রোদের কিরণ তেছরাভাবে পরছে হৈমন্তীর মুখে। জ্বলজ্বল করছে রাগান্বিত আঁখিজোড়া। কাঁপতে থাকা ওষ্ঠ নাড়িয়ে হৈমন্তী বললো,
— “কোন সাহসে আপনি ইভানকে মেরেছেন?”
তুষারের সহজ সরল জবাব,
— “ও আপনার ক্ষতি করতে চাইছিল হৈমন্তীকা। আপনাকে কষ্ট দিতে চাইছিল! আমি সহ্য করতে পারি নি সেটা।”
— “কি সহ্য করতে পারেন নি? ইভান টাইমপাস করলে আমার সঙ্গে করতো। ক্ষতি করতে চাইলে সেটা আমি দেখব। আপনি কেন আগ বাড়িয়ে মারামারি করতে যাবেন? আমার সব বিষয়ে আপনাকে কে চিন্তা করতে বলেছে?”
— “আমিই তো চিন্তা করব হৈমন্তীকা। আপনি সংক্রান্ত সবই তো আমাকে ঘিরে।”
হৈমন্তীর রাগের তেজ বাড়লো। বক্ষস্থলে সৃষ্টি হলো এক বিরক্তিকর অনুভূতি। কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— “দূরে থাকবেন আমার থেকে। আপনাকে যেন আমি আমার ত্রিসীমানায়ও না দেখি।”
— “সম্ভব না।”
— “কি সম্ভব না? আপনাকে কিছু বলি না দেখে বেশি বাড় বেড়েছেন আপনি। আজই আপনার বাবাকে আপনার এসব কর্মকান্ডের কথা বলে দেব আমি। পিঠে চার পাঁচটা ঘা পড়লেই মগজ ঠিক জায়গায় চলে আসবে।”
ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো হৈমন্তী। চলে যেতে উদ্যোগী হতেই তৎক্ষণাৎ শক্ত বাঁধনে তার হাত ধরে ফেলল তুষার। হৈমন্তী চোখ রাঙিয়ে তাকায়। হাত ছাড়াতে নিলেও পারে না। তুষারের দিকে আবার তাকাতেই তুষার তার শান্ত, শীতল কণ্ঠস্বরে আওড়ায়,
— “আমি ভয় পাচ্ছি না হৈমন্তীকা। বিশ্বাস করুন, এসবের মোটেও ভয় নেই আমার। ভয় আছে শুধু আপনাকে হারিয়ে ফেলার। আপনি যা ইচ্ছে তাই করুন। আমি বাঁধা দেব না। তবে আপনার পিছুও ছাড়বো না কোনোদিন। সেটা আপনার যতই অপছন্দ হোক।”
কথাটুকু বলে হাতের বাঁধন ঢিলে করে দিলো সে। হৈমন্তী এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে রোষপূর্ণ দৃষ্টি মেলে ধরল তুষারের নিষ্প্রভ মুখপানে।
___________
মাগরিবের আযান দিয়েছে।
হৈমন্তী নামায পড়া শেষে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। মনটা বড্ড অশান্ত হয়ে আছে তার। মাথায় শুধু তুষার নামক ব্যক্তিটির কথা ঘুরছে। এমন আধপাগল মানুষ দু’টো দেখে নি সে। এতটা জেদি কেন ছেলেটা? ভাবতেই বিরক্তি যেন আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেল তার সর্বত্র জুড়ে। তারওপর পায়েও জ্বালা করছে ভীষণ। তাড়াহুড়ো করে কাজ করতে গিয়ে পায়ে কাঁচের ফুলদানি পড়ে গেছে। ফুলদানি তো ভেঙ্গেছেই, সঙ্গে তার পায়ের কোণাও কেঁটে গেছে কিছুটা। রাবেয়া সেই যে এ নিয়ে বকা শুরু করেছেন! এখনো থামেন নি।
হৈমন্তীর এখন একটু শান্তিপূর্ণ জায়গা প্রয়োজন। যা ছাদ ছাড়া কোথাও নেই। রুমে গিয়ে গায়ে ওড়না জড়িয়ে নিলো হৈমন্তী। রাবেয়া সোফায় বসে টেলিভিশন দেখছিলেন তখন। সদর দরজার কাছে যেতে যেতে হৈমন্তী বলে উঠলো,
— “মা, আমি ছাদে যাচ্ছি। একটু পরে চলে আসবো।”
রাবেয়া পেছন থেকে হাঁক দিয়ে উঠলেন, “দাঁড়া।”
হৈমন্তী দাঁড়ালো। নিজ মায়ের দিকে তাকাতেই তিনি বেশ রাগী গলায় বলে উঠলেন,
— “এমনি তো তোকে ছাদে পাঠাতে পারি না। এই সন্ধ্যাবেলায় আসছিস ছাদে যেতে! পায়ের কি অবস্থা দেখেছিস? রুমে গিয়ে বিশ্রাম কর যা!”
