সবুজ রঙের শাড়িটির অনেকাংশ ভিঁজে গেছে। কাগজের প্যাকেটটা আধছেঁড়া হয়ে পরে আছে ফ্লোরে। চেয়ার টেনে সেখানে শাড়িটি মেলে দিলো হৈমন্তী। অগোছালো বিছানা টান টান করে বিছালো। তুষার ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে এলো তখন। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
—“শাড়ি ভিঁজে গেছে?”
হৈমন্তী একবার তুষারের মুখপানে তাকালো। জবাব দিলো,
—“হু। একটু।”
পরপরই আলমারির দিকে এগোলো সে। দু’পাশের লম্বাটে দরজা টান দিয়ে খুললো। হাত এগিয়ে রঙ-বেরঙের শাড়িগুলো কয়েক সেকেন্ড ছুঁয়ে দেখল খুব যতনে। এরপর আনমনেই বললো,
—“এ দু’একদিনে কতগুলো শাড়ি হয়েছে আমার! আপনি দিয়েছিলেন ছয়টা। মা দিয়েছেন তিনটা। এখন আবার একটা আনলেন। মোট দশটা শাড়ির মালিক আমি।”
হৈমন্তীর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ঠোঁটে ফুটে উঠলো মুচকি হাসি। টের পেল, তুষার কাছাকাছি চলে এসেছে তার। ঘাড়ে উষ্ণ নিশ্বাসের অস্তিত্ব পাচ্ছে সে। হঠাৎ কোমড় আঁকড়ে কাঁধে থুতনি ঠেকালো তুষার। শাড়ির ভাঁজ গলিয়ে খুব গভীরে যেতেই বরাবরের ন্যায় কেঁপে কেঁপে উঠলো হৈমন্তী। তুষার চমৎকার হাসলো। প্রশ্ন করলো,
—“শাড়িগুলো না ধুঁয়ে দিয়েছিলেন? শুকিয়ে গেছে?”
হৈমন্তী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারলো না। আড়ষ্টতায় ক্ষীণ মিইয়ে গেল। মৃদু আওয়াজে বললো,
—“সকালের কড়া রোদেই শুকিয়ে গিয়েছিল। এবার সরুন।”
তুষার নাকচ করে বললো,
—“ভালো লাগছে আমার। সরতে পারব না।”
বলে একটু থামলো সে। তারপর আবার প্রশ্ন করলো,
—“আমি তো এখন আপনার আপনজন হৈমন্তীকা। ভীষণ আপন মানুষ। তবুও আপনি আমাকে আপনি বলে ডাকেন কেন?”
হৈমন্তী তখন উলটো প্রশ্ন করে,
—“আপনি কেন আমাকে আপনি বলে ডাকেন?”
তুষার সময় না নিয়ে উত্তর দেয়,
—“কারণ আপনাকে আপনি বলে ডাকতে আমার ভালো লাগে। আপনি ডাকটায় আমি ভালোবাসা খুঁজে পাই হৈমন্তীকা। আপনাকে নিজের মাঝে ভীষণ ভাবে অনুভব করতে পারি।”
—“আমিও এজন্যই আপনাকে আপনি বলে ডাকি। ডাকটা আমারও ভীষণ প্রিয়। এবার সরুন। নয়তো আমি কিন্তু এখন সত্যি সত্যি বকব।”
তুষার ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। হাতের বাঁধন শক্ত করে বললো,
—“বকুন। আমি ছাড়ছি না আপনাকে।”
—“আমি কিন্তু দরজা লাগাই নি।”
—“সমস্যা নেই।”
—“সরুন, তুষার।”
তুষার শুনলো না। হঠাৎ-ই কেমন গম্ভীর হয়ে উঠল। নিষ্পলক কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে কাঁধে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,
—“দিন দিন এত সুন্দর হচ্ছেন কিভাবে হৈমন্তীকা? আপনার রুপে আমার চোখ ঝলসে যাচ্ছে।”
হৈমন্তীর নিশ্বাস থেমে গেল যেন। শরীর অবশ হয়ে এলো। তুষার আবারও বললো,
—“ভালোবাসি আপনাকে হৈমন্তীকা।”
বিকালের প্রথম ভাগ মাত্র। রান্নাঘরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে এটা-ওটা এগিয়ে দিচ্ছে হৈমন্তী। তাওয়ার আধকাঁচা ঝাল পিঠাগুলো উল্টে দিয়ে হেনা বললেন,
—“গরমের মধ্যে শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন হৈমন্তী? গরম লাগছে না? ফ্যানের নিচে গিয়ে কিছুক্ষণ বসো আসো। যাও!”
