কড়া রোদে আশপাশ খা খা করছে। কারেন্টের তারে চুপচাপ বসে আছে কালো কুচকুচে একঝাঁক কাক। মাত্র গোসল সেরে এসেছে তারা। শরীর ঝাঁকিয়ে দেহের সমস্ত পানি ঝেড়ে ফেলতে চাইছে বারংবার। হৈমন্তী ঘরের এককোণে থাকা টেবিলটা পরিষ্কার করছিল। ইদানিং পড়াশোনা সব লাঠে উঠেছে তার। টেবিলের ধারের কাছেও ঘেঁষে না সে। ফলস্বরুপ, টেবিলের জায়গায় জায়গায় ধুলোবালি বিরাট আস্তানা গেড়ে রেখেছে। উপরের তাকটা পরিষ্কার করতেই কোত্থেকে হন্তদন্ত পায়ে উপস্থিত হলো হেমন্ত। কণ্ঠে হাজারো ভয় আর উত্তেজনা নিয়ে চেঁচালো,
— “আপু? বাবা কেমন যেন করছে। কথা বলতে পারছে না। বিছানায় শুয়ে কেমন কাতরাচ্ছে…”
এটুকু শুনে উত্তেজিত হলো হৈমন্তীও। দ্রুত বাবার রুমে ছুটতে ছুটতে বললো,
— “মা বোধ হয় ছাদে হেমন্ত। মাকে ডেকে আন। আমি বাবার কাছে যাচ্ছি।”
হেমন্ত ছাদের উদ্দেশ্যে দৌঁড় লাগালো। বাবার রুমে প্রবেশ করতেই হৈমন্তীর নজর প্রথমেই আসরাফ সাহেবের ঘর্মাক্ত মুখখানায় আটকালো। পুরো শরীর ঘেমে একাকার উনার। সটান হয়ে শুয়ে কেমন হাসফাস করছেন। হৈমন্তী দৌঁড়ে বাবার মাথার কাছটায় হাঁটু গেড়ে বসল। দু’হাতে উনার একহাত চেপে ধরে আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— “কি হয়েছে বাবা? এমন করছো কেন? খারাপ লাগছে?”
আসরাফ সাহেব মেয়ের দিকে ঝাপসা চোখে তাকালেন। কণ্ঠ যেন অচল তার। বহু কষ্টে থেমে থেমে অস্পষ্ট স্বরে বললেন,
— “বুকে কষ্ট হচ্ছে মা। খুব কষ্ট হচ্ছে।”
হৈমন্তী আরও ব্যস্ত হয়ে পরলো। আসরাফ সাহেবকে উঠানোর চেষ্টা করে বললো,
— “একটু কষ্ট করে উঠার চেষ্টা করো বাবা। আমরা হাসপাতালে যাবো।”
আসরাফ সাহেব প্রায় অজ্ঞান। তাকে উঠাতে গিয়ে হৈমন্তী টের পেল, তার শক্তি ফিকে পরে যাচ্ছে। শত চেষ্টা করেও উনাকে উঠাতে পারছে না। এদিকে রাবেয়া এসেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিয়েছেন। নিরুপায় হৈমন্তী হেমন্তকে বললো,
— “পাশের বাসার আঙ্কেল আছে কি-না দেখে আয় হেমন্ত। উনাকে ডেকে আন।”
— “উনারা নেই আপু। আসার সময় দেখে এসেছি আমি। দরজায় তালা মারা।”
‘বিপদে যখন আসে সবদিক থেকেই আসে’ — প্রবাদটি একদম সত্য মনে হলো হৈমন্তীর। বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। কি করবে বুঝতে করছে না। মস্তিষ্ক একদম শূণ্য! হঠাৎ তুষারের কথা মনে পরলো তার। একবার ফোন করবে কি? চটজলদি রুমে গিয়ে ফোন হাতে নিলো সে। তুষারের নম্বরে ডায়াল করলো। দু’বার রিং হতেই রিসিভ হলো ওপাশ থেকে। তুষার প্রথমেই নরম স্বরে ডাকলো, “হৈমন্তীকা?”
