ঢালু গলি বেয়ে ছুটে চলেছে জাওয়াদ আর গুলনূর। জাওয়াদের পা টলছে, নিঃশ্বাস ভারী। পিঠের ক্ষত থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরছে, লাল ছোপ ফেলে যাচ্ছে পথের ওপর। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে শরীর, চোখের সামনে সব কিছু ঘোলাটে হয়ে আসছে।
শহরের এই পুরনো পাড়াটা প্রাণহীনের মতো। এককালের বর্ণিল বাড়িগুলো এখন জীর্ণ, ভাঙাচোরা। দূর থেকে ভেসে আসা চিৎকার আর পদধ্বনি আরও কাছে চলে এসেছে। রাতের নীরবতা ভেদ করে কয়েকটা কুকুর ডেকে উঠল। জাওয়াদ হোঁচট খেয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, গুলনূর তাকে ধরে ফেলল।
চারিদিকে তাকিয়ে ইশারা করল একটা পুরনো দোতলা বাড়ির দিকে। জানালায় হলুদ আলোর আভা। কে যেন জেগে আছে এত রাতে। বাড়িটার গায়ে লতাপাতা জড়ানো, দেয়ালের রং অনেকটাই খসে গেছে।
দুজনে টলতে টলতে এগিয়ে গেল বাড়ির গেটের দিকে। কালো লোহার গেট, মরচে ধরা। জাওয়াদ দুর্বল হাতে গেটে করাঘাত করল।
“কেউ আছেন?”
কোনো সাড়া এল না। শুধু দূরে কোথাও একটা পেঁচা ডেকে উঠল।
গুলনূর উদ্বেগে ছটফট করছে। তার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছায়া। সে জাওয়াদের হাত টেনে বোঝাল, আবার কড়া নাড়তে। জাওয়াদ আরও জোরে করাঘাত করল। কিন্তু বাড়ির ভেতর থেকে কোনো সাড়া এল না। উপরের জানালার আলোটা নিভে গেল।
অন্ধকারে ডুবে গেল তাদের শেষ আশা। গুলনূর দ্রুত জাওয়াদকে টেনে সামনে এগোতে লাগল।
পিছন থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর আরও স্পষ্ট। “ওদিকে গেছে! ওদিকে!”
গলির শেষে একটা চৌমাথা। কোন দিকে যাবে? গুলনূর দ্রুত চারদিকে তাকাচ্ছে। বাঁদিকের গলিটা আরও সরু, আঁকাবাঁকা। ওখানে অন্ধকার বেশি।
জাওয়াদের হাত ধরে টানতে টানতে বাঁদিকের গলিতে ঢুকে পড়ল।
জাওয়াদের পা আর এক পাও এগোতে চাইছে না। রক্তের ধারা এখন আরও বেড়েছে, কালো প্যান্টের পিছনে গাঢ় লাল ছোপ। মাথার ভেতরটা ঘুরপাক খাচ্ছে, চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে। সে থমকে দাঁড়াল।
“গুলনূর…” কণ্ঠস্বর এত দুর্বল যে নিজের কানেই অচেনা লাগল। “তুমি চলে যাও… আমি আর পারছি না…”
গুলনূরের চোখ দুটো জলে ভরে গেল। সে তৎক্ষণাৎ জাওয়াদের ডান হাতটা টেনে নিজের কাঁধে তুলে নিল। জাওয়াদকে ছেড়ে সে যাবে না, কিছুতেই না।
সামনের বাড়িটা পুরনো হলেও যত্ন করে রাখা। দরজায় একটা ছোট্ট পিতলের নকড়া ঝুলছে। গুলনূর কাঁপা হাতে সেটা বেশ কয়েকবার নাড়ল। দরজার ওপাশ থেকে কারও পায়ের শব্দ ভেসে এল।
“কে?” মৃদু একটি নারীকণ্ঠ। গলায় সংশয়ের সুর।
জাওয়াদ কষ্টে ঠোঁট নড়াল। “দয়া করে…দরজাটা খুলুন… আমরা বিপদে…”
ধীরে ধীরে দরজার পাল্লা খুলে গেল। বাইরের মৃদু আলোয় ভেসে উঠল একজন গর্ভবতী তরুণীর মুখ। বয়স বেশি হবে না, হয়তো পঁচিশের কাছাকাছি। বড় বড় চোখ, সরল মুখশ্রী। তার চোখে বিস্ময়।
“আপনারা…” তরুণী কথা শেষ করতে পারল না। জাওয়াদের রক্তাক্ত শরীর আর গুলনূরের ভয়ার্ত চোখ দেখে তার মুখে করুণার ছায়া নেমে এল। সে একটু পিছিয়ে দাঁড়াল। “ভেতরে আসুন…”
জাওয়াদ টলতে টলতে এক পা এগোল। “কিছু লোক পিছু নিয়েছে আমাদের… শুধু কিছুক্ষণের জন্য আশ্রয়…”
“রুমা! এত রাতে কার সাথে কথা বলছ?” ভেতর থেকে একটা রুক্ষ পুরুষকণ্ঠ ভেসে এল। পায়ের শব্দ করতে করতে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। গায়ে সাদা গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি। চোখে চশমা, মুখে কয়েক দিনের না-কামানো দাড়ি।