হৈমন্তী নিচু গলায় বললো,
—“অভ্যেস আছে মা। তাছাড়া এখন তো বর্ষাকাল। ভালোই লাগছে এখানে।”
হেনা হাসলেন। দুধ উতরানো কেতলিতে তিন চামচ চা-পাতা দিয়ে বললেন,
—“জানো, আমার তুষারটাও না তোমার মতো। ছোট বেলায় আমি রান্না করলে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। এখন তো ওর বাবার জন্য আমার ওপর চাপা অভিমান করে আছে। তবে ঠিকই মায়ের খবরাখবর নিতে চলে আসে। কখনো ভুলে না। আমার হাতের চা ছাড়া ওর চলেই না। দেখবে, একটু পর চায়ের জন্য চেঁচামেঁচি শুরু করে দেবে।”
বলে আবারও মুখ ভরে হাসলেন হেনা। কি মায়াময় সেই হাসি! কি স্নিগ্ধ! হৈমন্তীর মন হঠাৎ-ই খারাপ হয়ে গেল। রাবেয়া যখন রান্না করতেন, হৈমন্তীও তো তখন এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতো। সে নিজে রান্না করলে তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে উপদেশ দিতে দিতে কাহিল বানিয়ে দিতেন রাবেয়া। উনারও তো হয়তো হৈমন্তীর কথা মনে পড়ে। তখন কি তার মা তার জন্য কাঁদে? হেমন্তর কি আপুর জন্য মন খারাপ হয় না? বাবার কি মেয়ের কথা ভেবে অভিমান ভুলতে ইচ্ছে করে না? ওরা কেউ কি মনে করে তার কথা? হৈমন্তীর তো করে। এই যে, এখন করছে। বিষাদে বুক ভারি হচ্ছে। যন্ত্রণা সইতে না পেরে বেরিয়ে আসছে একেকটা দীর্ঘশ্বাস।
সরব হেনার ডাকে সম্বিৎ ফিরলো তার। তিনি কাপে চা ঢালতে ঢালতে ভীষণ গর্বের সঙ্গে বললেন,
—“দেখেছ? ডাক শুরু হয়ে গেছে ওর।”
হৈমন্তীর কান সজাগ হলো এবার। ড্রইংরুম থেকে তুষারের হাঁক শুনতে পাচ্ছে সে। চায়ের জন্য রীতিমতো মরিয়া হয়ে উঠছে তুষার। হেনা চায়ের কাপটা হৈমন্তীকে দিয়ে বললেন,
—“চা টা একটু দিয়ে আসো তো মা।”
হৈমন্তী মাথা দুলালো। ধীর পায়ে ড্রইংরুমে এগোতেই দেখল, সোফায় আরাম করে বসে বিরক্ত ভঙ্গিতে টিভির চ্যালেন পাল্টাচ্ছে তুষার। হৈমন্তী আরোও দু’কদম এগিয়ে তুষারের কাছাকাছি দাঁড়ালো। টেবিলে চায়ের কাপ রেখে ঢিমে যাওয়া গলায় বললো,
—“আপনার চা।”
তুষার চায়ের কাপ নিলো। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
—“আপনার কি মন খারাপ হৈমন্তীকা? কেউ কিছু বলেছে?”
জবাবে মাথা দুলিয়ে না জানালো সে। তুষার আরও কিছু বলবে, তার পূর্বেই কলিংবেল বেজে উঠলো। বিরতিহীন, লাগাতার ভাবে। রহিমা খালা সদর দরজা খুলতেই ফুঁসফুঁস শব্দে ভেতরে প্রবেশ করলেন আফতাব সাহেব। ড্রইংরুমে হৈমন্তীকে দেখে মাথার রাগগুলো যেন দপ করে জ্বলে উঠলো। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে একবার হৈমন্তীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে হেনাকে ডাকলেন তিনি। হেনা দৌঁড়ে এলেন সেকেন্ড পেরোতে না পেরোতেই। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই তেঁতে উঠলেন আসরাফ সাহেব,
—“কার জন্য তুমি রাতে আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিলে হেনা? এই মেয়েটার জন্য? এই মেয়ের কারণে আমি এখন বাহিরেও বেরুতে পারছি না। পাড়াপ্রতিবেশি তো ছাড়ো! বিল্ডিংয়ের দারোয়ান পর্যন্ত আমাকে জিজ্ঞেস করছিল ছেলের বউয়ের কথা। আমি কেন ছেলেকে বয়সে বড় মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছি? লোকে ছিঃ বলছে হেনা। ভাবতে পারো ব্যাপারটা আমার জন্য কতটা অপমানজনক?”
