেসে আসে।
‘গেস্ট।’ সিকান্দার উত্তর দেয়।
ঠিক সেই মুহূর্তে পেছন থেকে পদধ্বনি ভেসে আসে। করিডোরের কার্পেটে নরম পায়ের শব্দ। সিকান্দার ঘুরে তাকায়। অন্ধকার করিডোরে একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে তার দিকে। সিকান্দারের রক্ত হিম হয়ে যায়! খুনি! নিশ্চয়ই ঘাতক তার পিছু নিয়েছে। এখানে এসে তাকে খুন করবে। আতঙ্কে সিকান্দার দ্রুত দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। লোকটি কাছে আসতেই হঠাৎ বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। দুজনে মেঝেতে গড়াগড়ি করতে থাকে।
‘খুনি! খুনি!’ সিকান্দার চিৎকার করে ওঠে। ‘কে কোথাও আছো, বাঁচাও।’
তার আর্তচিৎকারে পুরো দ্বিতীয় তলা কেঁপে ওঠে। বিভিন্ন ঘরের দরজা খুলে যায়। অর্ধনগ্ন নারী-পুরুষ বিস্ময়ে মুখ বাড়িয়ে তাকায়। নিচ থেকে দৌড়ে আসে ইলিয়াস গাজীর সশস্ত্র লোকজন। সবার হাতে পিস্তল।
‘ব্যাপার কী?’ একজন হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করে।
‘খুনিকে ধরেছি! দাঁড়িয়ে আছো কেন? ধরো একে।’ সিকান্দার উত্তেজনায় চিৎকার করছে, ‘এই লোক! এই লোক আমার পেছন পেছন এসেছিল খুন করতে!’
লোকটি একদম হকচকিয়ে গেছে। ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাসে। কোনোমতে শুধু বলে, ‘আরে ভাই, আমি তো শুধু…’
‘ওর হাতে কী?’ একজন বন্দুকধারী কড়া গলায় জিজ্ঞেস করে।
‘একটা ডায়েরি। এই ভদ্রলোকের পকেট থেকে সিঁড়িতে পড়েছিল। আমি ফেরত দিতে এসেছি।’ লোকটি কাঁপা গলায় বলে।
গুলনূর সিকান্দারকে অনুসরণ করে নীরবে উপরে উঠে এসেছিল। হঠাৎ হৈচৈ দেখে সে বুঝে যায়, পরিস্থিতি৷ চারদিক থেকে ইলিয়াসের লোকেরা ছুটে আসছে। নিশ্চয়ই ফাঁদ পেতেছে! এই মুহূর্তে প্রধান সিঁড়ি দিয়ে পালানো সম্ভব নয়। সন্দেহ করতে পারে। গুলনূর দ্রুত চারদিকে তাকায়। চোখ পড়ে ডান দিকের একটি দরজার উপর। সে দ্রুত সেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
এটা একটা বিশাল খালি হলরুম। সম্ভবত প্রাইভেট অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার হয়। এখন শুধু চেয়ার-টেবিল এলোমেলোভাবে স্তূপ করে রাখা। ঘরের অন্য প্রান্তে আরেকটা দরজা! নিশ্চয়ই বাইরে বের হওয়ার বিকল্প পথ। গুলনূর দরজার কাছে পৌঁছে হ্যান্ডেল ঘোরায়। ধাতুর ঠান্ডা স্পর্শে তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। দরজা খুলতেই সামনে দেখতে পায় একজন প্রহরীকে। মোটাসোটা গড়নের, গোঁফে ঝোপালো কালো রঙ। হাতে ধরা কালো বন্দুক বাল্বের আলোতে চিকচিক করছে।
‘কোথায় যাচ্ছেন?’ প্রহরীর গলায় সন্দেহের ধার। চোখ দুটো বিঁধে দিচ্ছে গুলনূরের মুখে।
গুলনূর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থেকে বলে, ‘একটু বাইরে যাব।’
‘এদিক দিয়ে যাওয়া নিষেধ। ফিরে যান।’ প্রহরীর হাত বন্দুকের গ্রিপে আরো শক্ত হয়। আঙুল ট্রিগারের কাছাকাছি সরে যায়।
‘দেখুন, আমার জরুরি কাজ আছে।’
গলার স্বরটা কেমন যেন মেয়েলি! প্রহরীর সন্দেহ বেড়ে দ্বিগুণ হয়। চোখ সরু হয়ে আসে। সে গুলনূরের দিকে পিস্তল তাক করে। গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কে আপনি? পরিচয় না দিয়ে এক পাও এগোবেন না।’
গুলনূর আর একটা মুহূর্তও দেরি করে না। চিতার মতো হঠাৎ ক্ষিপ্রতায় প্রহরীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুই হাতে বন্দুকের নল আঁকড়ে ধরে, পুরো শক্তি দিয়ে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
প্রহরী চমকে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘কে কোথায় আছিস রে…’
গুলনূর তাড়াতাড়ি ওভারকোটের ভেতরে হাত দিয়ে পিস্তল খোঁজে। নেই! হয়তো কোথাও পড়ে গেছে। ছুরি আছে। সে ধারালো ছুরি বের করে প্রহরীর কাঁধে তীব্র আঘাত হানে। ব্লেড মাংসে বিঁধে যায়।