রুমা স্বামীর দিকে ফিরে বলল, “ওরা সাহায্য চাইছে গো… দেখো না, ভদ্রলোক রক্তাক্ত… মেয়েটিও…”
“কী পাগলামি করছ তুমি?” স্বামীর চোখে রাগ। তিনি দ্রুত এগিয়ে এলেন দরজার দিকে। “মাঝরাতে অচেনা লোক? তোমার পেটে সন্তান! কে জানে কী ঝামেলা! এখনি দরজা বন্ধ করে দাও।”
“কিন্তু…” রুমার চোখে সহানুভূতি। তার হাত এখনও দরজার পাল্লায়। “ওরা বিপদে…”
“আমাদের নিজেদের বিপদের কথা ভাবো!” স্বামীর গলায় ধমকের সুর। “কাল সকালে খবরের কাগজে দেখবে খুন-খারাপি… তখন বুঝবে! এসব ঝামেলায় জড়াতে চাই না আমরা।”
জাওয়াদ শেষবারের মতো মিনতি করল, “আমরা কারও ক্ষতি করব না… শুধু কিছুক্ষণ… সকাল হলেই চলে যাব…”
রুমার চোখ নেমে এল মাটিতে। বলল, “ক্ষমা করবেন…আমি… আমি চাইলেও…”
ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
নিরাপত্তার খোলস ভাঙতে কেউ চায় না। শহরের এই নিস্তব্ধ রাতে, যেখানে প্রতিবেশী প্রতিবেশীকে চেনে না, সেখানে পরের জন্য নিজের সংসার বিপন্ন করার সাহস কজনের থাকে? মানবতার দাম কতটুকু, যখন নিজের অস্তিত্বই বিপন্ন?
জাওয়াদ-গুলনূর সামনের দিকে এগোতে লাগল। গুলনূর তার কাঁধে জাওয়াদের এক হাতের ভর নিয়ে প্রায় টেনে নিয়ে চলল একটা অন্ধকার গলির দিকে। জাওয়াদের শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, পিঠের ক্ষত থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে।
জাওয়াদ আবার বলল, “গুলনূর…তুমি চলে যাও… আমাকে ফেলে চলে যাও…”
গুলনূর জোরে মাথা নাড়ল। সে আরও শক্ত করে ধরল জাওয়াদকে। তার চোখের ভাষা স্পষ্ট, ‘কখনোই না।’
ওরা আরেকটা গলিতে ঢুকল। মাথার উপর ফালি ফালি আকাশ, মেঘের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে মৃদু আভায়। দূরে একটা কুকুর ডাকল।
জাওয়াদের পা আর এক কদমও এগোতে চাইছে না। হঠাৎ সে টলে পড়ল, গুলনূর না ধরলে হয়তো মাটিতে পড়ে যেত।
“আমি… আমি আর পারছি না গুল…” জাওয়াদের চোখের সামনে সব ঘোলাটে হয়ে আসছে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, মাথার ভেতরটা ঘুরপাক খাচ্ছে।
গুলনূর তাকে টেনে নিয়ে গেল একটা অন্ধকার দেয়ালের পাশে। পুরনো দেয়ালে লতাপাতা জড়ানো। সে জাওয়াদের কপালে হাত রাখল। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে শরীরটা, যেন অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে।
“গুলনূর…” জাওয়াদের চোখ বুজে আসছে। শেষবারের মতো চেষ্টা করল কিছু বলার, “আমাকে… ছেড়ে…” শেষ করতে পারল না কথাটা। দেহটা ঢলে পড়ল গুলনূরের কোলে। জ্বর আর রক্তক্ষরণে অচেতন হয়ে গেল সে।
জুলফা অপলক চোখে তাকিয়ে আছে শব্দরের পিঠের দিকে। মানুষটা ভোরে ফিরেছিল, সারাদিন কোনো কথা হয়নি। কেমন যেন হারিয়ে গেছে নিজের মধ্যে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু কাছে যেতে দিচ্ছে না। দূরত্ব বজায় রেখে চুপচাপ শুয়ে আছে। ব্যবসায় লোকসানের কথা ভেবে একেবারে ভেঙে পড়েছে।
জুলফা কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে, “একটু পানি খাবেন?” “ওষুধটা…”
শব্দর নীরব। জুলফার হাঁসফাঁস লাগে। মানুষটা তো এভাবে কখনো চুপ হয়ে যায়নি।
হতাশ হয়ে পাশ ফিরে শুতে যাচ্ছিল, এমন সময় শব্দরের ভারী কণ্ঠস্বর কানে এলো, “জুলফা?”
