‘আই থিংক ইউ স্যূড মুভ অন!’
এই কথাটা শুনে অনেকটা সময় থমকে তাকিয়ে রইল পেখম তারপর দৌড়ে যেয়ে নওশিরের হাত ধরে। নওশির তাকায়। ফর্সা মুখটা কেনো যেনো লাল হয়ে আছে। তা দেখে আরেকটু ভরকে এলো পেখম। তবুও নাক টেনে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না।’
‘অতীত যন্ত্রণা ছাড়া কিছুই দেয় না। তাই বর্তমান নিয়ে ভাবতে হয়! এবং নিজেকে ভালো রাখার জন্য যতটুকু করা যায় তা করা উচিত।’
কথাটা বলেই নওশির নিজে থেকে হাত ছাড়িয়ে রুমে চলে যায়। পেখম অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। কথায় গভীর একটা ভাবনা দিয়ে গেলো পেখমকে। পেখমকে এখনো সৌজন্যেকে ভালোবাসে? নাকি সে এখনো মুভ অন করতে পারেনি!? কিন্তু সে মুভ অন করতে চায়। খুব করে চায় নতুন ভাবে জীবন শুরু করতে।
একটা শ্বাস ফেলল তারপর নিজের রুমে যেয়ে নরম পায়ে ধীরে ধীরে অনেকটা সময় পায়চারী করল। তারপর নিজের চিন্তাভাবনা শান্ত করে পকেট থেকে ফোন বের করল। এখন ভালোই রাত তবুও পেখম জানে পল্লবী বেগম এখনো ঘুমায়নি। তাই নিজপর শ্বাস আটকে কল ডায়াল করল পল্লবী বেগমের নম্বরে। খানিকবাদেই কলটা রিসিভ হতেই পেখম সরাসরি বলল,
‘সৌজন্যের জামিনের ব্যবস্থা করে দেও।’
চকমায় পল্লবী। ভরকানো গলায় শুধায়,
‘কি বলছো?’
‘যা শুনেছ তাই। ওর জামিনের ব্যবস্থা করো আমি দুইদিনের মধ্যে বাসায় ফিরছি।’
কথাটা বলেই সে কল কেটে দেয়। পল্লবী বেগম ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকটা সময়। মেয়োটার আবার কি হলো? আবারো ফোন বেজে উঠল। পল্লবী ফোনের দিকে তাকালো। পেখম আবারো কল দিয়েছে। সময় ব্যয় না করে কল রিসিভ করল পল্লবী। পেখম কল রিসিভ হতেই বলল,
‘ সাথে ডিভোর্স পেপার রেডি করো।’
‘আবার কিসের?’
‘বিয়েটা যেহেতু আমার সাথে হয়েছে। সিগনেচার টাও আমার করা লাগবে। আশা করি তুমি হেল্প করবে। আর আমার মতামতের সম্মান করবে। আর টেনশন করো না, আমি ঠিক আছি।’
আবারো কলটা কেটে যায়। পল্লবী বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর মনে মনে দোয়া করল, এইবার মেয়ের কোনো কিছুতে নাক গলাবে না। মেয়ে যা করতে চায় ভালো জিনিস গুলোতে সে কোনো বাঁধা সৃষ্টি করবে না। এই সব ভুল তো তার জন্যই হয়েছে!
——
তিনদিনের মাথায় পেখম বাসায় ফেরত আসে। আসার সময় নওশিরকে কিছুই বলে আসে নি। না তার সামনে পড়েছে। তিনটা দিন কেটেছে কটেজের রুমে, এক প্রকার বন্দিনী অবস্থায়! পেখমের কেনো যেনো নওশিরের সামনে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। তাই হয়তো এই লুকোচুরি খেলা।
কটকট শব্দ করে জেল গেট খুলে গেলে, সাথে সাথেই যেন আবারো এক টুকরো নিস্তব্ধতা চারপাশে ঘিরে ধরে নির্জল জয়গাটায়। জেলেখানার গার্ড কাগজ চেক করে মাথা নাড়ে; তারপর বলল,
“জামিন হয়ে গেছে।”
সৌজন্য ধীরে পা ফেলে বাইরে আসে। তার চোখে কিছুটা ক্লান্তি, কিছুটা বিস্ময়, আর একরাশ অভিমান। কিন্তু যেই মুহূর্তে সে বাইরে এসে দাঁড়ায়, তার চোখ আটকে যায় সামনের সাদা কুর্তি-পাজামা পরা মেয়েটির ওপর। পেখম খুবই নির্জীব ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সৌজন্যের এক মুহূর্তের জন্য যেন নিঃশ্বাস থেমে যায়। মেয়েটা স্থির দাঁড়িয়ে আছে। মুখে কোনো আবেগ নেই। পানির মতো স্বচ্ছ চোখ। সৌজন্য চুপচাপ কিছু সময় তাকিয়ে থাকে। তারপর এগিয়ে এসে ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করে,
“আরেকবার ভাবলে হতো না?”
