বাসায় ফেরার সময় সারা রাস্তা নির্জন হয়ে ছিলো। পাহাড়ি লোকেরা ওদের রাখতে চেয়েছিলো তবে নওশির থাকবে না তা পেখম জানে তাই ইনিয়েবিনিয়ে বলে কয়ে তারা বিদায় নিয়ে এসেছে। তবে রাস্তায় এতো নির্জনতা দেখে পেখম ভীষণ ভীতু হয়ে আছে। সে মনে মনে ভাবছে যদি কোনো প্রাণী কিংবা অসৎ লোকেরা হামলা করে বসে। নওশির বোধহয় তার মনের এমন ভাবনা টের পেলো তাই পেখমের মন অন্য দিকে মনোযোগ নেবার জন্য প্রথমে মৃদুস্বরে কেশে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এতেই কাজ হলো পেখম নওশিরের দিকে তাকালো। নওশির একটু সময় নিয়ে বলল,
‘আমি বাংলাদেশে কি করছি জানতে চেয়েছিলেন তাই না?’
‘হু?’
‘একটা মেডিক্যাল ভার্সিটিতে ইনভাইটেড প্রফেসর। ছমাসের জন্য আমি এটায় থাকব। যদি আমার এখানে ভালো লাগে তবে আমি পার্মানেন্ট হবার জন্য এপ্লাই করতে পারব!’
অবাক চোখে তাকায় পেখম তারপর জিজ্ঞেস করল,
‘কোন মেডিক্যাল?’
‘একটা প্রাইভেট মেডিক্যাল।’
‘ওহ!’
কেনো যেন নাম জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো না পেখমের তাই চুপ রইল। খানিক সময় পর কি একটা মনে পড়তেই পেখম ফের প্রশ্ন করল,
‘আমার ডিভোর্স হয়েছে এই ব্যাপারে আপনি জানলেন কি করে?’
নওশির নিরুত্তর। কিয়ৎক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল,
‘এক্সিডেন্টের পর কতটা সময় লেগেছে রিকোভারি করতে?’
অবাক হয়ে পেখম জানতে চাইল।
‘কিসের এক্সিডেন্ট?’
একটু গলায় পরিষ্কার করল নওশির তারপর বলল,
‘আপনার জীবনের সব থেকে বড় এক্সিডেন্ট! প্রথম থেকে বলুন।’
এবার পেখমের পা থামে। তারপর সরাসরি নওশিরের দিকে তাকায়। পেখম থামতেই নওশিরও থেমে দাঁড়িয়ে যায়। পেখম সরাসরি শুধায়,
‘আপনি ঠিক কি জানতে চাইছেন, কাইন্ডলি বলবেন?’
ঢোক গিলল নওশির। মেয়েটাকে বোকা? হ্যাঁ, বোকাই তো। এতো কাছাকাছি তবুও কিছু বোঝে না! আর বাঁধা গুলো তো আছেই। তবুও লম্বা একটা শ্বাস টানল তারপর বলল,
‘এই দেশে ফেরার পর বিয়ে! এবং তারপর…!’
থমকালো পেখম। তারপর ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,
‘হাটতে হাটতে বলি?’
‘বলুন!’