জুলফা তৎক্ষণাৎ ফিরে তাকাল, “কিছু দরকার আপনার?”
“না।”
“খারাপ লাগছে?”
শব্দর নীরব রইল।
জুলফা আবার জিজ্ঞেস করল, মৃদু স্বরে, “খারাপ লাগছে আপনার?”
“তিন যুগ কবেই পার করে গেলাম জুলফা…” শব্দর থমকে গেল একটু, গলা পরিষ্কার করে নিল, “মানুষের জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন একজন আপনজন ছাড়া আর কিছুই সহ্য হয় না৷ আমি সারাজীবন খুঁজেও সেই মানুষটাকে পেলাম না। বরং ভুলের পর ভুল করে গেছি।” শব্দর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, “এই দীর্ঘ জীবনে একজন মানুষ জুটল না যে আমাকে বুঝবে, যার কাছে মনের সব কথা খুলে বলা যাবে। কেন… কেন এমন হলো জুলফা?”
“এসব ভেবে নিজেকে কেন কষ্ট দিচ্ছেন?”
শব্দর ধীরে ধীরে জুলফার দিকে সম্পূর্ণ ফিরে শুল।
রাতের আবছা আলোয় তার ক্লান্ত, পরিণত মুখের দিকে তাকিয়ে জুলফার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। কী বেদনা মানুষটার চোখে! সে আস্তে আস্তে স্বামীর জ্বরে গরম হাতটা নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিল।
কোমল কণ্ঠে বলল, “সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি সবসময় আপনার পাশে থাকব। আপনার আপনজন হয়ে।”
শব্দরের চোখের কোণে অশ্রু টলমল করে উঠল। মনে হলো, এই নির্ভরযোগ্য ছোঁয়াটাই সে জীবনভর খুঁজে বেড়িয়েছে।
ভোর হতেই জমিদার বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল নাভেদ। সুফিয়ান তখন বারান্দায় বসে কাগজের পাতা উল্টাচ্ছিলেন। নাভেদকে দেখে তিনি দ্রুত উঠে এলেন।
“নাভেদ! এসো, এসো। কেমন আছো বাবা?”
দুজন বৈঠকখানায় গিয়ে বসল। মনির চা আর মিষ্টি দিয়ে গেল। সুফিয়ান পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন।
“তোমার ব্যাপারটা শুনলাম। খুবই দুঃখজনক। এই বয়সে এতগুলো বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে বসে আছি, কিন্তু এমন অন্যায় কমই দেখেছি। কীভাবে এমন হলো বলো তো? তোমার বাবার সম্মতি ছিল?”
নাভেদ মাথা নিচু করে বলল, “যে যোগ্য সেই বসেছে, বাবার সম্মতিতেই।”
“এ কী কথা বলছ নাভেদ! তোমার মতন ব্যবসায়িক বুদ্ধি আর দেখিনি। তুমি যে ভাবে বাজার ধরেছ, যেভাবে নতুন নতুন পথ বের করেছ এমন দক্ষতা খুব কম মানুষের থাকে। তোমার বাবাকে আমি বিশ বছর ধরে চিনি। সেই সময় থেকেই শুনে আসছি। কলকাতায় থাকার সময় তুমি নাকি একাই পাটের নতুন বাজার খুঁজে বের করেছিলে। সেখানকার বড় বড় ব্যবসায়ীরা তোমার কথা শুনত।”
সুফিয়ান একটু থেমে চায়ে চুমুক দিলেন। তারপর আবার বললেন, “তোমার বাবা যদিও সম্মতি দিয়েছেন, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, এটা তার মনের কথা নয়। এরকম একজন ছেলেকে….তিনি হয়তো চাপের মুখে পড়ে…” কথাটা শেষ না করেই থামলেন। “এখন কোথায় আছো?”