পেখম এখনও নীরব অধিভক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে। কথা বলল না। তাই সৌজন্য ফের শুধায়,
“তুমি… এটা কেন করলে?”
পেখম সোজা তাকায় না। একটু মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“কারণ আমার সিদ্ধান্ত। আপনার পাপের শাস্তি নিয়তি দেখে নেবে। এখানে আপনাকে আটকে রেখে আমার লাভ কোথায়! আনিয়ার সাথে থাকার জন্য পারমানেন্ট ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আপনার তো আরো খুশি হবার কথা।”
সৌজন্যের চোখ ভিজে ওঠে। ঠোঁট কাঁপে, এতোগুলো দিন আনিয়া তাকে দেখতে পর্যন্ত আসেনি। সে তার শিক্ষা যেন এমনিইতেই পেয়ে গেছে। তাই সে একটু দম নিয়ে বলল,
“আমি জানি… আমি অন্যায় করেছি। আমি তোমার বিশ্বাসভঙ্গ করেছি। অথচ তুমি… আমায় ভালোবেসেছিলে। আর আমি… সেই বিশ্বাসের ঘরেই আ গুন ধরিয়েছি।”
পেখম চোখ ঘুরিয়ে তাকায় না। অন্যদিকে নজর রেখেই তাচ্ছিল্যতার সাথে বলল,
“বিশ্বাসভঙ্গের আ গুনে আমার আত্মা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন শুধু নিজেকে জুড়ে নিতে চাই। সেখানের আপনার কোনো অস্তিত্ব আর না থাকুক!”
সৌজন্যের কণ্ঠ ভারী হয়ে আসলো, আর বলল,
“আমি জানি আমি কি হারিয়েছি। আমি জানি এই অনুশোচনা কোনোদিন কমবে না। তুমি হয়তো আমাকে ক্ষমা করবে না, তবু এখন প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে নিজেকে ঘৃণা করি। তোমার মতো মেয়ের চোখে সেই ঘৃণা দেখে বেঁচে থাকা, এটাই আমার শাস্তি।”
পেখম এবার ধীরে তাকায়, তবে সে চোখে করুণা নেই। আছে খানিক স্থিরতা সেভাবেই নির্বিকার গলায় বলল,
“আপনার শাস্তি আমি ঠিক করে দিয়েছি, সৌজন্য। এই মুক্তি হয়তো আপনার জন্য না,আমার জন্য। এবার আমি বাঁচতে চাই, নিজের মতো।”
সেই কথা বলে পেখম এক পা পেছনে সরে যায়। আর সৌজন্য দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকার গেটের আলো-ছায়ায়। একটু দূরে এসে থমকায় পেখম তারপর চোখের জল টুকু মুছে নিয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়ে বলল,
“শেষ বারের জন্য একটু জড়িয়ে ধরতে চাই আপনাকে! আপনি কি মাইন্ড…
কথা শেষ হবার আগেই সৌজন্যে জড়িয়ে ধরল পেখমকে। পেখম হাত তুলে ধরল না। শুধুই নিরবে দাঁড়িয়ে রইল। সৌজন্যে কান্না করে উঠল শব্দ করে, তারপর বলল,
“পেখম, আমায় ক্ষমা করে দেও। আমি আর এমন করব না। ওয়ার্ল্ড বেস্ট হাজবেন্ড আর পাপা হয়ে দেখাবো।”
নিরব রইল পেখম। কিন্তু চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল। পেখম একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
“ওয়ান্স এ চিটার, অলওয়েজ এ চিটার; সৌজন্য।”
কথাটা বলেই তাকে নিজের থেকে সরিয়ে দিলো পেখম। তারপর একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
“আপনার কথা মনে পড়লে কষ্ট হয়। তবে ইট’স ওকে। সামনের দিনের জন্য শুভকামনা।”
কথাটা বলেই সেখান থেকে চলে যায় পেখম। সৌজন্যে রাস্তায় বসে পড়ল, চিৎকার করে কান্না করছে সৌজন্য। এই ক’মাসে তার এতোটুকু বোঝা হয়ে গেছে পেখম ইজ দ্য ওয়ান।
পেখম চলে যেতেই পাশে আলো-ছায়ায় থাকা একটা গাড়ির দরজা খুলে কেউ একজন উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো।