এতক্ষণ শক্ত হয়ে থাকা হৈমন্তী যেন নিমিষেই গুড়িয়ে গেল। নিশ্বাস ঘন হলো তার। চোখ থেকে গড়িয়ে পরতে লাগলো বিন্দু বিন্দু জল। অশ্রুসিক্ত গলায় সে বললো,
— “বাবা কেমন করছে তুষার। আমি বুঝতে পারছি না কি করবো। আপনি প্লিজ তাড়াতাড়ি আসুন। আমার ভীষণ ভয় লাগছে।”
ওপাশে অসহ্য রকমের নীরবতা। সে চুপচাপ শুনছে হৈমন্তীর কান্নার শব্দ। খানিক্ষণ পরেই উত্তর এলো, “আমি আসছি, হৈমন্তীকা।”
_____
আসরাফ সাহেবকে কেবিনে নেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত গরমে হার্ড এট্যাক করেছে তিনি। কেবিনের সামনে লাল, নীল, হলুদ রঙের ছোট্ট চেয়ারগুলোর একটিতে চুপচাপ বসে আছে হৈমন্তী। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে। ভেতরটা হাহাকারে চিৎকার করছে বারবার। তুষার মাত্র ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে এসেছে। নিঃশব্দে হৈমন্তীর পাশে বসলো সে। অনেক্ষণ কিছু বললো না। নির্নিমেষ চেয়ে রইলো প্রিয়তমার লালচে মুখপানে। পরক্ষণেই আস্তে আস্তে হৈমন্তীর হাত নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো। কোমল স্বরে আওড়ালো,
— “কান্না চেপে রেখেছেন কেন হৈমন্তীকা? বুকে আসুন। ভেতরকার কষ্টে ভিঁজিয়ে দিন আমার বুক।”
হৈমন্তীর কি যেন হলো। এক অক্ষরও অমান্য করলো না কথার। ঝাপিয়ে পরলো তুষারের প্রশস্ত বুকে। তুষার সযন্তে আগলে ধরলো প্রিয়তমাকে। ছোট্ট মাথাটা চেপে ধরলো বুকের বা’পাশটায়। হৈমন্তী কেঁদেই গেল। যতক্ষণ না কষ্ট কমলো ঠিক ততক্ষণ কাঁদলো। ফাঁকা ফ্লোরের অল্প কিছু নার্স আর রোগী অবাক চোখে দেখতে লাগলো ওদের।
কান্না থামলো বেশ কিছুক্ষণ পর। আলতো হাতে হৈমন্তীর আঁখিজোড়া মুছে দিলো তুষার। বললো,
— “আঙ্কেলকে দেখে আসুন হৈমন্তীকা। যান!”
হৈমন্তী বাধ্য মেয়ের মতো মাথা দুলালো। কেবিনে গিয়ে বাবার পাশে দাঁড়াতেই শক্ত মুখে অন্যদিকে ফিরে তাকালেন তিনি। হৈমন্তী বিস্মিত হলো। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— “কি হয়েছে বাবা? মুখ ফেরালে কেন?”
আসরাফ সাহেব জবাবহীন। সে আরেকবার জিজ্ঞেস করতেই দূর্বল গলায় ধমক দিয়ে উঠলেন,
— “এত অপমান, লাঞ্চনার পরও তুই কিভাবে ঐ তুষার ছেলেটার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিস? লজ্জা করলো না তোর? দরকার হলে আমি মরে যেতাম। তবুও কেন ওই ছেলেকে সাহায্যের জন্য ডাকলি তুই? আর কোনো মানুষ ছিল না?”