“আপাতত বন্ধুর বাসায় আছি।”
” কী করবে ভেবেছ ?”
“রাজধানীতে যাব ভাবছি। কোনো অফিসে ঢুকতে পারি কি না দেখব।”
সুফিয়ান বিরক্তি আর বেদনা মেশানো কণ্ঠে বললেন, “তুমি চাকরি করবে? তুমি যে মানুষটি পাটের নতুন বাজার তৈরি করেছ, পশ্চিমবঙ্গের বড় বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চুক্তি করেছ, সেই তুমি অন্যের অধীনে কাজ করবে? তোমার শিরায় শিরায় ব্যবসার রক্ত বইছে নাভেদ। নিজের যোগ্যতাকে এভাবে অস্বীকার করো না! অফিসের টাকায় কী হবে?”
কথা শেষ না করেই তিনি থেমে গেলেন। জানালার বাইরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “যদি এই দুর্যোগে না পড়তাম, তোমাকে নিজের পাশে রেখে দিতাম। এখন…”
নাভেদ উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কোনো সমস্যা?”
সুফিয়ান উঠে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, “সব ভেস্তে গেল বাবা। একসঙ্গে সব ব্যবসায়ী চুক্তি ভেঙে দিয়েছে। পাট, ধান, সরিষা – কিছুই নেবে না। কে যে এই ষড়যন্ত্র করছে…” তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল।
একটু সামলে নিয়ে আবার বললেন, “তবে সময় থাকতে তাকে খুঁজে বের করব। কিন্তু তার আগে…” তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন। তার চোখে আতঙ্ক, “এই সঙ্কট থেকে বের হতে হবে। নইলে গ্রামের মানুষ পথে বসবে। কত কৃষক যে আমার কাছে ধার করেছে। তাদের ছেলেমেয়েরা না খেয়ে থাকবে। সব ফসল পচে যাবে, পোকায় খাবে, ইঁদুরে কাটবে।”
তিনি আবার চেয়ারে বসে পড়লেন। হিসাবের খাতাটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতে লাগলেন। তার আঙুল কাঁপছে। “একটা পথ বের করতেই হবে নাভেদ। নইলে এত মানুষের জীবন…” কথা শেষ না করেই তিনি চুপ করে গেলেন।
নাভেদ কিছুক্ষণ ভেবে বিনীত স্বরে বলল, “আমি হয়তো আপনার মতো অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী নই, তবে অনুমতি দিলে কিছু কথা বলতে চাই।”
সুফিয়ান চায়ের পেয়ালা নামিয়ে রেখে, অনুমতি দেয়ার দৃষ্টিতে তাকালেন।
নাভেদ একটু সামনে ঝুঁকে বসল, “আমরা যদি বড় ব্যবসায়ীদের বদলে ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করি? আমি অনেক ছোট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরিচিত। প্রত্যেকে সামান্য পরিমাণ নিলেও মোট মিলে সমস্ত ফসল বিক্রি হয়ে যাবে। তাছাড়া একজন ব্যর্থ হলেও অন্যরা থাকবে। ঝুঁকি ছড়িয়ে যাবে।”
সুফিয়ান গভীর মনোযোগে শুনছেন।
নাভেদ বলতে লাগল, “আর আপনার জমিদারির মহিলারা যদি পাট থেকে শিল্পজাত পণ্য তৈরি করে, আমি বাজারজাত করার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে পারব। তারা এখনই শুরু করতে পারে সহজ কিছু দিয়ে। যেমন পাটের সুতা দিয়ে হাতের কাজের বাজারের ব্যাগ। এতে কোনো কলকব্জা লাগবে না, শুধু হাতের কাজ। এরপর ধীরে ধীরে করতে পারে চাটাই আর পর্দার কাজ। এগুলো খুব কঠিন না। একটু অভিজ্ঞতা হলে কলকাতার বাজারের জন্য মেয়েদের হাতের ব্যাগও বানাতে পারবে।”
নাভেদ আরও বলল, “দেখুন, এখন আর শুধু চটের বস্তা আর দড়ি নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। কলকাতায় থাকার সময় দেখেছি, সেখানে এসব জিনিসের দারুণ কদর। বড় বড় দোকানে বিক্রি হয়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা গ্রামে গ্রামে খুঁজে বেড়ায় এসব জিনিস। রেলে করে পাঠালে খরচও কম পড়বে।”
