আবার এলো যে সন্ধ্যা [পর্ব-০১]

দীর্ঘ ছয়বছর পর প্রিয় মানুষটিকে স্ত্রী সন্তান নিয়ে নিজের চোখের সামনে দেখে চক্ষু স্থির হলো নববর্ষার। প্রতিদিন যে মানুষটিকে মোবাইলের ছবিতে দেখে দেখে অভ্যস্ত আর আজ সেই মানুষটিই তার সামনে। নববর্ষার চোখদুটো ভিজে উঠলো না। এই মানুষটার জন্য কখনোই চোখ ভিজে ওঠে নি তার। তবে রক্তক্ষরণের মতো অনুভুত হয়েছে হৃদয়ে। বারংবার চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া সেই হৃদয় আজও কিন্তু দুঃখেরই প্রতীক। আজও তার ব্যতিক্রমী হলো না। চুপচাপ কয়েকপলক তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নিলো।

মানুষটা আগে চিকন ছিলো কিছুটা এবার স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটেছে বেশ। তবে এখনও আগের মতোই শ্যামলা। চশমার আড়ালে থাকা সেই মায়াময় চোখদুটোতে এখনও আগের মতোই তার অগাধ মায়া। নববর্ষা আর ভাবতে পারলো না। অন্যের স্বামীকে নিয়ে ভাবছে কেন এতো? তবে না ভেবেও কি কোনো উপায় আছে? তবে মুখ ফুটে আজ খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো,“ আপনার আড়ালে এতগুলো বছর একটা মেয়ে আপনাকে ভালোবেসে গেছে ! সেই খবর কি রাখেন আপনি?”

কথাটা কোথাও আটকেই রইলো মুখ দিয়ে আর বের হলো না। ধ্যান থেকে বেরিয়ে এলো ছোট ভাই রাহুলের কথার শব্দে।

“ দীপ্ত স্যার!ʼ

বলে হালকা উঁচুস্বরে ডাকলো সামনের মানুষটাকে। এদিকে নববর্ষার কানে বাজলো সেই নামটাই। ‘দীপ্ত স্যার!’।

ছয়বছর আগে নববর্ষা নিজেও তো নাই বললে হাজার বার ‘দীপ্ত স্যার, দীপ্ত স্যার’ করে মানুষটার ফেসবুক আইডিতে মেসেজ দিয়েছে। তবে সেই মেসেজগুলো এখনও আনসিনই রয়ে গেছে। সিন আর হয় নি। এতগুলো বছরেও দেখেছে নাকি সন্দেহ। না দেখারই কথা। তাদের কি আর সময় আছে অপরিচিত মানুষের মেসেজ দেখার! আর দেখলেও রিপ্লাই দেওয়ার কি কোনো মানে আছে নাকি? নিমিষেই মিন বিষিয়ে গেলো নববর্ষার। একটা মানুষকে ভালোবেসে এতগুলো বছর একাই কাটালো। বাড়িতে বিয়ের ব্যাপারে কথা উঠলেই সরাসরি নাকোচ করে দিতো। কি অদ্ভুত সব দিন গেছে তার জীবনে। অথচ ছয়বছর আগের একটা বছর কি সুন্দরই না ছিলো। ভাবতেই এখনও বসন্তের হাওয়া গায়ে লাগে।

“ স্যার, আমার বড় বোন বর্ষা!ʼ

ভাইয়ের এরূপ কথায় সৎবিৎ ফিরে পেলো নবর্বষা। বার বার পলক ফেলে মুখ তুলে তাকালো সামনে। মানুষগুলো এতক্ষণ কিছুটা দূরে ছিলো। কাছে কখন এসেছে? ভাবনায় এতটাই মত্ত ছিলো নববর্ষা, যে দীপ্ত আর উনার স্ত্রী সন্তান কখন এসেছে সেটাই খেয়াল করে নি।

নববর্ষা ছোট ভাইয়ের এরূপ কথায় একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,“ হ্যালো স্যার!ʼ

দীপ্ত নামক মানুষটা হালকা হেসে জবাবে বললো,“ হ্যালো নববর্ষা! আশা করি ভালো আছেন?ʼ

অদ্ভুত অনুভুতি। কণ্ঠস্বরটা একটুও পরিবর্তন হয় নি। তবে নববর্ষা ধাক্কা খেলো মানুষটা তাকে ভুলে গেছে সেটা ভেবে। নয়বছর আগের কথা কি ভুলে গেছেন নাকি উনি? নববর্ষা নাকি বেয়াদব! এতে কি মনে থাকার কথা নাকি? সে কি আর তাকে ভালোবাসে? নববর্ষা তাচ্ছিল্য হাসলো।