‘আহহহহহ!’ প্রহরী যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে। গরম রক্ত ছিটকে পড়ে দেয়ালে, মেঝেতে। তার মুখ ব্যথায় বিকৃত হয়ে যায়। বন্দুক হাত থেকে পড়ে যায়, তবুও হার মানতে নারাজ সে। গুলনূর পালাতে গেলে জাপটে ধরে। দুজনে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। ধ্বস্তাধস্তিতে গুলনূরের মাথার হ্যাট খুলে যায়, কৃত্রিম গোঁফ খসে পড়ে মেঝেতে। কালো চুল ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে যায় পিঠে, কাঁধে। প্রহরী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। চোখ বড় বড় করে তাকায়। একি! এ তো একজন নারী!
তার অবাক হওয়ার সুযোগ নিয়ে গুলনূর পুরো শক্তি দিয়ে নাক বরাবর মুষ্টিআঘাত করে। প্রহরীর নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোতে থাকে। তবুও গুলনূরকে ছাড়ে না। একে নিস্তেজ না করে এখান থেকে যাওয়া অসম্ভব। আর কোনো উপায় নেই। গুলনূর ছুরি দিয়ে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে থাকে লোকটার বুকে, পেটে, ঘাড়ে। একটার পর একটা আঘাত। রক্ত গরম স্রোতের মতো ছিটকে যায় এদিক-সেদিক। তার নিজের চোখ-মুখও ভরে যায় লাল রক্তে।
প্রহরীর কাতরানি ক্রমশ কমে আসে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস অনিয়মিত হয়ে পড়ে। চোখ দুটো ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসে। চারপাশে নীরবতা নেমে আসে। শুধু ছুরি থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরার আওয়াজ হতে থাকে। গুলনূর নিশ্চিন্ত মনে পালাতে যাবে ঠিক তখনই দরজা খোলার শব্দ হয়। ধাতুর কিকিনি আওয়াজ বাতাসে কেঁপে ওঠে। গুলনূর চমকে তীর খাওয়া হরিণের মতো আতঙ্কে চোখ তুলে তাকায়। বিস্ফোরিত হয় চোখ দুটি!
দীর্ঘদেহী, ধারালো লম্বা মুখের মানুষটিকে দেখে মুহূর্তের জন্য তার জগৎ টলমল করে ওঠে। সময় যেন স্থির হয়ে যায়। জাওয়াদ! এ কী করে সম্ভব! ও এখানে কী করে এলো! তার বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে।
জাওয়াদও থমকে দাঁড়িয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। চোখের সামনে যে দৃশ্য, তা বিশ্বাস করতে পারছে না। গুলনূর মানুষ খুন করেছে! কী করে সম্ভব! রক্তমাখা অবস্থায় ছুরি হাতে কেমন রক্তপিপাসুর মতো দেখাচ্ছে তাকে। মুহূর্তে তার মাথা ঘুরে যায়। এ কী সত্যিই তার সেই ভীত খরগোশের ছানা? এই কি সেই গুলনূর যে তার সামনে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে রাখত? সে যেভাবে ছিল সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল, সম্পূর্ণ বিমূঢ়।
গুলনূর একবার মৃত প্রহরীর দিকে তাকায়, আরেকবার জাওয়াদের দিকে। তারপরই উঠে উল্টো দৌড়ানো শুরু করে। পায়ের নিচে প্রহরীর রক্ত পিছলে যায়। তবুও সে থামে না। জাওয়াদের হুঁশ ফিরে আসে। সেও দৌড়ায়। দুজন একটা বড় গ্যারেজে প্রবেশ করে। চারদিকে গাড়ির সারি। আবছা আলো। গুলনূর প্রাণপণে ছুটছে। তার পায়ের আওয়াজ গ্যারেজে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। জাওয়াদও ছুটছে তাকে ধরার জন্য।
গ্যারেজের শেষপ্রান্তে পৌঁছে হঠাৎই জাওয়াদ পেছন থেকে গুলনূরের কাঁধ চেপে ধরে। গুলনূর চমকে ঘুরে তাকাতে না তাকাতেই সে তাকে টেনে আনে নিজের দিকে। গুলনূর ছাড়ানোর চেষ্টা করে, জাওয়াদ তার দুই কাঁধ জাপটে ধরে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দেয় পেছনের একটা গাড়ির গায়ে। গাড়ির ধাতব গায়ে গুলনূরের পিঠ ঠেকতেই তার নিঃশ্বাস গুলিয়ে যায়। জাওয়াদ মুহূর্তেই তার মুখের দু’পাশ ধরে ফেলে। তার আঙুলের চাপে গুলনূরের গালদুটো খানিকটা ডেবে যায়।