আসরাফ সাহেব থামলেন। হৈমন্তী অসহায় চোখে মায়ের দিকে চাইলো। তিনি নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন। সে কাঁপা গলায় বলতে নিলো,
— “বাবা…”
আসরাফ সাহেব বলতে দিলেন না সম্পূর্ণ কথা। কাঠকাঠ গলায় আবার বললেন,
— “ভাববি না ওই ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে কখনো দেব আমি। এক্ষুণি ওর সাথে সব যোগাযোগ বিছিন্ন করবি তুই। তোর পরীক্ষা শেষ হলেই নাওয়াজের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিবো আমি। যদি না মানতে চাস, তাহলে বাবাকে ভুলে যা আজীবনের জন্য।”
গলায় কথা দলা পাকিয়ে গেল হৈমন্তীর। কিছু বলতে পারল না। একবার করুণ নয়নে বাবাকে দেখে কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেল সে। চেয়ারগুলোর দিকে নজর যেতেই দেখল, তুষার নেই এখানে। আশেপাশে তাকিয়েও তুষারের দেখা মেললো না। হৈমন্তী বেদনাদায়ক এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এগিয়ে গিয়ে শরীরের ভর ছেড়ে দিলো চেয়ারে।
–
এর আধাঘণ্টা পরই কোত্থেকে এক কাগজ নিয়ে হৈমন্তীর পাশে ধপ করে বসে পরলো তুষার। কাগজ আর কলম এগিয়ে দিয়ে বললো,
— “এখানে সাইন করুন হৈমন্তীকা।”
হৈমন্তী পিটপিট করে তাকালো। তুষারের মুখশ্রী গাম্ভীর্যে ভরপুর। কণ্ঠস্বরও গম্ভীর ভীষণ। সে প্রশ্ন ছুড়লো,
— “কি এটা? সাইন করবো কেন?”
তুষার আগের ন্যায়ই বললো,
— “হাসপাতাল থেকে দিয়েছে। সাইন করুন।”
হৈমন্তী কিছু না বলে কাগজটা পড়তে নিলেই ধমকে উঠলো তুষার,
— “পড়তে বলিনি আপনাকে হৈমন্তীকা। সাইন করুন!”
হৈমন্তী বিমূঢ় হলো। স্তব্ধ হয়ে তাকালো। বলতে চাইলো, “পড়লে কি অসুবিধে…?”
— “বেশি কথা বলছেন হৈমন্তীকা। সাইন করুন। দেড়ি হচ্ছে আমার।”
একরাশ দ্বিধা নিয়ে সাইন করে দিলো হৈমন্তী। সাইন করার সময় খেয়ালে এলো, পাশে টি(T) দিয়ে আরও একটি সাইন করা। হয়তো নার্স তুষারকেও বলেছে সাইন করতে। সাইন করার সাথে সাথেই কাগজটা ছিনিয়ে নিলো তুষার। তার অদ্ভুদ আচরণে হতবিহ্বল হৈমন্তী তখন আরও একবার প্রশ্ন করলো,
— “এবার তো বলুন, এটা কিসের কাগজ? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেন সাইন করতে বলেছে? পড়তে দিন আমাকে।”
— “এটা রেজেস্ট্রি পেপার ছিল।”
তুষারের এক বাক্যে থমকে গেল হৈমন্তী। চোখ বড় বড় করে চেঁচিয়ে উঠলো, “কি বলছেন এসব? মাথা ঠিক আছে আপনার?”
এতক্ষণে তুষারকে শান্ত দেখালো। এগিয়ে এসে হৈমন্তীর গলায় কপাল ঠেকালো সে। ঢিমে যাওয়া স্বরে বললো, “আমি ক্লান্ত, হৈমন্তীকা।”
চলবে,…


![প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব-০৭]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/07/photo_6212761625384044921_y.jpg)
![মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৮]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/10/3cf51236-2d29-45c2-a963-4d58a217fde2.jpg)
![নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব ৫৮]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/05/IMG_20250529_231033.jpg)
![সেদিন ও তুমি [পর্ব-০২]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/09/a-simple-light-colored-t-shirt-and-je.jpg)
![মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৭]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/07/srthgerf.jpeg)