“ জ্বি ভালো।ʼ

চোখ পড়লো দীপ্তর কোলে থাকা বাচ্চা ছেলেটার ওপর। কি কিউট দেখতে বাচ্চাটা। এবার চোখ গেলো পাশে থাকা দীপ্তর স্ত্রীর দিকে। মেয়েটাকে চেনে নববর্ষা। দেখতে অনেক সুন্দরী। নববর্ষার মতো অসুন্দর নয়।

হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করলো। দীপ্ত আর রাহুল কথা বলছিলো। দীপ্ত বলে উঠলো,“ বৃষ্টি হবে মনে হয় রাহুল। তোমরা কি কোথাও যাবে?ʼ

“ আপু আজই ইতালি থেকে দেশে ফিরলো স্যার। বাসায় যাচ্ছি।ʼ

দীপ্ত একপলক তাকালো নববর্ষার দিকে। নববর্ষা খেয়াল করলো না তা। দীপ্ত পরপরই রাহুলের দিকে তাকিয়ে বললো,“ আচ্ছা। সাবধানে যেও।ʼ

“ স্যার আপনারাও।ʼ

দীপ্তরা বিপরীত পথে চলে গেলো। আর নববর্ষারা তাদের গাড়ির সামনে এগিয়ে গেলো। গাড়িতে ওঠার আগে একবার মাথা উঁচিয়ে তাকালো দীপ্তদের যাওয়ার পথে। যেভাবে তাকিয়েছিলো আজ থেকে সাতবছর আগেও।


নববর্ষারা গাজীপুর থাকে। মা ছোট ভাই আর নববর্ষা মিলে ছোট্ট একটি পরিবার। নববর্ষার মা একজন ডাক্তার। নববর্ষা বর্তমানে এইচএসসি পাশ করেছে। আর তার ছোট ভাই রাহুল ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়াশোনা করছে।

আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়া হয়েছে। নববর্ষা নিজের রেজাল্ট চেক করতেই দেখলো সে ঢাবিতে চান্স পেয়ে গেছে। র‍্যাংকিংও বেশ ভালো। অনায়াসেই প্রিয় বিষয়গুলো এসে যাবে।

খুশিতে নাচলো কিছুক্ষণ নববর্ষা। মা বাসায় না থাকায় ফোন করে জানিয়ে দিলো এই খুশির সংবাদ। নববর্ষার মা নীরা বেগম খুশি হলেন মেয়ের ঢাবিতে চান্স পাওয়ার সংবাদে। নববর্ষা ছোট ভাইয়ের রুমে গিয়ে ভাইয়ের গাল টেনে দিলো।

রাহুল খাচ্ছিলো। এদিকে নববর্ষা টিভি দেখছিলো তখন। টিভিতে একটা মুভি চলছিলো যেখানে নায়ক একজন সেনাবাহিনীতে কর্মরত। এটা দেখে বর্ষা রাহুলকে ডেকে উঠলো,“ রাহুল শোন!ʼ

রাহুল খেতে খেতেই বললো,“ বলো আপু?ʼ

“ জানিস? আমি যদি বিয়ে করি তবে একজন আর্মিম্যানকেই বিয়ে করবো।ʼ

রাহুল ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বললো,
“ আমাদের কলেজে মাঝে মাঝেই আর্মি আসে।ʼ

রাহুল ক্যান্টনমেন্ট কলেজে পড়াশোনা করে। উৎসুক দেখালো বর্ষাকে। রাহুলের দিকে ফিরে বলে উঠলো,“ এই তুই তাদের নাম আমাকে জানাবি।ʼ

“ কিন্তু আপু উনারা তো বেশিরভাগই বাবার বয়সী।ʼ

“ আচ্ছা থাক। আমিই একটা ম্যানেজ করে নেবো।ʼ

দুপুরের দিকে মা-কে বলে বান্ধবীদের সাথে বাইরে ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। যেই ভাবা সেই কাজ। বন্ধু নুহাশ, অনুভা, মুন আর অর্নিল মিলে দুপুরের দিকে বের হলো বাসা থেকে। এরপর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরেফিরে খাওয়া দাওয়া করে প্রায় সন্ধ্যা ছয়টার দিকে বাসায় ফেরার জন্য রওনা দিলো সবাই।

“ বর্ষা ঢাবিয়ান, মুন প্রাইভেটে ভর্তি হলো, নুহাশ সাস্টিয়ান আর অর্নিলও ঢাবিয়ান। শুধু আমিই কোথাও টিকলাম না।ʼ

অনুভার কথা শুনে মুন বলে উঠলো,
“ আরেহ সামনেই তো আরও বাকিগুলা আছে। ভালোভাবে পড়াশোনা কর।ʼ