চলবে…

 ~ ইলমা বেহরোজ

নোট ১: যেমন —
রোমিও জুলিয়েট: একটি অমর প্রেমকাহিনী — এই ধরণের টাইটেলে যেমন মূল নামের সঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত উপশিরোনাম থাকে, তেমনিভাবে নবোঢ়ার সঙ্গে আজ থেকে থাকবে, নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন” — উপশিরোনাম।

  • Related Posts

    সেদিন ও সে [পর্ব-১০]

    সূর্য ওঠার অনেক আগেই পেখমের ঘুম ভেঙে যায়। তার কপালে হালকা ঘাম, সাথে শরীর এতো নরম লাগছে যেন মনে হচ্ছে কবছর জ্বরে হুশ ছিলো না অনায়াসে; এদিকে বুকটাও কেমন ধকধক…

    প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব-০৩]

    আস্তে করে দরজা ঠেলে তিতলি উঁকি দেয় রুমের ভেতর।প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে উঠে মেহগনি উডেন ডাবল সাইড বেড।মানুষ কোথায়?চোখ ঘুরিয়ে ডান পাশে তাকাতেই সাদা এক জোড়া বল সোফা দেখতে পায়।সেখানে…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You Missed

    সেদিন ও সে [পর্ব-১০]

    সেদিন ও সে [পর্ব-১০]

    প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব-০৩]

    প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব-০৩]

    মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৩]

    মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৩]

    সেদিন ও সে [পর্ব-৮ & ৯]

    সেদিন ও সে [পর্ব-৮ & ৯]

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব-৫২]

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব-৫২]

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব-৫১]

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব-৫১]