তুষারের চিন্তায় ঘুম আসছে না হৈমন্তীর। ছেলেটার পাগলামি দিন দিন বাড়ছেই। এমতাবস্থায় হৈমন্তীর কি করা উচিত? চড়, থাপ্পড়, অপমান, কিছুই তো বাকি রাখে নি সে। তবে হ্যাঁ, তুষারের বাবাকে নালিশ দিলে কিছু একটা হতে পারে হয়তো। কিন্তু হৈমন্তীর মন সায় দেয় না এতে। তুষারের জন্যে অদ্ভুদ মায়া হয়। মতিভ্রষ্ট হয়ে কিভাবে মরিচীকার পিছু ছুটতে ছেলেটা! তুষার যা চায় তা কি আদৌ সম্ভব? হৈমন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঘুম আর আসবে না তার। মাথা ভীষণ ব্যথা করছে। এখন একটু কড়া চা খেলে মন্দ হয় না। যেই ভাবা সেই কাজ! রান্নাঘরে গিয়ে চা বানিয়ে আনলো সে। মুক্ত বাতাসের মাঝে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।
বিল্ডিংটা পাঁচ তলা। হৈমন্তীর পরিবার দু’তলায় থাকে। আর তুষাররা থাকে তিন তলা। হৈমন্তীর বারান্দার সঙ্গে তুষারের রুমের বারান্দা উপর-নিচ লাগানো। হৈমন্তী যখন চা খাচ্ছিল তখন হঠাৎ উপর থেকে তার চায়ের কাপে ছোট্ট একটা পাথর টুপ করে এসে পরলো। ফলসরুপ কাপে থাকা কিছু চা ছিটকে পরলো তার হাতে। সূক্ষ্ণ ব্যথায় অল্প চেঁচিয়ে উঠল হৈমন্তী। দ্রুত কাপটি টেবিলে রেখে ফু দিতে লাগলো হাতে। তখনি আবারও একটা ছোট্ট পাথর এসে পরলো তার বারান্দার মেঝেতে। তবে এবারের পাথরটা ভিন্ন। পাথরের গায়ে মোড়ানো রয়েছে একটি হলুদ রঙের কাগজ। হৈমন্তী এগিয়ে গেল সেদিকে। কাগজটা নিয়ে খুলতেই চমৎকার হাতের লেখা ভেসে উঠল তার সামনে,
‘দুঃখীত হৈমন্তীকা। আমি ইচ্ছে করে ফেলি নি পাথরটা। আপনি কি বেশি ব্যথা পেয়েছেন?’
লেখাটা পড়ে ভড়কে গেল হৈমন্তী। উপরে উঁকি দিতেই দেখতে পেল তুষারকে। তার মতো করে সেও বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ভড়াকানো গলায় ক্ষীণ স্বরে হৈমন্তী বলে উঠল,
— “আপনি এখানে কি করছেন? আর এগুলো কি ধরণের বেয়াদবি? কাপে পাথর ফেলেছেন কেন?”
— “আমি তো সরি বলেছি হৈমন্তীকা। চাইলে এন্টিসেপ্টিকও দিতে পারি। রুমে আছে, দিব?”
— “লাগবে না আপনার এন্টিসেপ্টিক। কালকে না আপনার ক্লাস আছে? এত রাতে না ঘুমিয়ে এখানে কি করছেন?”
— “একই প্রশ্ন তো আমিও করতে পারি। আপনি এত রাতে না ঘুমিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন কেন হৈমন্তীকা?”
হৈমন্তীর কপালে সূক্ষ্ণ ভাঁজ পরলো। কণ্ঠে তেজ এনে বললো,
— “আমার যা ইচ্ছে আমি করবো। আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে কেন? যান, রুমে গিয়ে ঘুমান।”
ওপাশ থেকে একরোখা উত্তর, “যাবো না।”
রাগে হৈমন্তীর নাক কাঁপতে শুরু করলো। ছেলেটা এত ঘাড়ত্যাড়া! তুষারের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছেই মিইয়ে গেল তার। টেবিল থেকে কাপ উঠিয়ে ক্ষীপ্ত কণ্ঠস্বর ছুঁড়ে দিলো,
— “আপনি থাকুন! আমিই চলে যাচ্ছি!”
তুষার রেলিং গলিয়ে খানিক ঝুকল। হৈমন্তীর যাওয়ার দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে ম্লান হাসলো মাত্র।
_____________
পরেরদিন ছিল রবিবার। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস হতে এখনো ১ঘন্টা বাকি। হৈমন্তী আজ একটু তাড়াতাড়িই চলে এসেছে ভার্সিটি। সাথে রয়েছে তার প্রিয় বান্ধবী পারু। তারা দুজনে মিলে ক্যান্টিনে বসে ছিল। স্যান্ডউইচ খেতে খেতে পারু বেশ আহ্লাদী স্বরে বললো,
— “তোকে যে ছেলেটা পছন্দ করে… কি যেন নাম?”