তারপর একটু থেমে বলল, “আর এখন তো কলকাতার বাইরেও বাজার খোলা যাবে। শুনেছি দিল্লি, বোম্বাইতেও এসব জিনিসের চাহিদা বাড়ছে। ওখানকার দোকানদাররা নাকি গ্রামের তৈরি জিনিস খুঁজে বেড়ায়। তবে এসব ধীরে ধীরে। আপাতত কলকাতার বাজারটা ধরলেই হবে। এতে করে গ্রামের মানুষের আয় বাড়বে, পাটের দামও বৃদ্ধি পাবে।”
সুফিয়ানের চোখে বিস্ময়ের ঝিলিক দেখা গেল।
“আরও একটি প্রস্তাব,” নাভেদ একটু থেমে বলল, “প্রতিটি গ্রামে ছোট ছোট সমবায় গঠন করা যেতে পারে। সেখানে নারী-পুরুষ সবাই মিলে কাজ করবে। এতে আপনার জমিদারির উন্নতি হবে, মানুষের জীবনমানও উন্নত হবে। শুধু পাট নয়, ধান-সরিষার জন্যও এই পথ খোলা আছে। নতুন চিন্তা করলে নতুন পথ আপনা থেকেই বেরিয়ে আসে।”
সুফিয়ান স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন নাভেদের দিকে।
নাভেদ বিনম্র ভঙ্গিতে মাথা নত করে বলল, “তবে সিদ্ধান্ত আপনারই।”
সুফিয়ান আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। নাভেদও সম্মানে উঠে দাঁড়াল। সুফিয়ান পিতৃস্নেহে নাভেদের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “এই পরিকল্পনা যদি সফল হয়, এই সঙ্কট যদি কাটিয়ে উঠতে পারি, তবে তুমি আমার ব্যবসার অংশীদার হবে।”
নাভেদ চমকে উঠল। বলল, “আমি? কিন্তু…
“তুমি অন্যের দরজায় দরজায় ঘুরবে কেন? তুমি আমার সঙ্গে থাকো। তোমার মধ্যে সততা আর নিজের মতো বুদ্ধি দুটোই আছে। তুমি আমার শব্দরের পাশে থাকো! যা চাও, যা দরকার সব পাবে।”
নাভেদ বিনম্র কণ্ঠে বলল, “আমি শুধু ব্যবসা নিয়ে থাকতে চাই। লাভ-ক্ষতির হিসাব নয়, শুধু কাজটা ভালোভাবে করতে চাই।”
সুফিয়ানের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। তিনি ভেতরের দিকে তাকিয়ে ডাকলেন, “মনির, মনির… শব্দরকে খবর দে, আড়তে আসতে বল।”
তারপর নাভেদের দিকে ফিরে পিঠে হাত রেখে বললেন, “চলো বাবা, আড়তে গিয়ে আলোচনা করি।”
রোদ তেমন চড়া নয় আজ। আকাশের গায়ে হালকা মেঘের ছোঁয়া। জুলফার পায়ের শব্দে ছাদের কবুতরগুলো উড়ে গেল। ধীরে ধীরে সে ছাদে উঠল। পরনে খয়েরি শাড়ি, সবুজ পাড়। শাড়ির আঁচল মেঝে ছুঁইছুঁই।
হঠাৎ চোখে পড়ল একটা টকটকে লাল গোলাপের ওপর। অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল। এই ফুলটা এখানে এল কোথা থেকে? তার পাশেই একটা পুরনো রেডিও। কতদিন আগের কথা! যাত্রাদলে যখন অভিনয় করত, তখন ওখানকার একটা রেডিওর সামনে বসে কত গান শুনেছে। কতবার ইচ্ছে করেছে রেডিওটা নিজের কাছে নিয়ে আসতে। কিন্তু পারেনি। অন্যের জিনিস কী করে আনবে?
আজ সেই রেডিওটাই যেন তার জন্য অপেক্ষা করছে। থেমে থেমে গান বাজছে। জুলফা আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল। প্রথমে গোলাপটা তুলল হাতে। তারপর রেডিওটা। হালকা ধুলো জমেছে ওর গায়ে। আঙুল দিয়ে মুছে নিল সেটা।
চলবে…


![প্রজাপতি আমরা দুজন [পর্ব-০৭]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/07/photo_6212761625384044921_y.jpg)
![মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৮]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/10/3cf51236-2d29-45c2-a963-4d58a217fde2.jpg)
![সেদিন ও তুমি [পর্ব-০২]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/09/a-simple-light-colored-t-shirt-and-je.jpg)
![মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি [পর্ব-০৭]](https://amarlekha.com/wp-content/uploads/2025/07/srthgerf.jpeg)