কথাগুলো বলে হাপাতে লাগলেন তিনি। বার্ধক্যের দরুণ জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিলেন। বাবার অভিযোগ তুষার চুপচাপ শুনলো। প্রতিবারের মতো শান্ত কণ্ঠে ভয়ংকর একখানা কথা বলতে নিলেই কাঁধের শার্ট খামচে ধরে মানা করলো হৈমন্তী। মুখ নুইয়ে খুব ধীর গলায় উচ্চারণ করলো,
—“বাবা।”
আফতাব সাহেব থমকালেন। নিমিষেই শান্ত হয়ে চমকে যাওয়া নজরে তাকালেন। হৈমন্তী নম্র গলায় আবার বলতে লাগলো,
—“আপনাকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি বাবা। আমি চাই আপনি আমাকে মেয়ের মতো ভালোবাসুন। কিন্তু আমি….”
আরও কিছু বলার পূর্বেই তিনি গটগট পায়ে চলে গেলেন সেখান থেকে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে গমগমে গলায় বললেন,
—“বেশি বাড়াবাড়ি পছন্দ নয় আমার। নিজের সীমার মধ্যে থাকো।”
হৈমন্তী বিহ্বল চোখে উনার যাওয়ার পথে চেয়ে রইলো। তুষারের দিকে তাকিয়ে দেখলো, সেও কপাল কুঁচকে চেয়ে আছে। আচ্ছা, জেদি বাপ-ছেলে কি এমনই হয়?
কাল রাতের মতো আজকেও বর্ষণের দেখা মিললো পৃথিবীতে। তুষারও টিউশন থেকে ভিঁজে ভিঁজে এলো রাত ৮টার সময়। এসেই একপলক হৈমন্তীর দিকে তাকালো সে। তবে মুখে কিছু বললো। গটগট পায়ে চলে গেল ওয়াশরুমে।
আগের দিনের তুলনায় আজ ঝড়ের তান্ডব বেশি। যার দরুণ লোডশেডিং হচ্ছে। একবার দু’বার লাইট অন অফ হতে হতে একসময় একদমই বন্ধ হয়ে গেল রুমের সাদা ঝকঝকে বাতি। হৈমন্তী আঁতকে উঠলো। অন্ধকারে চোখে কিছুই ধরা দিচ্ছে না।
ওয়াশরুম থেকে তুষারের গলা শোনা গেল,
—“হৈমন্তীকা?”
প্রায় তৎক্ষণাৎ সে জড়োসড়ো গলায় জবাব দিলো,
—“আমি কিছু দেখতে পারছি না তুষার।”
—“ফোনের লাইট জালান হৈমন্তীকা। সাথে আছে ফোন?”
হৈমন্তী কোনোমতে “হুম।” বলে আন্দাজে বিছানা হাতড়ালো। একটু ডানে হাত নিতেই পেয়ে গেল ফোন। প্রাণে প্রাণ এলো যেন। তুষার আবার বললো,
—“বেডসাইড টেবিলের প্রথম ড্রয়ারে দেখুন মোমবাতি আর লাইটার আছে।… পেয়েছেন?”
কথা মতে ঠিক তা-ই করলো হৈমন্তী। পেয়ে যেতেই প্রফুল্ল কণ্ঠে বললো,
—“পেয়ে গেছি।”
এরপর আর তুষারের গলা শোনা গেল না। একটু পর সে নিজেই বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম হতে। এক হাতে ভেঁজা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে হৈমন্তীর কাছে আসলো। প্রশ্ন করলো,
—“ভয় পেয়েছিলেন?”
শুনে বোকা হাসলো হৈমন্তী। জবাব দিলো না। মোমবাতির হলুদ, কমলা মিশেল আলো সরাসরি পরছে তার স্নিগ্ধ, অবুঝ মুখখানায়। তুষারের চোখ আটকে গেল। প্রবল আকাঙ্ক্ষায় তীর্থ হলো মন, মস্তিষ্ক। নিষিদ্ধ ইচ্ছে জেগে উঠলো খুব গোপনে। শুকনো ঢোক গিললো সে। নেত্রজোড়া সরাতে নিয়েও পারলো না। হঠাৎ কি যেন হলো! হৈমন্তীকে হুট করে কোলে তুলে নিলো সে। বিছানায় শুইয়ে কাছে আসতে নিলেই বুকে আলতো ধাক্কা দিলো হৈমন্তী। ভীতু গলায় বললো,
—“কি করছেন?”
ওপাশ থেকে উত্তর এলো,
—“কিচ্ছু না।”
পরপরই নিজের অধরে অধৈর্য অধরের স্পর্শ পেতেই স্তব্ধ হয়ে গেল সে।
চলবে,…


![প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব-০৭]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/07/photo_6212761625384044921_y.jpg)
![মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৮]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/10/3cf51236-2d29-45c2-a963-4d58a217fde2.jpg)
![নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব ৫৮]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/05/IMG_20250529_231033.jpg)
![সেদিন ও তুমি [পর্ব-০২]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/09/a-simple-light-colored-t-shirt-and-je.jpg)
![মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৭]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/07/srthgerf.jpeg)