হৈমন্তী আগ্রহহীন ভাবে জবাব দিলো, “তুষার।”
— “ও হ্যাঁ তুষার। ছেলেটা কি এখনো তোর পেছনে ঘুড়ে?”
— “হ্যাঁ।”
— “কিছু বলিস নাই?”
— “কালকে চড় মেরেছিলাম ডান গালে।”
শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালো পারু। কণ্ঠে একরাশ বিস্ময় ঢেলে বললো,
— “ডাইরেক চড় মেরে দিলি? এত সুন্দর একটা পোলারে চড় মারতে তোর বুক কাঁপলো না হৈমন্তী? তুই এত পাষাণ? আমি হইলে তো কবে হ্যাঁ বলে দিতাম। ছেলেটার কপালটাই আসলে খারাপ! তোর মতো দজ্জাল মহিলাকে পছন্দ করছে!”
হৈমন্তী চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো। বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে উঠল,
— “তুই আমার বন্ধু নাকি ওর? ওর এত গুণগান গাইছিস কেন? এ বিষয়ে আর একটা কথাও বলবি না পারু। ওর নাম যেন তোর মুখে আর না শুনি!”
পারু স্যান্ডউইচে অল্প কামড় দিয়ে ঠোঁট উলটে বললো,
— “এভাবে বলছিস কেন?”
— “চুপ থাক!”
পারু সত্যি সত্যি চুপ হয়ে গেল এবার। আর একটা কথাও বললো না।
কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরই হৈমন্তী জিজ্ঞেস করল,
— “কয়টা বাজে পারু?”
— “৯ টা চল্লিশ। তোমাদের ক্লাস তো একটু পরেই তাই না?”
পারু কিছু বলবে, তার আগে আগেই পেছন থেকে পুরুষালী কণ্ঠে কেউ বলে উঠল কথাটা। হৈমন্তী ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো। অচেনা এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে তাদের একটু দূরেই। সে এগিয়ে আসলো এবার। অনুমতি ছাড়াই হৈমন্তীর পাশের চেয়ারে বসে পরলো। এক হাত এগিয়ে হৈমন্তীর উদ্দেশ্যে বললো,
— “আমি ইভান। তোমার এক বছরের সিনিয়ার। কেমন আছো?”
আকস্মিক এমন ঘটায় বিব্রতবোধ করল হৈমন্তী। হাত না মিলিয়েই ম্লান হেসে বললো,
— “জি ভালো আছি। আমি আসলে আপনাকে ঠিক চিনলাম না। আপনি কি আমাকে চিনেন?”
হাত না মেলানোয় খানিক অপমান বোধ করলো ইভান। তবে মুখে তা প্রকাশ পেল না। হাত গুটিয়ে স্বাভাবিক হেসেই বললো,
— “জুনিয়রদের সব খবরাখবর থাকে আমাদের কাছে। তুমি আমাকে চেনো না রাইট? সমস্যা নেই। কিছুদিন যাক। চিনে যাবে।”
কথাটা কেমন যেন লাগলো হৈমন্তীর। পছন্দ হলো না। তবুও ভদ্রতা রক্ষার্থে ক্ষীণ হাসলো সে। ইভানের একটা বন্ধু তাকে ডাকতেই সে বিদায় জানিয়ে চলে গেল। হৈমন্তী হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন! সুদীর্ঘ শ্বাস ফেলে পাশে তাকাতেই ভয়ে মাথা পিছিয়ে নিলো। তার পাশে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুষার। তাকিয়ে আছে তো তাকিয়েই আছে! চোখের পলক ফেলেছে না একদমই। হৈমন্তী বুকে হাত রেখে বড় বড় নিশ্বাস নিলো। হুট করে তুষারকে দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। একটু শান্ত হতেই রাগী গলায় বললো,
— “সমস্যা কি আপনার? এমন ভূতের মতো চলাফেরা করেন কেন?”
সেকথার জবাব দিলো না তুষার। উলটো গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, “ছেলেটা কে?”
— “মানে?”
— “একটু আগের ছেলেটা কে?”
— “আপনাকে কেন বলবো?”
টেবিল থেকে পানির বোতল নিলো তুষার। আলতো চুমুক দিয়ে কাঠাকাঠ ভাবে বললো,
— “আমার হবু বউয়ের ওপর লাইন মারছিল সে, হৈমন্তীকা! আর আমার জানা লাগবে না ছেলেটা কে?”
_______________
চলবে…


![প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব-০৭]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/07/photo_6212761625384044921_y.jpg)
![মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৮]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/10/3cf51236-2d29-45c2-a963-4d58a217fde2.jpg)
![নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব ৫৮]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/05/IMG_20250529_231033.jpg)
![সেদিন ও তুমি [পর্ব-০২]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/09/a-simple-light-colored-t-shirt-and-je.jpg)
![মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৭]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/07/srthgerf.jpeg)