‘আমরা দেশে ফেরার পর পর নানুমনি মারা যায় আর আম্মু যেহেতু নানুমনির একটাই মেয়ে তাই সব কিছু তার নামেই। তারপর আম্মুর সাথে বিজনেস এর থ্রু থেকে আম্মুর ছোটবেলার ফ্রেন্ড মানে সৌজন্যের খালার দেখা হয়! তিনি আর আম্মু শেয়ার হোল্ডারে নতুন বিজনেস শুরু করে। যদিও দেখাশোনা আন্টির হাসবেন্ড করত। তারপর আমিও এদেশে এসে আম্মু একটা কলেজে ভর্তি করায়। আমার ইন্টার কমপ্লিট করে আবারো মেডিক্যাল ট্রাই। মাঝে অসুস্থ হওয়ায় পাবলিকে পরিক্ষা দিতে পারিনি তাই আম্মুর কাছে যথেষ্ট অর্থ থাকায় আম্মু আমার এই ইচ্ছে অপূর্ণ রাখেনি। এরিয়ার সব থেকে বড় প্রাইভেট মেডিক্যালে ভর্তি করালো। তারপর আবারো ব্যাক করলাম পড়ালেখায়। এক টার্ম গেলো। ততদিন আমাদের প্রথম ইয়ারেও আমি পরিচিত মুখ হয়ে উঠি। পরীক্ষার পর আবারো বাসায় এলাম। ওইদিনই আন্টি বাসায় এলো। আমাকে সরাসরি প্রথমবারের মতো দেখল। আন্টি ভীষণ আদুরে একজন মানুষ, প্রথম দেখায়ই আমায় এতোটা আদর করল মনে হয়নি আমি তাকে এই প্রথমবার সামনাসামনি দেখেছি। তার কিছুদিন পর হুট করেই আন্টি তার ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিলো। পরে জানলাম আন্টির বোনের ছেলে তিনি বন্ধা হওয়ায় সৌজন্যকেই নিজের ছেলে বলে। আম্মুও অনেক ভাবলো। একে তো বিজনেস, পুরণো বান্ধবী। সব মিলিয়ে আম্মুর কি হলো জানি না। আমায় বলল, আমিও কোনো দ্বিমত পোষণ করিনি। রাজি হলাম। বিয়ে হলো। প্রথমে সৌজন্য একটু খুঁত খুঁত করত। আমার বয়সের কারণে, আমি বাচ্চা, ম্যাচিউর না। তাই আমিও জেদ ধরলাম সৌজন্যের মন জেতার জন্য যা করা লাগবে করব। তাই পড়ালেখা ছেড়ে তার পিছনেই লেগে থাকলাম। সৌজন্যের মন গললো। তবে কয়েকবার পড়ালেখার কথা বললেও আমি ভাবলাম পড়ালেখা দিয়ে কি হবে। এই লোকটাই তো আমার সব! তবে কখনো ভাবিনি। বিয়ের একবছর পাঁচ মাসের মাথায় সৌজন্যের এই রূপ আমার সামনে আসবে। আর আমিও তখন তিনমাসের প্রেগন্যান্ট থাকব কখনো কল্পনাও করিনি। সে আমায় এভাবে ধোঁকা দেবে। এটা ভেবেই আমার পুরো জীবন এক পলকে মিথ্যা হয়ে ধরা দিলো।’
নওশির খুব ধৈর্য সহকারে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে চোয়াল শক্ত করে হাঁটছে আর পেখমের কথা শুনছে। যদিও সে অনেক কিছুই জানে। তবুও তার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে হলো। পেখম লম্বা শ্বাস ফেলল তারপর বলল,
‘ওইদিন রাতে যখন আমি বারবার বাসায় যাবার কথা বলি তখন সৌজন্য আমায় প্রথমে বুঝাতে চায় কিন্তু আমি যখন বলি আমি সব জানি দেখেছি! দ্যান হি ফোর্স হিমসেল্ফ অন মি এন্ড ওয়াজ রাফ ডিউরিং দ্য ইন্টিমেসি। তারপর আর আমার কিছুই মনে নেই। যখন চোখ খুলল নিজেকে হসপিটালে অবিষ্কার করলাম। তবে আমি কাউকে কিছু বলার আগেই আমার দেখাশোনা করার জন্য পাশেই একজন নার্স আরেক নার্সের সাথে কথা বলছিলো আর বলছিলো, আমার দুটো ফিটাস এসেছিলো। আর তারা মা রা গেছে, আমি মা না হবার চান্স খুব বেশি এবং আমার কন্ডিশন এমনও হতে পারে আমি পা গলও হয়ে যেতে পারি। আর হসপিটালের বেশির ভাগ মানুষ ধারণা করছে সৌজন্য মিথ্যা বলছে। আরো অনেক কথা এসব শুনতে শুনতে আমার দম বন্ধ হয়ে এলো। তারপর আর কিছু মনে নেই। তারপর জ্ঞান ফেরার পর জানতে পারলাম আমি মিনি স্ট্রো ক করেছিলাম। তারপর আমার মিনি স্ট্রো ক, মি সকা রেজ এগুলো থেকে সুস্থ হতে সময় লেগেছে চার অথবা সাড়ে চার মাস মাস। তবে ততদিনে সৌজন্যের খালা নিজেই মামলা করল ওর বিরুদ্ধে সাথে মায়ের সাথে কথা বলে ডিভোর্সের কাজ শুরু করল। ওকে ধরতে একমাসের মতো লেগেছে। তাহলে হলো সাড়ে পাচঁমাস।
আর ডিভোর্স মঞ্জুর হতে সময় লাগল ৯০ দিনের বেশি। মানে তিনমাস। তাহলে সাড়ে পাঁচ মাস আর তিনমাস কত? সাড়ে আটমাস! আমি সুস্থ হবার পরপরও ডিভোর্সর কাগজ এসে গেছিলো তবে আমি তেমন একটা সুস্থ কিংবা কারো সাথে কথা না বলায় আম্মু নিজেই সেই কাগজে সিগনেচার করে।’
এতটুকু বলতেই নওশির কপাল কুঁচকে গম্ভীর গলায় বলল,
‘তাহলে আপনার ডিভোর্স এখনো পুরোপুরি হয়নি!’