—
মাঝে কেটে গেলো আরো চারটা দিন। রাতের বেলায় পল্লবী বেগম পেখমের রুমে এসে পেখমকে ডেকে ডেকে বাহিরে নিয়ে এলো। বাহিরের ড্রইংরুমে সৌজন্য বসে আছে। পেখম কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। এগিয়ে এসে সোফায় বসতেই টেবিলের উপর রাখা ফাইল থেকে কিছু কাগজ বের করে রাখে পল্লবী বেগম। চুপচাপ বসে থাকে সবাই, সৌজন্যের খালা মুখ তুলে পেখমের দিকে তাকাচ্ছে না, হয়ত অনুশোচনায়। সৌজন্য আর পেখম বসেছে মুখোমুখি।
পেখম কাগজের দিকে তাকায়। প্রথম পাতায় নিজের নাম দেখে থেমে যায়। কলম তুলে নেয়। তারপর গভীর এক নিশ্বাস ফেলে সই করে দেয়। সৌজন্য মুখ তুলে তাকায়, চোখ ভিজে উঠেছে। চুপচাপ কাউকে তোয়াক্কা ছাড়াই পেখমকে বলল,
“এখন আমার প্রতিটা রাত আমার কাছে আ গুনের মতো লাগে পেখম। প্রতিটা সকাল তোমার না থাকা দিয়ে শুরু হয়। আমি চাই যদি পারো… আর একটিবারের জন্য আমায় মাফ করে দিও… একটু ভেবে দেখো! নিজের জন্য না, আমার জন্য…।”
পেখম সই করতে করতে বিনা প্রতিক্রীয়ায় বলল,
“আপনি আমার ভালোবাসাকে অপমান করেছেন। এখন আপনার অনুশোচনা আমার জীবনে কোনো প্রভাব ফেলবে না। এই সম্পর্কটাকে আমি সম্মান দিয়েছিলাম, আর আপনি সেটা ভেঙে দিয়েছেন। এখন আমি শুধু মুক্তি চাই।”
সই শেষ করে উঠে দাঁড়ায় পেখম। সৌজন্যও উঠে দাঁড়ায় আর পেছন থেকে বলল,
“মনে হচ্ছে তোমার পায়ের নিচে আমার সব অনুতাপ চাপা পড়ে যাচ্ছে।”
পেখম পা থামায় নি শুধু হেটে যেতে যেতে ঠোট বাঁকায়, তারপর ধীরে ধীরে নিজের রুমের দরজার দিকে এগিয়ে যায়। নিঃশব্দে রুমে প্রবেশ করে রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। পেছনে পড়ে থাকে ড্রইরুমেরসবার মাঝে একটা গম্ভীর শূন্যতা। সৌজন্য আবারো ধপ করে বসে থাকে সেই শূন্যতার পাশে, নিজের ভাঙা অস্তিত্ব হাতে নিয়ে, সে শুধু ঠাকায় নি। নিজের কাছে নিজেই ঠকাছে চরম ভাবে! সামনে হয়তো তাকে আরো ঠকতে হবে! কে জানে! দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেঝেতে তাকিয়ে রইল সাথে মনে হলো কেউ হাহাকার করে বলল, প্রেমের ভুলে সম্পর্ক মরেও যায় না, বেঁচে থাকে অনুশোচনায়। পেখম মুক্ত, সৌজন্য বন্দি… আর তারপর আবারো ভাগ্যের খেলা। এখন পেখম মুক্ত… দেখা যাক ভাগ্য পেখমকে কোথায় নিয়ে যায়! কি আছে তার ভাগ্যে…।”
চলবে…


![প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব-০৭]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/07/photo_6212761625384044921_y.jpg)
![মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৮]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/10/3cf51236-2d29-45c2-a963-4d58a217fde2.jpg)
![নবোঢ়া: আগুনফুলের আত্মনিবেদন [পর্ব ৫৮]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/05/IMG_20250529_231033.jpg)
![সেদিন ও তুমি [পর্ব-০২]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/09/a-simple-light-colored-t-shirt-and-je.jpg)
![মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৭]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/07/srthgerf.jpeg)