নুহাশ ব্যাঙ্গ করে বললো,“ ওর যা লেখাপড়া।ʼ

রেগে গেলো অনুভা। তবে তাকে থামালো নববর্ষা। বললো,“ আচ্ছা বাদ দে। আমরা রিকশায় করে যাবো।ʼ

“ এই মুন তোর বাড়ি তো এখানে এখানেই। তুই চলে যা।ʼ

অর্নিলের কথা শুনে বর্ষাও বললো,“ হ্যা মুন তুই হেঁটে যেতে পারবি না?ʼ

“ একা কেমন যেন লাগে?ʼ

“ সামনেই তো ক্যান্টনমেন্ট। সামরিক এলাকা। ভয়ের কি আছে?ʼ

বেশি দূর নয় তাদের বাসা। যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলো এর কিছুটা দূরেই আবার সেনানিবাস। নুহাশ মুনের দিকে তাকিয়ে বললো,“ চল তোকে দিয়ে আসি।ʼ

মুন বাঁধা দিলো না। সবাইকে বিদায় জানিয়ে দুজন হাঁটা ধরলো সামনে। আকাশে লালাভ আভা। সূর্য ঢুবছে ধীরভাবে। কোনো তাড়া নেই তার। দিন লম্বা ইদানীং। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো বর্ষা, অর্নিল আর অনুভা। রিকশায় উঠবে। কিন্তু রিকশা আসছে না। তখনই তাদের পাশে এসে একটা সেনাবাহিনীর গাড়ি থামলো। নববর্ষার অনেক আগে থেকেই সেনাবাহিনীর প্রতি একটা দূর্বলতা আছে। কিন্তু গাড়িটা এখানে কেন থেমেছে সেটা বোধে আসলো না দুজনের। নববর্ষা উঁকি মেরে দেখলো গাড়িটায়। অর্নিল বলে উঠলো,
“ বর্ষা ভালোভাবে দেখ কে আছে।ʼ

বর্ষা বিরক্তি নিয়ে বললো,“ আমি কি চিনি নাকি?ʼ

তখনই নববর্ষাসহ বাকিদের চোখ গেলো ফ্রন্ট সিটে চশমা পড়ে আর্মি ড্রেস পরনে বসে থাকা এক আর্মিম্যানের দিকে। ব্যাজে চোখ পড়তেই দেখা গেলো দুটো স্টার। বুঝলো মানুষটা হয়তোবা লেফটেন্যান্ট। মন নেচে উঠলো নববর্ষার। অর্নিল বলে উঠলো,
“ আরেহ বাস! ব্যাটা তো লেফটেন্যান্ট।ʼ

অনুভা বললো,“ আস্তে বল গাধা। শুনতে পাবে।ʼ

এরই মাঝে একটা রিকশা আসলো সেখানে। অনুভা নববর্ষাকে টেনে তুললো। অর্নিলও উঠলো। তবে রিকশায় উঠে বসেও ঘাড় এলিয়ে একবার পেছনে ফিরে দেখতে ভুললো না নববর্ষা। সিনেমাটিক ভাবে চুল উঁড়লো তারও। নেম ট্যাগে স্পষ্টভাবে দেখতে পেলো না জ্বলজ্বল নামটা। অর্নিলকে তাড়া দিয়ে বললো,
“ ওই শালা নাম দেখ।ʼ

অর্নিল চশমা ঠেলে নামটা দেখতে চাইলো। ভ্রু কুঁচক এলো। এতদূর থেকে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না। তবুও বলে উঠলো,“ দীপ্ত!”

  • Junani CH
  • Related Posts

    সেদিন ও সে [পর্ব-১০]

    সূর্য ওঠার অনেক আগেই পেখমের ঘুম ভেঙে যায়। তার কপালে হালকা ঘাম, সাথে শরীর এতো নরম লাগছে যেন মনে হচ্ছে কবছর জ্বরে হুশ ছিলো না অনায়াসে; এদিকে বুকটাও কেমন ধকধক…

    প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব-০৩]

    আস্তে করে দরজা ঠেলে তিতলি উঁকি দেয় রুমের ভেতর।প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে উঠে মেহগনি উডেন ডাবল সাইড বেড।মানুষ কোথায়?চোখ ঘুরিয়ে ডান পাশে তাকাতেই সাদা এক জোড়া বল সোফা দেখতে পায়।সেখানে…

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You Missed

    সেদিন ও সে [পর্ব-১০]

    সেদিন ও সে [পর্ব-১০]

    প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব-০৩]

    প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব-০৩]

    মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৩]

    মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৩]

    সেদিন ও সে [পর্ব-৮ & ৯]

    সেদিন ও সে [পর্ব-৮ & ৯]

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব-৫২]

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব-৫২]

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব-৫১]

    নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব-৫১]