হৈমন্তী চোখ-মুখ কুঁচকে বললো,
— “উফফ মা! রুমে ভালো লাগছে না। একটু পরে চলে আসবো বলেছি তো!”
হৈমন্তী আর দাঁড়ালো না। এক ছুটে চলে গেল ছাদের উদ্দেশ্যে। ওদিকে রাবেয়া ডাকতেই রইলেন তাকে।
__________
চারিদিকের নির্মল বাতাসে নিজেকে মুক্ত পাখির ন্যায় মনে হচ্ছে হৈমন্তীর। দারুণ ভাবে অশান্ত মনটা শান্ত হয়ে গেছে নিমিষেই। আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে নিলো সে। লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে কিছুক্ষণ স্থীর হতেই হঠাৎ মনে হলো, তার পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। তড়িৎ গতিতে চোখ মেলে পাশে তাকালো হৈমন্তী। তুষার দু’হাত রেলিংয়ের ওপর রেখে, বুক ভর করে নিমেষহীন দেখছে তাকে। হৈমন্তী চমকালো। চোখ বড় বড় করে চাইলো। তুষার আরও কিছু সময় চেয়ে থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো এবার। লহু স্বরে বললো,
— “কপালের চুলগুলো কানে গুঁজে নিন উদাররাণী। আমি গুঁজে দিলে তো আপনি রাগ করবেন।”
হৈমন্তী ভ্রু কুঁঞ্চিত করে তাকালো। অবুঝের মতো কপালে পরে থাকা চুলগুলো কানে গুঁজে জিজ্ঞেস করলো,
— “উদাররাণী, মানে?”
— “আপনার নামের অর্থ উদার, মনোযোগী, বন্ধুত্বপূর্ণ। অথচ এসবের কিছুই আপনার মধ্যে নেই।”
বড্ড আফসোসের সঙ্গে শেষের কথাটা বললো তুষার। হৈমন্তী তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। খেয়ালে এলো, কপালের বিকালের বেন্ডেজটা এখনো খুলে নি তুষার। বেন্ডেজের আশেপাশে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত লেগে আছে। সে চট করে তুষারের হাতের দিকে তাকালো। বাম হাতটা বেন্ডেজ করা। পরনে ছাই রঙা টি-শার্ট আর থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট। মুখটা কেমন মলিন হয়ে আছে। সরব তুষার করুণ স্বরে বলে উঠল,
— “ভালোবাসি হৈমন্তীকা। কেন বোঝেন না?”
— “আপনি সুধরাবেন না কখনো, তাই না তুষার? আমারই দোষ! বারবার আপনাকে সুযোগ দিচ্ছি। আপনার বাবাকে কিছু বলছি না। কিন্তু আর না। এবার আমি সত্যিই আপনার বাবাকে বলে দেব তুষার।”
তুষার দূর্বোধ্য হাসলো। হৈমন্তীর দিকে এক পা এগোতেই আরও দু’পা পিছিয়ে গেল হৈমন্তী। এতে হাসি আরও গাঢ় হলো তুষারের। হুট করে পায়ে ভর দিয়ে নিচে বসে পরলো সে। হৈমন্তীর পায়ে ইশারা করে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
— “পা কাঁটলো কিভাবে হৈমন্তীকা?”
— “আপনাকে কেন বলবো? উঠে দাঁড়ান, আর দূরে সরুন।”
তুষার কানে নিলো না সেকথা। ডান পায়ের হাঁটু মেঝেতে লাগিয়ে বসলো। অত্যন্ত গাম্ভীর্যের সঙ্গে হৈমন্তী ক্ষতগ্রস্ত পা নিজের উরুতে নিয়ে আলতো ভাবে হাত বোলালো ক্ষত স্থানে। হৈমন্তী কেঁপে উঠল। অতি দ্রুত হওয়ায় সে বুঝতে পারে নি কি হচ্ছে। সম্বিৎ ফিরতেই পা সরিয়ে নিতে চাইলো সে। তুষার দিলো না। শক্ত বাঁধনে আটকে রাখলো।
হৈমন্তী রেগে গেল,
— “পা ছাড়ুন তুষার! অসভ্যতামি করছেন কেন?”
তুষার ক্ষীণ আওয়াজে উত্তর দিলো,
— “আপনাকে ভালোবাসা আমার সবচেয়ে প্রিয় অসভ্যতামি, হৈমন্তীকা।”
_______________
চলবে…


![প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব-০৭]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/07/photo_6212761625384044921_y.jpg)
![মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৮]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/10/3cf51236-2d29-45c2-a963-4d58a217fde2.jpg)
![নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব ৫৮]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/05/IMG_20250529_231033.jpg)
![সেদিন ও তুমি [পর্ব-০২]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/09/a-simple-light-colored-t-shirt-and-je.jpg)
![মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৭]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/07/srthgerf.jpeg)