‘না। কারণ সিগনেচার আমার করা লাগবে।’
এক কথায় জবাব দিলো পেখম। তারপর ফের বলতে শুরু করে,
‘সৌজন্যের বিরুদ্ধে মামলা করায় এখনো সে পুলিশ কাস্টাডিতে আছে যতদূর জানি। তবে আমি ভেবেছি পুরোপুরি ভাবে ডিভোর্স হলে তাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনব এবং যে যার মত থাকব। শুধু শুধু তাকে আটকে লাভ কি? সে তো বুঝে শুনেই প রকীয়া করেছে এটা তো আর ভুল নয়! তাই শুধু শুধু এসব ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি! সে যার সাথে খুশি থাকতে চেয়েছে তার কাছেই নাহয় যাক।’
একটা লম্বা শ্বাস টানল মেয়েটা। নওশির এখনো হাঁটছে। পেখম ফের বলল,
‘আমি এদিক থেকে সুস্থ হবার পর জানতে পারলাম আমার চিকিৎসা আমি যেখানে পড়তাম সেই মেডিক্যালে হয়েছে। এবং ডক্টরের কথা মত আবারো সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে গেলাম। এবং একমাস তার কাছে কাউন্সিলিং করার পর তিনি সাজেক আসার সাজেস্ট করল। তবে ততদিনে আমি এতটা সাহস হয়ে উঠল না। তাই আরোও দুইমাস পর আমি আম্মুকে জানালাম, আম্মুও রাজি হলো তাহলে এই দুইমাস, আর আগপর একমাস; তিনমাস! আর আগের সাড়ে আট মাস। তাহলে মোট সাড়ে এগারো মাস। সাড়ে এগারো মাস পর মুক্ত বাতাসে সাজেকের পথে…’
নওশির থমকায়। তারপর জিজ্ঞেস করল,
‘একবছর হয়ে গেলো!’
‘তেমনই!’
নওশির জানে। সময়ের হিসাব তার থেকে বেশি কেউ রাখে নি। তাহলে পেখমের বয়স এবার ২৩ এ পড়বে আর নওশিরের কত? নওশির মনে করার চেষ্টা করল। তারপর গুনে বের করল, ৩৪। বুড়ো হয়ে যাচ্ছে নওশির। সাথে তার ফিরে যাবার সময়ও এসেছে৷ সে কিছু বলার আগে পেখম বলল,
‘সাড়ে এগারো মাস পর আমি পাহাড়, মেঘ, আকাশ ছুঁতে এসেছি, সাথে একটা সম্পর্কের মৃত্যু ও নিজের বেঁচে থাকার উৎসব একসাথে পালন করব। তবে ভাবিনি, এই যাত্রায় আপনি সঙ্গী হবেন।’
নওশির শুনল৷ সাথে থমকে দেখল কথার শেষ হতে হতে তারা তাদের কটেজে ফেরত এসেছে তাই নওশির কটেজের দিকে পা বাড়িয়ে শুধু বলল,
‘আই থিংক ইউ স্যূড মুভ অন!’
চলবে,…
- প্রানেশা আহসান শীতল


![সোহাগি সাঁঝমল্লার [পর্ব-০১]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/11/31a7a4da-aab9-4232-b478-dce9bb26ec9c.jpg)
![প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব-০৮]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/07/photo_6212761625384044921_y.jpg)
![মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৯]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/10/3cf51236-2d29-45c2-a963-4d58a217fde2.jpg)
![সেদিন ও তুমি [পর্ব-০৩]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/09/photo_6107219645971499828_y.jpg)